বন্যা আর ঢলের খামখেয়ালিতে মেতে ছিল বর্ষা। মেঘে মেঘে ঢাকা ছিল আকাশ। ছিল সাদাকালো মেঘের ঘনঘটা। ছিল বৃষ্টি বাদলের সুর। সেই মেঘ আগের মতো নেই। তারও অবসান হলো। তবে মাক্সের মতো শরতের মুখে মেঘ ভেসে ওঠে। কখনও দেখি মেঘের ফাকে নীলের দারুণ দৃষ্টি। এই দৃষ্টি সৃষ্টি করে মনের মুগ্ধতা! শুধু চেয়েই থাকি। এই দেখা যেন শেষ হয় না! তখনই বুঝি শরৎ চুপে চুপে এসেছে। তাই বলতে বাধ্য হই-
শরৎ আসে চুপে চুপে
মেঘলা নীলের বেশে
শিউলী কিংবা কাশ ও কুশের
সবুজ বাংলাদেশে।
কাশফুল তো সবাই চিনি! কিন্তু কুশ কী? কুশ হলো পাহাড়ী ফুল। নদীর কুল বা সমতলে কাশফুল শিউলি ফুটবে- এটা কী পাহাড় মেনে নিতে পারে! কক্ষোনও না। তাই শরতের হাসি ও উচ্ছ্বাস পেতে পাহাড়ে ফোটে কুশ ফুল। শরৎ আসলেই মায়াবী ঋতু! সব জায়গায় সবাই যথেষ্ট আনন্দে রাখে।
শরতের প্রকৃতি বড়ই বৈচিত্রময়। এই রোদ এই বৃষ্টি হলেও রোদের দখল বেশি। অধিকাংশ সময় সারা আকাশময় সাদা মেঘপুঞ্জ ঘুরে-উড়ে। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়। তখনই বিশ্রামে যেতে বৃষ্টির সাহায্য চায়। বৃষ্টি শান্তি দিতে নেমে পড়ে। তখন বৃষ্টির ফোটাগুলো হয় বড়ই বিচিত্র রকমের। চিকন চিকন সেমাইয়ের মত। দাদুর চুলের মতো চিকন । চঞ্চল মন নেচে ওঠে শরতের স্পর্শে। আর এই চঞ্চলতার কারণে শ্রেষ্ট কবিরাও থেমে থাকতে পারেনি। যেমন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি
ভাদ্র ও আশ্বিন মাস মিলে শরৎ। বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু। শরৎকে ইংরেজিতে “অটাম” বললেও উত্তর আমেরিকায় একে “ফল” হিসেবে ডাকা হয়। পৃথিবীর ৪টি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎ। উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎকাল দেখা যায়।
শরতের স্থব্ধতা ঘুমপাড়ানি গানের মতো। নীরব, শান্ত ও মধুর। তখন নদীতে হাওরে ছোটো ছোটো নৌকা ভাসে। আগে ছিল পালতোলা নৌকা। এখন সেখানে এসেছে ছোটো ইঞ্জিনের ছোট নৌকা।
নীল আকাশ কখনও যেন নেমে যায় নদী বা হাওরের দিগন্তে। শাপলা, কলমি আর জলজ ফুলের হাসি যেন আকাশে মেশে যায়! নদীর পাড়ের কাশ ফুলও যেন আকাশে হেলান দেয়! এমন একটি নান্দনিক দৃশ্য দেখার জন্য সব সময়ই অপেক্ষায় থাকে মন। নদী কিংবা জলার ধারে ফোটে কাশ, পাহাড়ে কুশ, ঘরের আঙিনায় শিউলি বা শেফালি, খাল-বিল-ঝিল-পুকুর-ডোবায় শাপলা-শালুক-পদ্ম, চাঁদোয়া বা জিনারি আর অসংখ্য জলজ ফুল।
শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা- এইসব মিলেই শরৎ। জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরতের সৌন্দর্য। শরৎ সত্যিই মধুর।
কাশফুল দেখে ছোট বড় সবাই পাগল হয়। এখন ফেসবুকরে যুগ। এই জন্যে আরো বেশি আবেগী হয়ে কাশের কাছে মনের আনন্দে ছবি তুলে। তবে খুব বেশি আনন্দ পায় শিশু কিশোরেরা। তারা কাশফুল ছিড়ে তার রেণু আকাশে উড়ায়। সেই উড়ানোর তালে তারা আকাশের দিকেও লাফ দেয়। যেন আকাশ ছুঁয়ে বড় হতে চায় তারা। শুধু কী কাশ দেখে আনন্দ করে। শিউলী দেখেও তারা খুশিতে মেতে ওঠে। দল বেঁধে নামে শিউলি ফুল কুড়োতে। আর পাল্লা দিয়ে চলে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা। তাই তো! শরতের শিউলী ফুল নিয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন-
‘শিউলী ফুলের মালা দোলে
শারদ রাতের বুকে ঐ…’

এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব দৃশ্য দেখা যায়। দেখা যায় মালা গাঁথা। কিন্তু শহর বা গঞ্জ ঘেষা প্রায় গ্রামের শিশুরা মোবাইল নিয়ে গেম কার্টুনে ব্যস্ত। রবীন্দ্রনাথও নানাভাবে নানা প্রসঙ্গে অন্তত একুশ বার শিউলির কথা বলেছেন। শিউলির মালা দিয়ে ঘর সাজানো যায়। আবার শিউলি ফুলের মালা খোঁপায়ও পরা যায়। প্রাচীনকালে এর বোঁটার রং পায়েস বা মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। হিন্দুদের পূজার উপকরণ হিসেবেও শিউলি ফুলের অনেক কদর।
শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার হয়। মূল ব্যবহার হয় ঔষধি হিসেবে। এর বেশ কিছু ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন- পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। শরীরের রঙ হয়ে উঠে দিনদিন শুভ্র। এছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যাবহৃত হয়।
কাশফুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক নাম হল ঝধপপযধৎঁস ংঢ়ড়হঃধহবঁস. এরা ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ। চিরল পাতার দু’ধারে খুবই ধার। পালকের মতো নরম এর সাদা ফুল।
শরৎ মানে কেবল কাশফুলের ছন্দ-তাল না, শরৎ মানে রসে টইটম্বুর পাকা তাল! আম-কাঁঠালের মিষ্টির ঘ্রাণ শেষ হতে না হতেই তালের ঘ্রাণ। তালের পিঠার গন্ধে ভরে যায় গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘর। পুকুরপাড়ের লম্বা লম্বা একপায়ে দাঁড়ানো তালগাছগুলো থেকে তাল পড়ে। শিশু-কিশোরদেরকে এসব তাল কুড়িয়ে নিতে দেখা যায়। অবশ্য এই দৃশ্যটা আগের চেয়ে এখন অনকে কম।
শরৎ উৎসবের ঋতু। শারদ পূজার প্রধান উপকরণ পদ্ম ফোটে শরতে। কোথাও কোথাও বড় আকারের শতদল পদ্মও আছে। ইদানীং শ্বেতপদ্ম বেশ দুর্লভ হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিকভাবে খুব কম স্থানেই বেঁচে আছে ফুলটি। পদ্ম আমাদের জলাভূমির রানি।
জলজ ফুল মাখনাও শরতেই বেশি দেখা যায়। শরতের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্থলপদ্ম ফুটতে শুরু করে। শরতের সকালে সূর্যের প্রথম আলোয় অপরূপ হয়ে ওঠে স্থলপদ্ম। এমন দিনেই নতুন রং আর রূপের পসরা সাজিয়ে বসে ধাইরা ফুল। সাধারণত পুরোনো বৃক্ষগুলোতেই পরজীবী এই ফুলের শোভা উপভোগ করা যায়। এ সময় দই গোটার ফুলগুলোও ফুটতে শুরু করে। শরতের শেষভাগে ফোটে চা-ফুল। চা-বাগানের অনুচ্চ টিলাগুলোয় খইয়ের মতো শুভ্রতা ছড়ায় এ ফুল। আর চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষের মেডলাগাছেও শরতেই ফুল আসতে শুরু করে। সাদাটে এই ফুল এখন নগর উদ্যানেও দেখা যায়।
ডোল কলমি সারা বছর কমবেশি ফুটলেও শরৎকালেই বেশি দেখা যায় এই ফুল। আমাদের পথের ধারে, ঝোপ-জঙ্গলের পাশে সহজেই চোখে পড়ে। সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও বলিভিয়ার পাহাড়ি এলাকার ফুল। পর্তুগিজ ধর্মযাজকেরা ভারতে নিয়ে আসেন গির্জার বাগানের সৌন্দর্য বাড়াতে। তারপর ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। শরতের রাতও দারুণ ভাল্লাগে। অসংখ্য তারার সাথে চাঁদ খেলা করে। কখনও চাঁদ হয় তারাদের মধ্যমণি। এই আনন্দে চাঁদও জোছনা দিতে কখনই কার্পন্য করে না! সংক্ষেপে বলতে চাই-
তারার সাথে চাঁদের খেলা
শরৎ রাতের গানে
মেঘের সাথে বায়ুর খেলা
জোছনার আয়োজনে।

Share.

মন্তব্য করুন