মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সাথে অবিশ্বাসী অর্থাৎ কাফেরদের শত্রæতা বেড়ে গেলো। এই শত্রæরা ছিলো মক্কার কুরাইশ বংশের অবিশ্বাসী বা কাফের। তারা মুসলমানদের নানাভাবে অত্যাচার করতো। নানান পদ্ধতিতে করতো নির্যাতন। একইসাথে রাসূল সা.-এর বিরোধিতা প্রচণ্ড রকম করতে শুরু করলো। তারা অবিচার অত্যাচার নির্যাতন করে বসে থাকলো না। তারা একটি নির্মম সিদ্ধান্ত নিলো। সিদ্ধান্ত নিলো- তারা সবাই মিলে বনু হাশিম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত মহানবী মুহাম্মদ সা. এর নিকটাত্মীয়ের সবাইকে বয়কট করবে। এটি এতোটাই ভয়াবহ পদক্ষেপ ছিলো যা আগে কল্পনা করা যায়নি। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তারা তাদের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাপত্র লিখলো। ঘোষণাপত্রে লেখা হলো- বনু হাশিমের কাছ থেকে কোনো কিছু কেনা যাবে না। তাদের কাছে কোনো কিছু বিক্রিও করা যাবে না। আমাদের কোনো মেয়েকে তাদের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হবে না। একইসাথে আমাদেরও কেউ তাদের মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না। এই ঘোষণা দিয়েই শেষ থামেনি তারা। আরও ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিলো সেই অবিশ্বাসীরা। তারা একটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মহানবী সা. ও তাঁর সাহাবিদের বন্দী করে রাখলো। রাসূল সা.-এর সাথে হযরত খাদিজা রা. ও রাসূলের চাচা আবু তালিবও ছিলেন। শিবে আবু তালেব নামে পরিচিত ছিলো এই পাহাড়ি অঞ্চলটি। এটি এমনই কঠিন জায়গা ছিলো যেখানে কোনোরকম ফসল হতো না। দুর্গম এ উপত্যকা কোনোভাবেই মানুষ বসবাসের উপযোগী ছিলো না। কিন্তু রাসূল সা. ও তার সাহাবিসহ সংখ্যায় ৫৩ জন। সঙ্গে যে খাদ্যদ্রব্য ছিলো কিছু দিনের মধ্যেই সেসব ফুরিয়ে গেলো। ফলে খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব দেখা দিলো। খাদ্যের অভাব খুব চরম হয়ে উঠলো। এমনই চরম অবস্থা হলো- এক পর্যায়ে সাহাবিরা গাছের পাতা, ছাল, উট ও দুম্বার চামড়া খেতে বাধ্য হলেন। এতোটাই করুন হলো অবস্থা তা বোঝা যায় একটি ঘটনার ভেতর দিয়ে। একদিন এক সাহাবি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হলেন। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় হঠাৎ পায়ের নিচে খসখস আওয়াজ শুনতে পেলেন। পায়ের নিচে তাকালেন তিনি। দেখলেন- এক টুকরো উটের চামড়া। যা শুকিয়ে ঠনঠনে প্রায়। ফলে পায়ের নিচে খসখসে আওয়াজ হচ্ছিল। তিনি উটের সেই শুকনো চামড়ার টুকরোটি হাতে তুলে নিলেন। সেটিকে ভালো করে ধুয়ে নিলেন। তারপর আগুনে পোড়ালেন। পুড়িয়ে টুকরো টুকরো করলেন। টুকরোগুলো মেশালেন পানিতে। ভিজে কিছুটা নরম হলো টুকরোগুলো। এগুলো খেয়েই তিনি তিন দিন কাটিয়ে দিলেন। এমনই দুরবস্থার মধ্যে পড়লেন তারা। এসব ভয়াবহ কষ্ট ও দুঃখের খবর প্রতিদিন অবিশ্বাসী লোকগুলো শুনতো। শুনে তারা এতটুকু ব্যথিত তো হয়নি বরং কষ্টের কথা শুনে সুখ অনুভব করতো। এমনই নিষ্ঠুর ছিলো কাফেরগুলো।
ভীষণ কষ্টের মধ্যে মুসলমানদের বেশ কয়টি মাস কেটে গেলো। একদিন মহানবী সা. চাচা আবু তালিবকে বললেন- চাচা আল্লাহ তায়ালা কুরাইশদের ঘোষণাপত্রে উইপোকা লাগিয়ে দিয়েছেন। তাতে আল্লাহর নাম ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ওদের জুলুম অন্যায়, সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা এবং ওদের দেয়া মিথ্যা অপবাদ সব খেয়ে ফেলেছে।
উইপোকা কুরাইশদের চুক্তিনামাটি খেয়ে ফেলেছে। সেখানে একটি বাক্য পোকা খায়নি। বাক্যটি হলো- ‘আপনার নামেই শুরু করছি হে আল্লাহ।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার নামের বাক্যটি ছাড়া আর একটি শব্দও অবশিষ্ট রইলো না। সব খেয়ে নিলো উইপোকা। এ কথা শুনে আবু তালিব অবাক হয়ে গেলেন! বিস্ময় নিয়ে রাসূলকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমার প্রতিপালক কি তোমাকে এ বিষয়ে জানিয়েছেন?’
মহানবী সা. বললেন- জি, আমার প্রতিপালকই জানিয়েছেন আমাকে।
আবু তালিব বললেন- আল্লাহর শপথ! তোমার কাছে কেউ আসার আগেই আমি কুরাইশদেরকে বিষয়টি জানাবো।
ঠিকঠিক আবু তালিব কুরাইশদের কাছে গেলেন। তাদের ডেকে বললেন- হে কুরাইশ স¤প্রদায়! আমার ভাতিজা মুহাম্মদ তো আমাকে বলেছেন- তোমাদের চুক্তিনামায় আল্লাহ তায়ালার নাম বাক্যটি ছাড়া সবই খেয়ে ফেলেছে উইপোকা। সে যা বলেছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমরা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত বাদ দাও। এবং আমাদেরকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দাও। আর যদি তার কথা মিথ্যা হয়, তাহলে আমি আমার ভাতিজাকে তোমাদের হাতে ছেড়ে দেবো। তখন তোমরা তার সাথে যা খুশি তাই করো।
কুরাইশ স¤প্রদায় বললো- ঠিক আছে। তোমার কথায় আমরা রাজি আছি।
তারা সবাই মিলে কাবা ঘরের দেয়ালের কাছে গেলো যেখানে চুক্তিনামাটি ঝোলানো আছে। তার একসাথে দেখলো চুক্তিনামাটি। দেখে তো তাদের চোখ কপালে উঠলো! রাসূল সা. যা বলেছেন ঠিক তাই সত্য প্রমাণিত হলো।
কিন্তু কুরাইশরা তাদের ওয়াদা ভঙ্গ করলো। একইসাথে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার আরও বাড়িয়ে দিলো। ক্ষুধা-পিপাসার যন্ত্রণা নিয়ে মুসলমানদের দিন কাটতে লাগলো। একরকম জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে তারা।
অবশ্য কুরাইশদের মধ্যে কিছু লোকের হৃদয় খুব ব্যথিত হলো মুসলমানদের জন্য। তাদের নরম দিলো মুসলমানদের দুঃখ অনুভব করলো। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন হলেন- হিশাম বিন আমার। তার চেষ্টা ও দূরদর্শিতার কারণে মুসলমানগণ এ কঠিন অবস্থা থেকে মুক্ত হলেন।

Share.

মন্তব্য করুন