বুকের বাঁ দিকে সারাক্ষণ ধুকধুক করে যে যন্ত্রটি আমাদেরকে প্রতিক্ষণে প্রাণের অস্তিত্বের কথা জানান দেয়, তার নাম হৃৎপিণ্ড। ইংরেজিতে যাকে বলে হার্ট। এই যন্ত্রটি যদি দুই মিনিটের জন্যও আমাদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে, তবেই সব শেষ। হৃৎপিণ্ড নামের এই ছোট্ট যন্ত্রটি আজীবন মানুষের সঙ্গে খেলে যায় জীবন-মৃত্যুর গোপন খেলা।
হৃৎপিণ্ড শরীরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হৃৎপিণ্ডের কাজ সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন করা। হৃৎপিণ্ডকে গ্রিক ভাষায় বলে কারডিয়া আর ল্যাটিন ভাষায় কর। কর থেকেই করোনারি শব্দের উৎপত্তি। করোনারি মানে হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ডকে ইংরেজিতে বলে (Heart) হার্ট। আর সাহিত্যের ভাষায় বলে হৃদয় বা অন্তর।
হৃৎপিণ্ড কোনাকৃতির, লালচে মাংসল অঙ্গ। বুকের বাঁ দিকে এই দুই ফুসফুসের মধ্যে এর অবস্থান। বাঁ বগলের গোড়া থেকে তিন বা চার ইঞ্চি দূরে হৃৎপিণ্ডের মাথা অবস্থিত। হৃৎপিণ্ড যকৃতের বাঁ দিকের কিছু অংশ স্পর্শ করেছে। পুরো হৃৎপিণ্ডের দুই- তৃতীয়াংশ বাঁ দিকে আর এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে ডানদিকে। এর দেহ পেরিকার্ডিয়াম নামে দুই স্তরবিশিষ্ট পাতলা আবরণ দ্বারা আবৃত। হৃৎপিণ্ডকে হাতের পাঁচ আঙুলের মধ্যে নেয়া যায়। মেডিক্যাল সায়ন্সের ভাষায় একজন পূর্ণ বয়স্ক মানষের হৃৎপিণ্ডের ওজন ২৫০-৩০০ গ্রাম। হৃৎপিণ্ডের চারটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। উপরের দুটি হচ্ছে ডান অলিন্দ, বাঁ অলিন্দ, ডান নিলয়, বাঁ নিলয়। আর রয়েছে অনেক শিরা, উপশিরা, ভাল্ব ও ধমনি। শিরা, উপশিরায় তৈরি রক্তবাহী মাংসল থলেকে বলে ভাল্ব। পানির মেশিন যেমন উঁচু দালানের প্রতিটি পাইপে পানি সরবরাহ করে, ঠিক তেমনি হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্প সারা দেহে পাঠায়।
পুরো শরীরে রক্ত সঞ্চালন করতে হৃৎপিণ্ড সময় নেয় মাত্র বিশ সেকেন্ড। সেই সময়ে আমাদের নার্ভ প্রায় ২৫ বার স্পন্দিত হয়। একজন মানুষ দশবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জিকির করতে পারে। ছোট্ট একটি হৃৎপিণ্ড পুরো শরীরের অপরিশোধিত রক্তকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসা, ফের সেটাকে শোধন করা, অক্সিজেন গ্রহণ করে যথাস্থানে সরবরাহ করা, আবার দূষিত পদার্থ বর্জ্য আকারে বের করে দেওয়ার মতো প্যাঁচালো কাজ খুব আমানতদারির সাথে পালন করে থাকে। রক্ত পাম্প করার জন্য ভাল্বগুলো প্রতি সেকেন্ডে খোলে আর বন্ধ হয়। ফলে তৈরি হয় স্পন্দন বা হার্টবিট।
আমরা কি জানি প্রতিদিন হার্ট কতবার বিট করে বা কত গ্যালন বা কত লিটার রক্ত পাম্প করে? বিজ্ঞানীরা এই রহস্য যন্ত্রের গবেষণা করে দেখেছেন, প্রতিদিন আমাদের হার্ট এক লাখ বার বিট করে। অর্থাৎ প্রতিদিন এক লাখবার হার্টবিট হয়। এবং প্রতিদিন হার্ট দুই হাজার গ্যালন বা সাত হাজার পাঁচশত একাত্তর লিটার রক্ত পাম্প করে। অর্থাৎ ঐ পরিমাণ বিশুদ্ধ রক্ত শরীরে পাঠায়। আর হার্টের অ্যানাটমি যদি নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, মানবদেহের হার্টটি একটি সুপারসনিক জেট বিমানের চেয়েও নিখুঁত। মাতৃগর্ভের তৃতীয় সপ্তাহের শেষে হার্ট হঠাৎ কাজ করা শুরু করে এবং বিরতিহীনভাবে জীবন ৭০-৮০ বছর কাজ করে চলে। আল্লাহ তায়ালার আদেশেই সে কাজ করা শুরু করে এবং তাঁর আদেশেই সে থেমে যেতে বাধ্য হয়।
হার্ট মিনিটে ৭০ বার, ১ বছরে সাড়ে তিন কোটি বার এবং জীবনে ২ ট্রিলিয়ন (২০০০০০০০০০০০০ কোটি) বার কাজ করে থাকে। জীবনে হার্ট ১৫ লাখ ব্যারেল রক্ত সঞ্চালন করে থাকে।
প্রতিদিন হার্ট যে শক্তি (Enargy) উৎপন্ন করে থাকে তা দিয়ে একটি ট্রাক ২০ মাইল যেতে পারবে, এবং সারা জীবনে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চাঁদে যাওয়া এবং ফিরে আসা সম্ভব। আমাদের শরীরে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন (১০০০০০০০০০০০০০০ কোটি) কোষ রয়েছে। হার্টের মাধ্যমে প্রতিটি কোষে দিনে ১০০০ বার রক্ত সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
হার্টের বদৌলতে রক্ত প্রতিদিন আমাদের শরীরে ১২০০ মাইল ভ্রমণ করে থাকে। হার্টের রয়েছে বিশেষ ইলেকট্রিক সার্কিট sa node, AV node, Bu Node of his, purking fibre
sa node হচ্ছে টিম লিডার। তার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় যার কারণ হার্টের ৬০-১০০ বার সংকোচন করে থাকে। সে কাজে অক্ষম হয়ে পড়লে, AV node নেতৃত্ব গ্রহণ করে থাকে। তার কার্যক্ষমতা ৪০-৬০ বার। সে দুর্বল হয়ে গেলে bu node of his দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। যার কার্যক্ষমতা আরো কম। আর এভাবেই আল্লাহ তায়ালা কয়েক স্তরে হার্টের তথা জীবন সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এই ইলেকট্রনিক সিস্টেমের কারণে হার্টের কর্মকাণ্ডে ছন্দময়তা আছে। হার্টের অলিন্দ যখন সঙ্কুচিত হয়, নিলয় তখন সম্প্রসারিত হয়। একই সময়ে অলিন্দ-নিলয় সঙ্কুচিত হলে শরীরে রক্ত সরবরাহে চরম ব্যাঘাত ঘটত।
sa node কে প্রাকৃতিক পেসমেকার বলা হয় যা ডান অলিন্দে অবস্থিত এবং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ০.৫ ইঞ্চি। প্রতি ৬০০ জনের মধ্যে একজনের বৃদ্ধ বয়সে এটির কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। বাকিদের ক্ষেত্রে এটি সারাজীবন কর্মক্ষম থাকে।
হে চিন্তাশীল মানুষ, এবার মানুষের হাতে তৈরিকৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মেশিনের কথা একবার ভাবুন। কোনো মেশিনই এত টেকসই নয়। লাগাতার বিরতিহীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাকে বিশ্রাম দিতে হয়।
১০-১৫ বছরের বেশি সাধারণত কোনো মেশিনই টেকে না। এর মধ্যে সেটিকে অনেকবার সার্ভিসিং করতে হয়। মেকানিক দেখাতে হয়। অথচ হৃৎপিণ্ড ৭০-৮০ বছর বিরতিহীনভাবে কাজ করে চলে, কোনো সার্ভিসিং করাতে হয় না, কোনো মরিচা বা জং ধরে না। মানুষের তৈরি পাম্প মেশিন বিকট শব্দ করে, পরিবেশ দূষিত করে অথচ হার্ট শব্দহীন। (ডাক্তাররা অবশ্য হার্টের শব্দ শুনতে পায়) আসুন সেই মহান কারিগর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে সিজদায় মাথা নত করে দেই।

Share.

মন্তব্য করুন