অনেক বছর ধরেই খুব বাজে পারফর্ম করার পর আবার জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সুদিন আসার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেট বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। যে কারণে জাতীয় দলের পাইপলাইনে আছে অনেক নতুন ক্রিকেটার। দেশটির জাতীয় দল গত এক দশকের হতাশা কাটিয়ে আবার সুদিন দেখতে শুরু করেছে। আর এই প্রক্রিয়ায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট যাদের হাত ধরে বদলে যেতে শুরু করেছে তাদের একজন সিকান্দার রাজা। এই অলরাউন্ডার এখন দলটির সবচেয়ে বড় তারকাও।
আগস্টে বাংলাদেশ দল জিম্বাবুয়ে সফর করেছিলো। সেখানে বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন এই অলরাউন্ডার। ব্যাটে-বলে দু’ভাবেই তিনি অবদান রেখেছেন জিম্বাবুয়েকে জেতাতে। ওয়ানডে সিরিজে সর্বোচ্চ ২৫২ রান করার পাশাপাশি নিয়েছেন ৫ উইকেট (৩ ম্যাচে)। টি-টোয়েন্টি সিরিজেও তার ব্যাট থেকে এসেছে সর্বোচ্চ ১২৭ রান, পাশাপাশি দুটি উইকেট নিয়েছেন। দুই ফরম্যাটেই সিরিজ সেরার পুরস্কার উঠেছে তার হাতে।
জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে এই মূহুর্তে যে কজন নিয়মিত পারফর্মার আছেন, তার একজন সিকান্দার। অথচ তার জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলার কথাই তো ছিল না! কারণ সিকান্দারের জন্ম দেশটি থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের দেশ পাকিস্তানে।
১৯৮৬ সালে শিয়ালকোট শহরে এক কাশ্মিরী পরিবারে জন্ম তার। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিলো বিমান বাহিনীর পাইলট হবেন। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একাডেমিতে সুযোগও পেয়েছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। তিন বছর প্রশিক্ষণ নেয়ার পর দৃষ্টিশক্তি বিষয়ক টেস্টে ত্রুটি ধরা পড়ে। যে কারণে পাইলট হওয়ার আশা ছাড়তে হয় তাকে।
২০০২ সালে পরিবারের সাথে জিম্বাবুয়ে পাড়ি জমান সিকান্দার রাজা। পাকিস্তানেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়েছিল তার, সেটাকেই টেনে নিয়ে যান জিম্বাবুয়েতে। তবে এর মধ্যে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার জন্য সুযোগ পান স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। পরিবার জিম্বাবুয়েতে থাকলেও রাজা চলে যান স্কটল্যান্ডে। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলতে থাকেন ক্রিকেট। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে জিম্বাবুয়েতে ফিরে আর চাকরি খোঁজেননি, সোজা ক্রিকেট মাঠে চলে যান। সেটা ছিলো ২০০৯ সাল।
অল্প দিনেই জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটে নাম করতে শুরু করেন রাজা। নজরকাড়া কয়েকটি ইনিংস খেলে নির্বাচকদের নজরে চলে আসেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচে দারুণ ব্যাটিং করেন। সেটাই মূলত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার সম্ভাবনা জানান দেয়। ২০১১ সালের বিশ^কাপের জন্য তাকে বিবেচনা করেন নির্বাচকরা; কিন্তু বাধা হয়ে দাড়ায় আইনি জটিলতা। মানে তখনো পর্যন্ত জিম্বাবুয়ের নাগরিকত্ব পাননি সিকান্দার। যে কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন তার পিছিয়ে যায়।
নাগরিকত্ব লাভের পর ২০১৩ সালের মে মাসে বুলাওয়েতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে জিম্বাবুয়ের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন সিকান্দার। একই বছর টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলারও সুযোগ হয়।
শুরু থেকেই ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতার পরিচয় দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন জিম্বাবুয়ের টপ অর্ডারের ভরসা। টেস্টে প্রথম ইনিংসেই পেয়েছেন হাফ সেঞ্চুরি, আর ওয়ানডেতে চতুর্থ ইনিংসে। পরের বছর (২০১৪) জুলাইয়ে ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হ্যামিলটন মাসাকাদজার সাথে জুটি বেধে ইনিংস ওপেন করতে নেমে গড়েন ২২৪ রানের পার্টনারশিপ। যেটি জিম্বাবুয়ের হয়ে যেকোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপ। ম্যাচটি ছিলো সিকান্দার রাজার ক্যারিয়ারের দশম ওয়ানডে। সেদিন তিনি ১৩৩ বলে খেলেন ১৪১ রানের ম্যাচ জয়ী ইনিংস।
আর টেস্টে প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছেন ২০১৭ সালে কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। সেই সফরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে জয় এনে দেন সিকান্দার। হাম্বানটোটায় সিরিজ নির্ধারনী পঞ্চম ওয়ানডেতে বল হাতে ২১ রানে ৩ উইকেট নেয়ার পর ব্যাট হাতে অপরাজিত ২৭ রানের ইনিংস খেলে সিরিজ জয় নিশ্চিত করেন। সেটা ছিলো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের প্রথম সিরিজ জয় এবং ৮ বছর পর দেশের বাইরে প্রথম সিরিজ জয়।
এভাবেই ব্যাট ও বল হাতে জিম্বাবুয়েকে স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন সিকান্দার। ২০১৮ সালে ওয়ানডে বিশ^কাপের বাছাই পর্বে সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন তিনি। জিম্বাবুয়ে বাছাই পর্ব পার হতে না পারলেও ব্যক্তিগতভাবে ব্যাট হাতে ৩১৯ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ১৫ উইকেট।
ব্যাট-বল দুভাবেই দলের জন্য অবদান রাখতে পারায় বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে ফ্রাঞ্চাইজি লিগে কদর আছে তার। বিপিএলে খেলেছেন চট্টগ্রাম ও খুলনা দলের হয়ে। পিএসএলে খেলেছেন পেশোয়ার জালমি ও করাচি কিংসের হয়ে। খেলেছেন ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও খেলেছেন কয়েক মৌসুম।
জিম্বাবুয়ের মতো দলের হয়ে খেলার কারণে বছরে খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ হয় না সিকান্দার রাজার। তবু ছোট্ট ক্যারিয়ারটা রাঙিয়ে চলছেন। ১৭ টেস্টে ৩৬ গড়ে করেছেন ১ হাজার ১৮৭ রান, উইকেট ৩৪টি। ১১৭ ওয়ানডেতে ৩৭ গড়ে রান প্রায় সাড়ে তিন হাজার, উইকেট ৬৮টি। ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি আছে ৫টি, টেস্টে ১টি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও ২৮টি উইকেট নেয়ার পাশাপাশি এক হাজারের বেশি রান করেছেন।

Share.

মন্তব্য করুন