আমরা সোনালি ধানের মাঠ পাই যখন বাংলাদেশে সোনাঝরা রোদের ঋতু, মায়াময় ঋতু হেমন্ত আসে। খুব চুপে চুপে, ঝিরিঝিরি বাতাসের মাধ্যমে হেমন্ত আসে আমাদের প্রকৃতির কোলে। শরতের সাদা কাশফুল আর শিউলির পাপড়িতে কী সুন্দর শিশির পড়ে। এই শিশির ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ঝরতে থাকে রাতের বেলা। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় শিশির পড়া। গভীর রাত হলে শিশিরের টুপটাপ শব্দের আওয়াজ বাড়তে থাকে। শিশিরের এই টুপটাপ শব্দ বড়ই চমৎকার। এভাবে শরতের সাদা কাশফুল আর সাদা মেঘ ছুঁয়ে আসে হেমন্তের কোমলময় ঋতু।
হেমন্ত আসে ঠিক তখন, যখন আমাদের মাঠগুলো ধানের ছড়ায় ভরে ওঠে। মাঠ জুড়ে ধানের জগৎ একটানা যতদূর চোখ যায়। দূরে দেখতে দেখতে মনে হয়- ধানের মাঠের ওপারে বুঝি আকাশটি নেমে গেছে। অথবা ধানের মাঠ গিয়ে ঠেকে গেছে দিগন্ত রেখার কাছে। হেমন্তে সোনালি ধানের মাঠ দেখেনি এমন মানুষ মনে হয় বাংলাদেশে নেই। এমনটি মনে হওয়ার অবশ্য কারণ আছে- কারণ ধানের মাঠ তো বাংলাদেশের সবখানে, সব জায়গায় থাকে। আবার হেমন্তও সব জায়গায় সোনালি পাখা মেলে দেয় ধানের ক্ষেতে। তাই ধানের ক্ষেত বাংলাদেশের সকল মানুষের চেনা। সকল মানুষের জানার ও দেখার মধ্যে থাকে।

আমরা ছোটবেলায় প্রায় দলবেঁধে ধান ক্ষেতের আলে যেতাম সকাল সকাল। একদম খালি পায়ে যেতাম সবাই। ক্ষেতের আলে কত যে সবুজ ঘাস ছিলো। ঘাসের ওপর সারারাতের শিশির জমে থাকতো। আমরা যখন যেতাম খুব ভেজা থাকতো ঘাসগুলো। মনে হতো এইমাত্র বুঝি বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিয়ে গেলো। তবে বৃষ্টির সাথে শিশিরের ব্যবধান ছিলো কিছুটা- বৃষ্টি হলে ঘাসগুলো সারা শরীর ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে থাকে। আর শিশিরেও ধুয়ে থাকে সব ঘাস কিন্তু বৃষ্টি হলে ঘাসের ডগায় বা শিরে ফোঁটা জমে থাকে না। কিন্তু শিশির ফোঁটা ঘাসের ডগায় খুব সুন্দর করে জমে থাকে মুক্তোর মতো। একদিকে জমে থাকা শিশির ফোঁটা তার সঙ্গে ভেজা ভেজা ঘাস। এমন ঘাসের ওপর পা রাখলে কী যে মজা লাগতো বলার মতো না। আজও তার অনুভব অনুভূতি আর মনের চেতনা যেনো জেগে আছে। কিশোরকালের এই হেমন্ত সকালকে খুব মিস করি এখন আমি এবং আমরা। শীতল হাওয়ার ভেতর শীতল শিশিরের অনুভব বড় ভালো লাগার ছিলো আমাদের। শিশির ভেজা ঘাসে এক পা তুলে আরেক পা ছোঁয়ার সে কি আনন্দ ছিলো আমাদের! ঘাসের মতো পাকা ধানের শীষের ওপর জমে থাকতো, অবশ্য এখনো থাকে, শিশির ফোঁটা। দেখতে একেবারে মুক্তোর মতো ঝকঝকে পরিষ্কার উজ্জ্বল আর সূর্যের আলোতে জ্বলতো।

আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরটা গোলগাল করে কেটেছিলেন আমার দাদাজান। পুকুরের চারপাশে গাছগাছালি লাগিয়ে দিয়েছিলেন খুব যত্ন করে। অনেক রকম গাছগাছালির চারা রুয়ে দিয়েছিলেন। সেই গাছগাছালির চারা সময়ে লকলক করে বড় হয়েও উঠেছে। এখন একেকটি গাছের কত ডাল। কত পাতা। একেক গাছের একেক রকম রূপ। একেক রকম অবয়ব আর রঙ। আম জাম কাঁঠাল তো বাংলাদেশের সবখানে সব জায়গায়ই আছে। সেই হিসেবে আমাদের পুকুরপাড়েও আম জাম আর কাঁঠালের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়াও নানারকম ফলের গাছে যেমন- বরইগাছ, আতা ফল গাছ, গাব গাছ ইত্যাদি ফল গাছে ভরা। এর সাথে আছে পেয়ারা গাছ। পেয়ারাগুলো খুব মিষ্টি এবং কিছুটা রসালো। আমড়া গাছে আমড়াও বেশ মিষ্টি মিষ্টি। পেঁপে গাছেও মিষ্টি পেঁপে ধরে থাকে প্রায় সারা বছর। এসব ফল যেমন আমরা খাই, তেমনই বাড়ির অন্য মানুষেরাও খেয়ে থাকে। কিছু ফল পাখিরাও খায়। পাখিরা খেতে আসলে আমার দাদা বলতেন- খবরদার তোমরা কেউ পাখিদের তাড়াবে না। ওরা ওদের ইচ্ছে মতো খেয়ে যাক। কেননা তিনি বলতেন- পাখিদেরও এইসব ফলের ওপর অধিকার আছে। সুতরাং ওরা ওদের ইচ্ছে এবং পছন্দ মতো খেয়ে যাবে, কেউ বাধা দেবে না। পাখিরাও আমাদের এই ফলের সমাহারকে ওদের অভয়ারণ্য ভেবে নিয়েছে। তাই কখনও কখনও কেউ আকস্মিক হৈ হাই করলেও পাখিরা পাত্তা দিতো না। তারা তাদের মতো করে খেয়ে যেতো। কোনোটা পুরোপুরি খেতো। আবার কোনোটা অর্ধেক খেতো। বাকিটা ঝুলে থাকতো গাছের ডালে। কখনও কখনও পড়েও যেতো গাছ থেকে।

ফল গাছের পাশাপাশি আছে বড় বড় এবং মোটাসোটা কড়ই গাছের সারি। কড়ই গাছের ডালগুলো বিশাল বিশাল হয়ে ছড়িয়ে থাকতো। এসব গাছের উঁচু ডালে কতরকম পাখির বাসা ছিলো। করঞ্জা গাছের ঘনপাতা ও ঝোপঝাড়ে পুকুর পাড় জড়িয়ে রাখতো। বেশ ঘন ছায়া হতো এসব গাছের নিচে। ডুমুর গাছ আর হিজল গাছের ডালও অনেক বাড়িয়ে এগিয়ে থাকে। হিজলের ডালে কত রকম পাখির আসা যাওয়া। কত রকমের পাখির গানের সুরে পুকুর পাড় জমানো থাকতো। নারিকেল গাছের বিরাট উঁচু মাথায় ডাব এবং পাকা নারিকেল ঝুলে থাকতে দেখলে বেশ ভালো লাগতো।
মোটাতাজা তালগাছও অনেক উঁচু হয়ে উঠে থাকে সব গাছের উপরে। তালগাছের পাতায় বাবুই পাখিরা বাসা বুনতো। আহা কী সুন্দর ছিলো সেই সব বাবুইপাখির শৈল্পিক সৌন্দর্যপূর্ণ বাসা।
এমন একটি পুকুর খুব সুন্দর পরিবেশ দিয়েছিলো আমাদের। আমরা পুকুরপাড়ে দাঁড়াই বসি আর সময়কে উপভোগ করার নানরকম করায় আবিষ্কার করতাম। পুকুরের উপর হেমন্তের নীল আকাশ যখন উপুড় হয়ে থাকে তখন মনে হয় আকাশেও একটি নীলের পুকুর আছে।
এ পুকুরের পাড় থেকে শুরু হয়েছে ধানের মাঠ। পুকুরের পশ্চিম পাড় থেকে এই ধানী জমিনের বিশাল মাঠ চলে গেছে বহু বহু দূর। যার যার জমির সীমানায় আল দেয়া আছে তো সত্যি। কিন্তু দূর থেকে দেখে মনে হয় মাঝখানে কোনো আলই নেই। গোটা মাঠ যেনো একটিই বুঝি জমিন। এ বিশাল জমিন এতো বিশাল হয়ে চলে গেছে দূরের দিকে।

হেমন্ত এলে আমরা বিকেল বেলায় আমাদের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম ধানের মাঠ। পাকা ধানের ওপর বিকেলের কোমল নরম রোদ পড়লে কি যে দৃষ্টিকাড়া রূপ ভেসে থাকে। এ রূপটি এতই সুন্দর মনে হয় যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মাঠের পর মাঠ যেনো হেমন্ত বিছিয়ে থাকতো ধানের ক্ষেতে।
তবে সোনালি রূপটি বেশি ধরা পড়ে দুপুর বেলায়। যখন সূর্য মাথার ওপর উঠে আসে ঠিক তখন সোনালি রঙ ধানের মাঠে চকচকে হয়ে উঠতো। এসব রূপ আর রঙ দেখে দেখে বড় হয়েছি আমরা। আর বিশ্বাস করি প্রকৃতির মতো উদার হয়েছে আমাদের মন। আজ তোমরা যারা কিশোর তোমরাও দেখো প্রকৃতির এই রূপ।
প্রকৃতির কাছে থাকলে বড় হবে মন এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতির মতো উদার হয়ে বেড়ে ওঠো তোমরা- এটিই আমাদের চাওয়া।

Share.

মন্তব্য করুন