দার্জিলিং যাওয়ার পরিকল্পনা স্কুল জীবন থেকেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যলয় জীবন শেষ করেও আর হচ্ছিল না। কিন্তু এবার আর ছাড় নয়। সব সমস্যাকে চাক্কু চালিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম পাহাড়ি শহরটিতে। আর গিয়েই বুঝতে পেরেছি এতদিন দার্জিলিং না দেখে দৃষ্টি আমার কতটা গরীব ছিল।
ফেরার পর, সেখানে বরফ পড়ার খবর পেলাম। ছবিতেও দেখলাম। মনে হল, দার্জিলিংয়ের রূপ আরও খোলতাই হয়ে উঠেছে তাতে। একটু হাহুতাশ হচ্ছে এই বরফপতনের ছবি নিজ চোখে না দেখার জন্য। সেই সঙ্গে এটাও ভাবছি, ভালোই হয়েছে। কারণ বরফে সৌন্দর্যের চেয়ে বিঘœ বেশি। রাস্তা আটকে যায়, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়, পানির লাইনে বরফ জমে বিপর্যয় ঘটে ইত্যাদি। যদিও বলে দিতে হয় না, দার্জিলিং বরফের সাদা পোশাক ছাড়াও জমকালো। তার ম্যাল, ম্যালের দু’পাশের রাস্তার নজরানা, পাশ দিয়ে পুট করে নেমে যাওয়া ভুটিয়াবস্তির পথ। সেই পথে এগিয়ে যেতে যেতে মনাস্ট্রি। এই সবই…অপার এক মনোরমের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে সৃষ্টির সেই শুরু থেকে যেন। এমনকি যদি সাইটসিয়িংয়ে কোত্থাও নাও যান, তাও দার্জিলিং আপনাকে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের মানুষের সঙ্গে চুম্বনের আনন্দ এনে দেবে। অন্তরের রূপকে দেখতে পাবেন নখদর্পণে।
সেখানে আছে সাদা শুভ্র এক উচ্চতার টান। কাঞ্চনজঙ্ঘা যার নাম। ২৮ হাজার ১৫০ ফুট উঁচু। দার্জিলিং থেকে যার দূরত্ব ৫০ মাইল। উজ্জ্বল কাঞ্চনশৃঙ্গ। শুনেছি অনেকেই দার্জিলিংয়ে গিয়ে তাকে দেখতে পান না। মেঘের আড়ালে তিনি ঢাকা পড়ে গিয়ে ভাগ্যের আকাশে সহজে জাগরূক হন না মোটেই। আমি সেই দুর্ভাগ্যের শিকার হইনি মোটেই। যাওয়ার পর দিন হোটেলের বিশাল কাচের জানালা থেকে পর্দা টানতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দু’-হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। দার্জিলিংয়ের সৌন্দর্যের শাসক এই শৃঙ্গ। আমি এই শাসকের সামনে বার বার চোখ বুলেয়িছি। যেমন হোটেল থেকে, তেমনই কেভেন্টার্সের ছাদশূন্য খাদ্যালয়ে বসে। দার্জিলিং-টি এবং পোর্ক প্ল্যাটার খেতে খেতে তাকে দেখার যে আনন্দ, আমি ভোগ করে নিয়েছি। আহা! এত দিনে বোধ হয় আমার চোখ দুটো পৃথিবীর আসল আলোটাকে চিনতে পেরেছে!
দার্জিলিং এককালে ছিল সিকিমের অধীন। তারও আগে ছিল নেপালের হাতে। সিকিমের বড় অংশ জবরদখল করে রেখেছিল নেপাল। ব্রিটিশরা নেপাল দেশে সেনা পাঠায় দু’বার। ১৮১৬ সালে দ্বিতীয় বার সেনা পাঠানোর পর, তারা সাড়ে চার হাজার বর্গমাইল সিকিমকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশরা কিন্তু সিকিমকে দখল না করে স্বাধীন রাজ্যের স্বীকৃতি দিয়ে নিজেদের বশবর্তী করে রেখেছিল। সেই চুক্তি হয়েছিল ১৮১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, সেগৌলিতে। কিন্তু দার্জিলিং যে ব্রিটিশদের চাই। কারণ সেখানকার আবহাওয়া তাদের বড়ই আরামের মনে হয়েছে।
তো, শুরু হলো সিকিম রাজার সঙ্গে দার্জিলিংয়ের ফুল তোলার জন্য আলোচনা। রাজা সিকিমপুত্তির বয়স হয়েছে। তার উপর ইংরেজের শক্তির ঝঙ্কার রয়েছে। তবুও আলোচনা হলো দীর্ঘ। ইংরেজরা বলেছিল, দার্জিলিংয়ের বদলে সিকিমপুত্তি বিকল্প জমি নিন, না হয় বছর বছর টাকা গুনে নিন। তা, দ্বিতীয়টিতে রাজা রাজি হয়েছিলেন। ১৮৩৫ সালে বছরে তিন হাজার টাকা দেবার শর্তে ২৪ মাইল লম্বা এবং ৫-৬ মাইল চওড়া দার্জিলিং-ভূমি সিকিমের কাছ থেকে নিল ইংরেজরা। চুক্তিটি হয় ১৮৩৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।
দার্জিলিংয়ের মনোরম আবহাওয়ায় স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের। তাদের রাজধানী কলকাতা থেকে কাছাকাছি এমন একটা জায়গার দরকার হয়ে পড়েছিল, যেখানে লন্ডনের শীতলতা রয়েছে, কলকাতার পেঁচাপেঁচি গরম থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, দিনে মশা, রাতে মাছির উৎপাত থেকে মুক্তি রয়েছে। দার্জিলিং তাদের হাতের কাছে সেই আনন্দ-মাখা। ফলে একটা অজগ্রাম ধীরে ধীরে সুন্দরের লীলাভূমি হয়ে উঠল। ক্রমে জনবসতির স্রােত এসে আছড়ালও। তবে, এসব সহজে হয়নি মোটেই। সময়, শ্রম এবং বুদ্ধির মিশেল লেগেছে এর জন্য অনেক।
১৮৪০ সালের ৮ এপ্রিল। দার্জিলিংয়ে প্রথম হোটেলের খবর জানা গেল। কলকাতার খবরের কাগজে তার সূচনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল নিখুঁত। নাম দার্জিলিং হোটেল। কেক কাটা হলো হোটেলের উদ্বোধনে। রকমারি খাবারের স্রােতে হলো পার্টি। কিন্তু পথ তো অগম্য। যতই পাহাড় তার রূপের বিহ্বলতা সাজিয়ে বসে থাকুক না কেন, যাবেটা কে! সকল নিয়ে বসে থাকা দার্জিলিংয়ে ১৮৪০ সালের ১৪ মে পর্যন্ত গেলেন মাত্র একজন পর্যটক।
সেই পথ তৈরি হলো ক্রমে। রেললাইন পাতা হলো। নিউ জলপাইগুঁড়ি থেকে টয়ট্রেনও চালু হলো দার্জিলিংয়ে পাহাড়ের কোলে পৌঁছতে। ১৮৭৮ সালের ১৯ আগস্ট খবরের কাগজে ছাপা হলো টয়ট্রেনের প্রোপোজাল-সংবাদ। খরচ ধরা হয়েছিল মাইল পিছু তিন হাজার পাউন্ড। টয়ট্রেনের প্রথম ইঞ্জিন তৈরিও হলো। ১৮৭৮-এর শেষে, জামালপুর ওয়ার্কশপে, নাম-টাইনি। টয়ট্রেনের পথ তৈরির বরাত পেয়েছিল কলকাতার সি মিটেল অ্যান্ড রামসে কোম্পানি। ধাপে ধাপে টয়ট্রেনের কাজ হতে লাগল তার পর। ১৮৮১ সালের ৮ জুলাই ছোট রেলপথটি ঝিকঝিকিয়ে পৌঁছাল দার্জিলিং।
কিন্তু না, এখন আর কেউ টয়ট্রেনে দার্জিলিং যান না। চার চাকার জন্তুতে সওয়ার হয়ে পৌঁছন সেখানে। কিন্তু খেলনার চেয়ে কিছু বড় সেই ট্রেনে চেপে চারদিকের রূপসাগরে অরূপ পুষ্প চয়ন করে গলার হার গড়তে গড়তে দার্জিলিং যাওয়া, অনেকের লেখা পড়ে বুঝেছি, সব আলুথালু করে দেয়। তবে কড়কড়ে নোট দিয়ে পর্যটকের দল টয়ট্রেনে ঘুম পর্যন্ত জয়রাইড করেন। হতে পারে তা মাতৃদুগ্ধের বদলে ন্যান পান করার সামিল, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই যে! এখানে বলে নিই, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং পৌঁছতে টয়ট্রেনে যেতে হয় ৮৮ কিলোমিটার। সময় লাগে ৭ ঘণ্টা।
যতবার গিয়েছি দার্জিলিংয়ের সাথে আমার প্রেম বেড়েছে। তবে এ কথা সত্য টয়ট্রেনে যাওয়া হয়নি কখনো। দার্জিলিংয়ে গেলেই ম্যাল চত্বরে যাই শুরুতেই।
দার্জিলিং ম্যাল। বাঙালি পর্যটক তো বটেই, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছেও বড়ো আকর্ষণের জায়গা এই চত্বর। পাহাড়ের মাথায় একটুকরো সমতল। কংক্রিটে বাঁধানো। সেখানে ঘুরে বেড়ায় দুধেল সাদা ঘোড়া, রং-বেরঙের শীতিপোশাক পরা মানুষ। একঝাঁক পায়রা বসে রোদ পোহায়। ম্যালের দুই ধারে আদ্যিকালের সেই বেঞ্চি। অক্সফোর্ডের দোকান। সার বেঁধে কিউরিও শপ। ফোয়ারা। ম্যাল থেকেই রাস্তা বেঁকে গেছে মহাকাল মন্দির হয়ে রাজভবনের দিকে। এ পথেই দেখা মিলবে আকাশের গায়ে টাঙানো কাঞ্চনজঙ্ঘার। মাঝে ছাউনি দেওয়া বেঞ্চির সারি। দেখলেই মনে পড়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র দৃশ্য। ‘এ পরবাসে রবে কে’… সেই ম্যালই নতুনভাবে সেজে উঠছে ফের একবার।
অনেকবার সংস্কার করা হয়েছে ম্যাল চত্বর। এই দার্জিলিং ম্যালের প্রেমে একসময় বুঁদ ছিল সাহেবরাও। এতবারের সংস্কারেও সেই ইতিহাসের আমেজে কোনো আঁচড় পড়েনি।
মহামারী করোনাকাল বাদ দিলে বিগত কয়েক বছরে পর্যটকদের ঢল আরো বেড়েছে দার্জিলিংয়ে। ম্যালেও ভিড় থিকথিকে হয়েছে।
ম্যালকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। ম্যাল-লাগোয়া আস্তাবলকে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ হয়েছে। ম্যালের অন্যতম আকর্ষণ ঘোড়াদের বাস এখানেই। আপাতত খানিক দূরে অস্থায়ী বাসা হয়েছে তাদের। আস্তাবলের সামনের ফোয়ারাটিরও সংস্কার হয়েছে।
ঘুরতে ঘুরতে মাঝ-ম্যালের ডান দিকে, সরু পথ, নেমে যেতে হয়, নেমেই যেতে হয়, আরও নামতে হয়, নামতেই হয়। যেতে যেতে যেতে যেতে তার পর দেখা হয় একটা পুরোন মনাস্ট্রির সঙ্গে। হ্যাঁ, ভুটিয়াবস্তি মনাস্ট্রি একেই বলে।
শান্ত, নিস্তরঙ্গ মনাস্ট্রির রেলিং। দূরে, নিচুতে লেবং। উপরে কাঞ্চনজঙ্ঘা। দার্জিলিংয়ের শাসক মানে স্থানীয়রা। তুষারশুভ্র চূড়ার সাজ নিয়ে সে বলছে, নিচে কেন উপরে এসো ভাইটি, বাঁকে বাঁকে আমার রোমহর্ষক ঘুমিয়ে রয়েছে, তুমি জাগিয়ে তোলো, পথে পাহাড়ের পিঠে পিঠে কত ফুল ফুটে হয়ে রয়েছে চুপ, তুমি তুলে নাও। কুইন অফ হিলস সে। দার্জিলিংয়ের সব কিছু ভেদ করে উপরে উঠে গিয়েছে। রং এবং সফেদ এখানে মিলে গিয়ে শিহরিত।
দার্জিলিং, না এলে তোমাকে বোঝা যেত না, অপার হয়ে বসেছিলাম। মোহনীয় দার্জিলিং, আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে দিল। আবার দেখা হবে দার্জিলিং। অন্য কোনো গল্প নিয়ে।

Share.

মন্তব্য করুন