আজ সুফিয়ার পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। সে জিপিএ ফাইভ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েছে। এই জন্য তারচেয়ে অনেক বেশি খুশি তার বিধবা মা সাজেদা। সাজেদা বেগম জানেন না, জিপিএ ফাইভ কী? তিনি শুধু বুঝতে পারছেন, এটা পেলে তার মেয়ে সদরের সব চেয়ে ভালো কলেজটাতে পড়তে পারবে। একটা বড় চাকরি করতে পারবে। তার মৃত স্বামীর ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তাদের জীবনটা সুন্দর সম্মানের হতে পারবে। তাদের জীবনের ভালো অনেক কিছু হতে পারার একটা আশার আলো হচ্ছে এই জিপিএ ফাইভ। অনেক স্বপ্ন দেখেছে তারা তিনজনে এতদিন। আজ সেই স্বপ্ন যেন আশার আলো হয়ে ধরা দিয়েছে তাদের সামনে। এই পর্যন্ত আসার জন্য তারা মা মেয়ে কম তো কষ্ট করেনি। আজ সেই কষ্টের প্রথম ধাপটা ভালো ফল নিয়ে এসেছে। মেয়ে তাকে বলেছিল, মাধ্যমিকে যদি ভালো করতে পারে তাহলে পরের দুই তিনটাতেও ভালো ফলাফল করা সহজ হবে। এই জন্য তারা মা ছেলে রাতদিন আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। আল্লাহ দয়ার সাগর, তিনি তাঁর অসহায় বান্দার দুয়া কবুল করেছেন। এটা তো কম পাওয়া নয়! সাজেদা মনে মনে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। তিনি মেয়ের দিকে তাকালেন। সুফিয়া তার ভাইকে কিছু একটা বলছে। তার ভাই-বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সাজেদা মেয়েকে বললেন,
– মা, দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ে ল।
– একটু ফরে ফরুক না মা। সুফিয়া বইসে আমার কাসে, দুইডা কতা কইচে। আমার লগে তো আর সবসমে কতা কইতে সময় ফানা।
সুফিয়ার ভাই শফিক মন খারাপ করে বলল। সাজেদা পাটাতে পিষা শেষ চাল গুঁড়োগুলো চালনিতে তুলে শীলপাটা তুলে রাখলেন। বললেন,
– কিন্তুক ফরে তো দেরি হইয়ে যাইব।
– যা সুফিয়া। আম্মার কথা হুন। আগে নামাজ ফরি আয়।
– আইচ্ছা, ভাইয়া। আমি ফরে তোমারে দেখাইমুনে।
বলে সুফিয়া উঠে দাঁড়াল ভাইয়ের কথায়। শফিক মাথা ঝাঁকাল। সুফিয়া অজু করে নামাজে দাঁড়াতেই দরজায় কেউ শব্দ করতে শুরু করল। শফিক গলা বাড়িয়ে বলল,
– কে?
– হুজুর, আমি।
– তমাল এক মিনিট, একটু দাঁড়াও।
– আচ্ছা।
সুফিয়া নামাজ শেষ করে দরজার দিকে আসতেই দেখল, শফিক দরজা খুলেছে। তমাল ঘরে প্রবেশ করে সালাম দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল। শফিক তমালকে আরবি পড়ায় বিকাল বেলা। সুফিয়া ভাইকে কিছু না বলে মায়ের কাছে গেল। রান্নাঘরে যেয়ে দেখল মা পিঠা বানাচ্ছেন। সে বলল,
– আম্মা, আপনারে কামে সাহায্য করুম?
– নারে মা, এহন তোর কিসু করা লাগব না। তুই যা, আস্তে ধীরে বোরকা গায়ে দিয়ে ল।
– আম্মা, ঐ বাড়িত যাইতে আমার লজ্জা করে।
সুফিয়া নরম, নিচু গলায় বলল। সাজেদা মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বললেন,
– ঐ বাড়িতে তো আইজ বেশি করেই যাওন উসিত। তুই মেডাম খালাম্মার মান রাখতে পারসোস।
– হেঁ আম্মা, তুমি ঠিক কইসো।
– তাইলে যা, তৈইয়ার হ। আমার কাম শেষ।
সুফিয়া চলে গেলে সাজেদা ভাবতে লাগলেন, সেই দিনের কথা। সুফিয়া ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে প্রথম হয়ে সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছে। আর আনিস সাহেবের ছোট শ্যালিকা মিলি সাধারণ পাস করেছে। সুফিয়া আর মিলি দুই জনেই পড়ত আনিস সাহেবের বাবার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে। সুফিয়ার এত ভালো ফলাফল আনিস সাহেবের স্ত্রী মানতে পারেননি। এই জন্য তিনি আনিস সাহেবের মাধ্যমে চেয়েছিলেন, সুফিয়ার পড়াশোনা বন্ধ করে কোন কাজে লাগিয়ে দিতে। কিন্তু আনিস সাহেবের মা তা হতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, “সুফিয়ার বাবা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমাদের পেট্রোলপাম্পের ম্যানেজার ছিল। তারপর থেকে ওর মা আমাদের রান্নার কাজ করে। আমাদের উপর তো এমনিতেই ওদের অধিকার আছে। অন্যদিকে মেধা থাকার পরেও সুফিয়ার ভাইটা পড়তে পারেনি। এখন মেয়েটাকে যদি আমরা পড়তে না দিই, এটা অন্যায় হবে। আল্লাহ নারাজ হবেন। আর যদি সহযোগিতা করি, তাহলে তা দ্বীন-দুনিয়ার জন্য আমাদেরই ভালো হবে।” তারপর থেকে সুফিয়া আর কখনও পড়ালেখার বাধা আসেনি। কিন্তু আর পরীক্ষায় প্রথম হয়নি, তবে পড়াশোনাটা করতে পেরেছে। আনিস সাহেবের মা সব সময় খোঁজ নিয়েছেন। জাকাতের টাকা ছাড়াও মাঝে মাঝে জামাকাপড় এবং এটা সেটা দিয়ে সহযোগিতা করেন। যার চেষ্টায় তার মেয়ে পড়াশোনা করার সুযোগটা পেয়েছে, এই খুশির খবরটা সেই মেডাম খালাম্মাকে জানানো দরকার। সাজেদা জানেন, খুশির খবরে মিষ্টি নিয়ে যায় শিক্ষিত সচ্ছল সমাজের মানুষেরা। সেই খুশিতে তিনি তার মালিকের বাড়ি পিঠা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বোরকা পরতে পরতে শফিককে উদ্দেশ্য করে গলা বাড়িয়ে বললেন,
– শফিক আমরা আনিস সাবের বাড়িতে যাইতেছি। থালাতে পিঠা রেখে যাইতাছি, তোর ফরানো শেষ হইলে তমাল মিলা খাইয়া লইস।
– কী, সুফিয়াও যাইতাসে আম্মা?
– ওরে লইয়াই তো যাইতাছি। মেহমান না থাকলে, আমার কাম তো সকাল থেইকা দুপুর পর্যন্ত। অহন তো আমার কাম নাই। আনিস সাবের মায়রে সেলাম করে আসা লাগব। আইজ অনার অবদানে সুফিয়া এই ফল পাইছে। এইটা ভুলন যাইব না।
– না আম্মা, তুমি চিইন্তা কইর না। তোমার মাইয়া এত অকৃতজ্ঞ হইব না।
শফিক বলল। সুফিয়া হেসে ভাইকে সমর্থন করে বলল,
– আমি কৃতজ্ঞ থাকুম আম্মা। আমি মেডাম নানীর লাইগা দুয়া করি।
সাজেদা ছেলের সামনে পিঠার থালা রেখে, মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।
তমাল পড়া শেষে পিঠা খেল না, কাগজ মুড়িয়ে পিঠা নিলো। তারপর সে দ্রুত চলে গেল। আজ তার বাবা আসবে বিদেশ থেকে। মসজিদে আসরের আজান হচ্ছে। তমাল চলে গেলে শফিক দরজা বন্ধ করে অজু করে নামাজ পড়ে নিলো।
আজ সারাদিন খুশি ছিল শফিক। কিন্তু এখন ওর মন খারাপ লাগছে। সে দশ, এগারো বছর বয়স থেকে প্রায় প্রতিদিন একা থাকে। সারাদিন কুরআন পড়া নিয়েই থাকে সে। এর ফাঁকে কয়েকটা ছেলেকে আরবি পড়ায়, মাকে তরকারি কুটে দেয়, চাল-ডাল বেছে দেয় আর আপন মনে জিকির করতে থাকে। মা বোন যখন চলে যায়, সারা বাড়িতে সে তখন একা থাকে। মাঝে মাঝে উঠানে বের হয় সে। মায়ের পালা হাঁস-মুরগি দেখে, গাছ দেখে, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ উপভোগ করে। আর মন খারাপ হলে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকে। নিরাশ চোখে তাকিয়ে থাকে তাদের জরাজীর্ণ ভাঙা জানালার বাইরের দুনিয়ার খোলা আকাশের দিকে।
শফিকের জন্ম থেকে একটা পা নেই। এই অক্ষমতা ছাড়া সে আর সব দিকেই খুবই সক্ষম একজন মানুষ। খুব কম বয়সে সে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। সব সময়ই পরীক্ষায় প্রথম হতো। পঞ্চম শ্রেণীতে মেধাবৃত্তি পেয়েছিল সে। তারপর সপ্তম শ্রেণীতে যখন পড়ে তখন একটা দুর্ঘটনা ওর পড়ালেখাটা থামিয়ে দেয়। তাদের বিদ্যালয়ে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্য ফুটবল অনুশীলন হচ্ছিল সেদিন। সে মাঠের এক পাশে বেঞ্চে বসে খেলা দেখছিল অন্যান্য ছেলেদের সাথে। হঠাৎ বলটা শফিকের পায়ের কাছে আসে। সে বলটাকে তার পা দিয়ে মাঠে ফিরিয়ে দেয়। সেদিন খেলা শেষে সাব্বির তাকে শাসিয়ে বলেছিল, ‘একপায়া, তুই আমার বল ল্যাং মেরেছিস, একদিন আমিও তোকে ল্যাং মারব দেখিস।’ সাব্বির ছিল তার বয়সে বড়, শরীর স্বাস্থ্যে ভালো। সব সময় তাকে দিয়ে ‘বাড়ির কাজ’ করাতে চাইত। শফিক প্রথম প্রথম করে দিলেও পরে এটা অন্যায় বুঝতে পেরে আর করে দিত না। এই কারণেই সাব্বির শফিককে অপছন্দ করত। সাব্বির তার নাম দিয়েছিল “একপায়া”। ওরা কয়েকজন তাকে একপায়া ডাকলেও বেশির ভাগ ছাত্র শফিককে পছন্দ করত। একদিন ঠিক সাব্বির সুযোগ বুঝে মাঝ সিঁড়িতে তাকে ল্যাং মারে। শফিক ভারসাম্য রাখতে পারেনি, পড়ে গিয়ে তার একটা মাত্র পা ভেঙে যায়। অনেক দিন সে বিছানায় পড়ে ছিল। তার বাবা তাকে নিয়ে হাসপাতাল আর বাড়ি অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছেন। এর মধ্যেই একদিন হঠাৎ তার বাবা মারা গেলেন। সুফিয়া তখনো ছোট, চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তাদের বৃদ্ধ দাদা কুরআনের হাফিজ ছিলেন। তিনি মসজিদে ইমামতি করতেন বলে তাদের সংসারটা অভাব অনটনে চলছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর দাদাও মারা গেলেন। তারপর সাজেদা বাধ্য হয়ে আনিস সাহেবদের বাড়িতে রাঁধুনির চাকরি নিলেন। শফিকের দাদী এবং আনিস সাহেবের মা দূরসম্পর্কে আত্মীয় হন। তিনি খুব দ্বীনদার একজন মানুষ। সেই সুবাদে সাজেদাকে তিনি অনেক আন্তরিকতা করেন। শফিক মনে মনে আফসোস করে, কত কিশোর ছেলে প্রয়োজনে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়, কিন্তু তার পায়ের অক্ষমতা তাকে অন্য দিকেও অক্ষম করে তুলেছে। তাদের ছোট দুই ভাইবোনকে বড় করতে তাদের বিধবা মাকে অন্য বাড়িতে কাজ করতে হয়। তার বয়সের কত পথশিশু কিশোর ভিক্ষার থালা হাতে ঘুরছে। আর সে খোঁড়ালুলা, একজন মাজুর হয়ে তার ছোট্ট এই বুকে মর্যাদাময় পবিত্র কুরআন ধারণ করার সৌভাগ্য অর্জিত হয়েছে। এটা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার রহমতে সম্ভব হয়েছে। একাকী ঘরে এসব কথা ভেবে শফিকের চোখ ভিজে যায়। সে চোখ মুছে দ্রুত কুরআন খুলে পড়তে থাকে। কুরআনের প্রতিটি অক্ষর তাকে প্রশান্তির পরশ দেয়, তার মন শান্ত হয়। তার পায়ের দুর্বলতা মুহূর্তে দূরে সরে যায় কুরআনের আলোতে। শফিকের মন কৃতজ্ঞ হয়ে উঠে তার স্রষ্টার দরবারে।

দীর্ঘদিন সময় নিয়ে ধীরে ধীরে শফিকের পা কিছুটা ভালো হলো। কিন্তু আগের মতো ভালো হলো না। এখন সে পুরোপুরি দুটি খাঁজের যষ্টির উপর নির্ভর করে চলে, আগে দরকার হতো একটি। শফিক তার পড়ে গিয়ে পা ভাঙার কারণ কাউকে বলেনি। কিন্তু সে যতদিন বাঁচবে, সাব্বিরের সেই অন্যায় আচরণ কখনো ভুলবে না। এই দুর্ঘটনার জন্য তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা হয়নি। তবে সুফিয়ার বইগুলো সে সব পড়ছে। সুফিয়া বলছে, সে শফিকের নাম রেজিস্ট্রি করিয়ে দিবে, প্রাইভেটে এসএসসি পরীক্ষা দিবে। দাদা বেঁচে থাকতে তাকে কুরআন হিফজ করাচ্ছিলেন। আঠারো পারা পর্যন্ত সে মুখস্থ করেছে তার দাদার তত্ত্বাবধানে। তার দাদার খুব ইচ্ছা ছিল, সে তার দাদার স্থলাভিষিক্ত হয়ে মসজিদে ইমামতি করবে। সেটাও আর হলো না। সে শুধু কয়েকটা ছেলেকে কুরআন পড়ায়। এখন সে পুরো কুরআনের হাফিজ। কিন্তু একজন কারিকে দিয়ে যে তার পড়া যাচাই করে নিবে, বা কুরআন শিক্ষকতার জন্য ইযাযা প্রাপ্ত হবে, সেই সুযোগ এখনো তার হয়নি।
মাগরিবের সময় সাজেদা মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। জানালেন, ম্যাডাম খালাম্মা বলেছে, আগামী মাস থেকে শফিক তাদের মসজিদে বাচ্চাদেরকে কুরআন শিক্ষা করাবে এবং এই জন্য তাকে আপাতত পাঁচ হাজার টাকা করে বেতন দিবে, এবং রিকশা ভ্যান ভাড়া বাবদ আসা যাওয়ার জন্য আরো দুই হাজার টাকা দিবে। তার আগে সে কুরআন তিলাওয়াত এবং শিক্ষকতার জন্য পরীক্ষা দিবে, সেই ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছেন। মা বোনের কাছে, এই খবর শুনে শফিককে কাঁদতে শুরু করেছে। সাজেদা তা দেখে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কী হইছে বাবা? চাকরির কথা শুনে ভয় লাগছে?
– না, আম্মা। খুশি লাইগছে। দেখস আম্মা, আল্লাহ কেমন কইরে দাদা আশা আমার আশা ফুরণ কইরে দিলেন! আল্লাহ কত রহমান! আলহামদুলিল্লাহ।
– আলহামদুলিল্লাহ!
সাজেদা এবং সুফিয়া সমস্বরে শফিকের মতো কৃতজ্ঞচিত্তে বলল। শফিকের খুশিতে তার মা বোনের চোখেও পানি এসে গেছে। সুফিয়া চোখ মুছে বলল,
– ভাইয়া আরো একখান খবর আছে। তুমি আগামী বার এসএসসি ফরিক্ষা দিতে পাইরবা। অহন থেইকা ফড়ালেখায় লাগি যাও।
– ইন শা আল্লাহ। অহন মাগরিবের নামাজ ফরি আগে।
– আমরাও ফড়ব। জামাতে। তুমি ইমামতি কইরবা। রোজার সময়ের মতো।
– আইচ্ছা, অজু করে আয়।
মা বোনকে নিয়ে শফিক নামাজের উদ্দেশে তার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াল কৃতজ্ঞচিত্তে।

Share.

মন্তব্য করুন