প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বঙ্গোপসাগরের কূলে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজার। দূর থেকে দেখে মনে হবে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে সাগরের সীমাহীন জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে রাঙা রাজকন্যা। আবার সাগরসৈকতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সাগরের বিপুল জলরাশি দু’হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েছে নীলাকাশ। সাগরের এই বিশালতা আর আকাশের শূন্যতার অপরূপ মিতালি দেখে মানুষের মন মুগ্ধ হতে বাধ্য।
১৭৯৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স সাহেব আরাকান (বর্তমানে বার্মা) থেকে পালিয়ে আসা লক্ষাধিক উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়ে এই অঞ্চলে আসেন, এবং বর্তমানে রামু উপজেলায় তার দফতর স্থাপন করে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেন। আরাকানি শরণার্থীদের পুনর্বাসন করার পরে বাঁকখালী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় তিনি একটি বাজার স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে বাজারটি কক্স সাহেবের বাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে আসার ছয় মাসের মধ্যে তিনি ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরবর্তীতে বাজারটি কক্স সাহেবের বাজার থেকে কক্সবাজার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্বে এই শহরের আরও অনেক নাম ছিল যেমন, পালংকি, প্যানোয়া ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ মনে করেন কক্সবাজারের প্রাচীন নাম ছিল ‘অং শেং থা ম্রো’।
বার্মিজ শব্দ ‘অং শেং থা ম্রো’ অর্থ সমৃদ্ধিময় শান্তির শহর। বর্তমানে কক্সবাজার পর্যটন নগরী ও বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী হিসেবে পরিচিত।
অথৈ সাগরের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় বলে এই এলাকার মানুষ অসীম সাহসী। জীবন বাজি রেখে জেলেরা সাগর থেকে ধরে আনে হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ, রূপচাঁদা এবং রূপালি ইলিশ। সাগর যেমন দুই হাত ভরে দেয়, আবার মাঝে মাঝে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নিয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু প্রকৃতির ধ্বংসলীলা শেষে আবার মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। বর্ষাকালে সাগর থাকে উত্তাল; বিশাল বিশাল ঢেউগুলো ভয়ানক ফণা তুলে ভীষণ আক্রোশে কূলে এসে আছড়ে পড়ে। অথচ শীতকালে এই একই সাগর যেন শান্ত-সুবোধ বালকের মতো; ছোট ছোট ঢেউ নিঃশব্দে আমাদের স্বাগত জানায়।

কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত। মহেশখালী দ্বীপের মিষ্টি পান খুবই বিখ্যাত। কক্সবাজারের শেষ প্রান্ত টেকনাফ ছাড়িয়ে সুনীল সাগরের মাঝে একফালি সবুজ বাগিচার মতো নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতার দারুচিনি দ্বীপ। যদিও আরও একটি নাম আছে সেন্টমার্টিন দ্বীপের, সেটা হলো নারিকেল জিঞ্জিরা। সমগ্র শীতের মৌসুম জুড়ে টেকনাফ এবং কক্সবাজার থেকে জাহাজে করে মানুষ সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঘুরতে যায়।
কক্সবাজার জেলার অর্থনীতি পর্যটন শিল্পনির্ভর; যেহেতু এটা পর্যটন নগরী। বিদেশ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক কক্সবাজার ঘুরতে আসে। সব সময় এই শহরে উৎসবের আমেজ লেগে থাকে, তাই কক্সবাজার শহরকে আনন্দ নগরীও বলা যায়। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ প্রতিদিনের নাগরিক কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে কিছু সময়ের জন্য কক্সবাজারে এসে পাহাড়, প্রকৃতি এবং সাগরের অপরূপ মিতালির কাছে নিজেকে হারিয়ে জীবনের আনন্দ খুঁজে পায়। সাগরসৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করা এক কথায় অসাধারণ ও ভাষায় প্রকাশের অতীত।

সর্বোপরি একটা কথাই বলা যায়, কক্সবাজারে পর্যটকরা বেড়াতে এসে আকাশ, পাহাড় ও সাগরের শূন্যতার কাছ থেকে প্রকৃতির আশীর্বাদ এবং জীবনীশক্তি সংগ্রহ করে আপন ঠিকানায় ফিরে যায়। আর পাহাড়ের বিশালতা, নীলাকাশ ও সাগরের শূন্যতা জেগে থাকে নতুন দিনের অপেক্ষায়, নতুন প্রাণের আশায়। তাই মনে হয়, প্রকৃতির নিজ হাতে লেখা মায়াবী কবিতা যেন কক্সবাজার।

Share.

মন্তব্য করুন