মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর শিশুকালের প্রতি তাকালেই যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন যে এই শিশুই মহামানব রূপে এ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। আজ হতে সাড়ে ১৪০০ বছর পূর্বে বাংলাদেশ হতে দূরে বহু দূরে মরুবেষ্টিত বালুকাময় রুক্ষ পাহাড়ি অঞ্চল; সবুজ বন-বনানী, ক্ষেত, ফসলবিহীন এক দেশ; নাম তার আরব। সে দেশেরই কঠিন পাথরের পাহাড়বেষ্টিত এক প্রাচীন শহরের নাম মক্কা। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.) প্রতিষ্ঠিত কাবা ঘরকে কেন্দ্র করেই হাজার হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল এ জনপদ। মক্কা নগরী ছিল তৎকালীন আরবের তথা সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পবিত্রতম স্থান। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, অর্থ-সম্পদ সব দিক দিয়ে ছিল উন্নত। এত কিছু থাকার পরও সেখানে ছিল না তিল পরিমাণ শান্তি। হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, জীবন্ত শিশুকন্যাকে পুঁতে ফেলে হত্যা, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
মানুষ আল্লাহ্কে ভুলে গিয়ে লা’ত মানাত হোবল-উজ্জা প্রভৃতি হাতে গড়া মূর্তির পূজায় ছিল মগ্ন। নানা কুসংস্কারের বন্দী হয়েছিল মানবতা। আল্লাহ্র ঘর কাবা ছিল ৩৬০টি মূর্তিতে অপবিত্র।
পৃথিবীর এ চরমতম জাহেলিয়াতের যুগ সন্ধিক্ষণে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল সুবহি সাদিকের সুনির্মল আভায় প্রকৃতির নিখাদ নিস্তব্ধতা ভেঙে মা আমেনার কোলজুড়ে এলো এক শিশু। হকচকিত মানবাত্মা। উৎসুক বিশ্ববাসী। তারা কর্ণ উৎকীর্ণ করে জানতে চাইলো ধূলির ধরায় আজ এ আলোক উজ্জ্বল সুপ্রভাত নিয়ে কে এলো? তাদের সাথে সুর মিলিয়ে কবি বলেন :
নূরের দরিয়া সিনান করিয়া
কে এল মক্কায় আমেনার কোলে,
ফাগুন পূর্ণিমা নিশীথে যেমন
আসমানের কোলে রাঙা চাঁদ দোলে।
…. …. …. ….
এলরে চির চাওয়া এলো আখেরী নবী
সৈয়দে মক্কী মাদানী আল আরবী
নাজেল হয়ে সে যে ইয়াকুত রাঙা ঠোঁটে
শাহাদাতের বাণী আধো আধো বোলে॥
(কাজী নজরুল ইসলাম)

কে করবে তাঁর জন্মানুষ্ঠান? কে রাখবে তাঁর নাম? জন্মের পূর্বেই মারা গিয়েছেন পিতা আবদুল্লাহ্। এগিয়ে এলেন দিল দরিয়া পিতামহ দাদা আবদুল মুত্তালিব। ৭ দিনের মাথায় এতিম নাতির আকিকা করলেন মহা ধুমধামে। নাম রাখলেন মুহাম্মদ। আর মা আমিনা চাঁদের মত সুন্দর পিতৃহীন শিশুপুত্রের নাম দিলেন আহমদ।
সোয়ায়বা নামক দাসীমাতা অতি আদরে পান করালেন নিজের বুকের দুধ। মাত্র কিছু দিন পর নির্মল পল্লীবাসী ধাত্রী মা হালিমা সাদিয়া সানন্দে দায়িত্ব নিলেন ছোট্ট মুহাম্মদের লালন-পালনের। নিজপুত্র আবদুল্লাহ্ আর সায়মার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন শিশু নবীকে। মা হালিমার অভাবের সংসারে সৌভাগ্যের পরশমণি বুলিয়ে দিয়েছিলেন শিশু মুহাম্মদ। তাঁর বুকে নামল দুধের জোয়ার। উট-ভেড়ার পাল হলো সবল-সুঠাম, মাঠ-ঘাট ভরে গেল ফুল ও ফসলে। দুঃখিনীর সংসারে এলো সুখ ও সমৃদ্ধির প্রাণ-প্রাচুর্য।
শিশু নবীজি মা হালিমার দুধপানেও রাখলেন সাম্য-সমতা। ডান দুধটি খেতেন নিজে আর বাম দুধটি রেখে দিতেন অন্য ভাইয়ের জন্য।
মক্কার অদূরে ছায়াঢাকা, পাখি ডাকা, পাহাড়ি গ্রাম। বনু সা’দ বংশের শিশু-কিশোরদের সাথে বেড়ে ওঠেন নবীজি। মা হালিমার সন্তানরা পালিত ভাইকে অত্যন্ত আদর যত্ন করতো। তারা শিশু মুহাম্মদকে দোলনায় দুলিয়ে দুলিয়ে গাইতো:
বেঁচে থাকুক মুহাম্মদ- সে দীর্ঘজীবী হোক,
চির-তরুণ চির-কিশোর চির-মধুর রো’ক।
হয় যেন সে সরদার আর পায় যেন সে মান,
শত্রু তাহার ধ্বংস হউক- ঘুচুক অকল্যাণ।
মুহাম্মদের পানে খোদা করুণ চোখে চাও,
চিরস্থায়ী গৌরব যা- তাই তাহারে দাও।
(গোলাম মোস্তফা)

সমকালীন আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী ছিলেন বনু সা’দের লোকেরা। তিনি ছোট্ট বয়সেই তাদের কাছ থেকে শিখে নেন বিশুদ্ধ আরবি ভাষা। বড় হয়েও তাঁর ভাষায় ছিল না আঞ্চলিক ভাষার টান। সে জন্যই তিনি যখন বড় হয়ে লোকজনের সামনে বক্তব্য পেশ করতেন তখন লোকেরা তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রবণ করতেন। চারদিকে বিরাজ করত পিনপতন নীরবতা। মানুষ খুশি মনে তাঁর হাতে হাত রেখে কবুল করত ইসলাম।
শিশু নবীজি যেতেন দুধভাই আবদুল্লাহ ও বোন সায়মার সাথে মাঠে মেষ চরাতে। খেলতেন তাদের সাথে। যোগ দিত অন্য শিশুরা। ছেলে মেয়েরা যখন আনন্দের আতিশয্যে মাত্রাতিরিক্ত হাল-লাফ ও হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠতো, নবীজি তাতে অংশ না নিয়ে তখন দূরে দাঁড়িয়ে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, পশু-পাখি, সূর্য-চন্দ্রতারার সৃষ্টি রহস্য অনুধাবনের লক্ষ্যে ভাবুক হয়ে যেতেন। এ সময় একদিন ফেরশতাদের একটি দল এসে শিশু নবীজির সিনাচাক বা বক্ষ বিদারণ করে অলৌকিকভাবে তাঁর অন্তকরণ পরিষ্কার করে দিয়ে যান। পরিপূর্ণ করে দেন আল্লাহ্র নূরে।
সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে শিশু মুহাম্মদ আসেন মায়ের কোলে। তিনি তো তাঁর প্রিয়তম বাবাকে দেখেননি। নানার বাড়িতে যাওয়া হয়নি তাঁর। একদিন মা আমিনা পুত্র ও উম্মে আয়মান নামের এক দাসীকে সাথে নিয়ে স্বামী আবদুল্লাহ্র কবর জেয়ারতের উদ্দেশে ইয়াসরিবে (মদীনায়) গমন করেন। মদীনায় আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানোর পর ফেরার পথে স্বামী আবদুল্লাহ্র কবরের কাছে এসে পুত্রকে নিয়ে হাজির হন। আল্লাহ্র অপার মহিমায় সেখানেই কঠিন রোগে পীড়িত হয়ে মা আমিনা মৃত্যুবরণ করেন। দুঃখ-শোকে নবীজি একেবারে মূক হয়ে যান।
উম্মে আয়মান পিতৃমাতৃহীন মুহাম্মদকে সাথে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব বুকে টেনে নেন তাঁকে। কিন্তু এ সুখ তাঁর বেশি দিন সইল না। মারা গেলেন দাদা। এরপর কিশোর মুহাম্মদকে আগলে নিলেন চাচা আবু তালিব। আবু তালিবের অভাবের সংসারে নবীজি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে দিনাতিপাত করেন। চাচা নিজের অনেক ছেলে-মেয়ে থাকার পরও নবীজিকে বেশি ভালোবাসতেন। নবীজিও চাচার সমস্ত কাজে আগবাড়িয়ে সাহায্য করতেন। সংসারের টুকিটাকি কাজ ছাড়াও মাঠে মেষ চরাতেন।
একবার বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আবু তালিব সিরিয়া গমনের জন্য রওয়ানা হলে কিশোর নবীজি বায়না ধরলেন চাচার সাথে যাবার জন্য। চাচাও তাতে রাজি হয়ে মুহাম্মদকে সাথে নিলেন। সিরিয়ার পথে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন সামুদ জাতির ধ্বংসাবশেষ। তা দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে চাচার কাছ থেকে জানতে পারলেন যে আল্লাহ্র সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য সামুদ জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
এ কথা শুনে ভাবি নবী চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। এ সময় বহিরা নামে এক ইহুদি ধর্মজাযক আবু তালিবকে সাবধান করে বললেন, আলোকিত এই কিশোরের প্রতি নজর রোখো। তাঁর পিঠে আমি মোহরে নবুয়তের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। সে-ই তাওরাত, যবুর ও ইঞ্জিলে বর্ণিত আগামী দিনের পয়গম্বর।’
এরপর সামান্য কিছু ব্যবসা করেই আবু তালিব ভ্রাতুষ্পুত্রকে সাথে নিয়ে মক্কায় ফিরে এলেন। কিন্তু সে বার ব্যবসায় তিনি সবচেয়ে বেশি লাভবান হলেন। এটি অবশ্যই কিশোর নবীজির বরকতের গুণে।
হযরত মুহাম্মদের কিশোর বয়সে মক্কায় সংঘটিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম যুদ্ধ। যা ফুজ্জারের যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ। কোরাইশ ও কায়েস গোত্রের মধ্যে প্রথমে শুরু হলেও পরবর্তীতে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে কোরাইশদের পক্ষে চাচা আবু তালিবের সাথে তিনিও অংশ নেন। তিনি তলোয়ার পরিচালনা করতে পারেননি অল্প বয়সের কারণে; তবে তিনি তির ধনুক এগিয়ে দিয়ে তাদের সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু মানুষে মানুষে এই হানাহানি প্রত্যক্ষ করে বালক নবীজির অন্তর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায় তা তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে গঠন করলেন শান্তি সংঘ ‘হিলফুল ফুজুল’। সাথে শপথ নিলেন-
ক. আমরা দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখবো।
খ. বিনা কারণে কারো সাথে যুদ্ধে জড়াবো না।
গ. অনাথ-এতিমকে সাহায্য করবো।
ঘ. সন্ত্রাসীদের মক্কায় আশ্রয় দেবো না।
ঙ. হজ্বে আগত মুসাফিরদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করবো।
এ অল্প বয়সেই বালক মুহাম্মদ (সা.) মক্কাবাসীর নিকট আল-আমিন খেতাবে ভূষিত হলেন। যে কোন বিরোধ বাধলে লোকেরা তাঁর নিকট ছুটে আসতেন সদলবলে। তিনি সমাধান দিতেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে। সবাই ঘরে ফিরে যেত খুশি মনে। তেমনি এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবতারণা ঘটে নব সংস্কারকৃত কাবায় হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর পুনঃস্থাপন নিয়ে। কে তা প্রতিস্থাপন করবে এ নিয়েই চরম বিরোধ। শেষ পর্যন্ত নবীজি চার গোত্রের চার প্রধানকে রুমালের চার কোণ ধরে হাজরে আসওয়াদকে তুলে নিয়ে কাবার গায়ে স্থাপন করেন। মিটে যায় তাদের চরম রক্তক্ষয়ী বিরোধ।
‘এভাবে সত্য দিয়ে, সেবা দিয়ে ও চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে বালক নবী জাহেলি সমাজের অন্তর জয় করে নিয়েছিলেন। কবি তাই কত সুন্দর ভাবেই না বলেন:
আরব আকাশে-হয়েছে উদয় জাহানের শিশু চাঁদ,
এসেছে আলোক পুলকবন্যা ছুটিয়া গিয়েছে বাঁধ।
বুলবুলি গাহে বন্দনা তাঁর খেজুর শাখার পরে,
মরুর বাতাস তাঁর আগমনী জানাইছে ঘরে ঘরে।
নতুন দিনের বারতা বহিয়া এসেছে যে শিশু রবি
তাঁর জয়গান তাঁর বন্দনা গাহে শাশ্বত কবি,
ক্ষমা করো মোর শত অপরাধ শত ত্রুটি শত ভুল
সালাম নাও গো দীনের বাদশা মুহাম্মদ রাসূল।
[কাজী নজরুল ইসলাম]

Share.

মন্তব্য করুন