সেই প্রাচীনকালের কথা। মানুষ তখন কথা বলতে পারতো না। ঘর-বাড়ি বানাতে পারতো না। পড়ালেখা করার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ সে সময় আজকের মতো কোনো বই-পুস্তক ছিল না। তখনকার মানুষ আজকের মত জামা কাপড়ও পরতো না। কারণ ঐ সময় জামা কাপড় ছিল না। সে জন্য মানুষ গাছের ছাল, পাতা কিংবা পশুর চামড়া পরে থাকতো। কারণ তখনকার মানুষ পড়ালেখা করতে জানতো না বলে, সমাজ সংস্কৃতি বলে কিছু ছিল না তাদের। আমরা যেমন এখন অনেকে কিছু করতে পারি তখনকার মানুষ কিন্তু চাইলেও আমাদের মতো সব কিছু করতে পারতো না। আমাদের যেমন- দা, কুড়াল, চাকু, ছুরি, বঁটি অনেক কিছু আছে তখনকার সময় কিন্তু এ রকম কিছুই ছিল না। এ জন্য মানুষ ইচ্ছে করলেই কাটাকাটি করতে পারতো না। তখন মানুষ খণ্ড খণ্ড পাথর ঘষে ঘষে অস্ত্র বানাতো। সেই অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার করে মাংস খেয়ে বাঁচতো। আজকের মানুষদের মতো ধান চাষ, গম চাষ কিংবা ফলমূলের চাষের কিছুই জানতো না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তারা সুন্দর ছবি আঁকতে পারতো। আজকের মতো কাগজ, ক্যানভাস ছিল না বলে তারা পাহাড়ের গুহায় ভেতরের দেয়ালে বা গায়ে ছবি আঁকতো। সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতো। তাদের আঁকার বিষয় ছিল জীবজন্তু বা পশু। যেগুলো তারা শিকার করে মাংস খেত। যেমন- হরিণ, বাইসন ইত্যাদি। আর যারা পশু শিকার করতো, আঁকতো সেইসব মানুষের ছবিও। এই ছবি আঁকা হচ্ছে, আমরা যাকে সংস্কৃতি বলি তার একটি প্রধান অংশ। অনেকেই বলেন যে, যে দেশ সংস্কৃতি এবং শিল্পে যত সমৃদ্ধ সে দেশ তত বেশি উন্নত। এ বিষয়টা আমাদের দেশের শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্য যাতে শিশু বয়স থেকে সবাই ছবি আঁকা, গান, বাজনা, খেলাধুলা শিখতে পারে তার ব্যবস্থা করে গেছেন তিনি। তিনি শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু ঢাকায় নয়, জেলায় জেলায় শিশু একাডেমির শাখা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। সে সব প্রতিষ্ঠানে শিশুরা সব কিছু শিখতে পারে।

যারা ছবি আঁকে তারা নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করে আর সেই চিন্তাগুলোকে চিত্রের বা ছবির মাধ্যমে রূপ দেয়। প্রকৃত অর্থে এভাবেই ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে তাদের মেধার বিকাশ ঘটে। যেমন একটা গাছ কেমন হবে, কিভাবে আঁকলে গাছকে বুঝানো যাবে সে বিষয়ে চিন্তা করে ছবি আঁকে। মন মতো না হলে আবার অন্যভাবে আঁকে। এক সময় সার্থক ও সুন্দর হয়। এভাবেই ঘটে মেধার বিকাশ। আর ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে সব কিছুকে চিনতেও শেখে। কোনটা গাছ, কোনটা মাছ, কোনটা বক এভাবে সবই নিজে নিজে বুঝতে পারে। আঁকতে পারে। অন্যকে বোঝাতেও পারে কোনটা কী। এজন্য ছবি আঁকাকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলা হয়। কারণ যারা ইংরেজি বোঝে না, হিন্দি, উর্দু কিংবা জার্মান ভাষা বোঝে না কিংবা অন্য কোনো ভাষাই বোঝে না তারা কিন্তু ছবির ভাষা বোঝে। সহজেই বোঝে।

আমাদের দেশের মহান শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একবার বিদেশে গিয়েছিলেন (স্পেনে)। তিনি সে দেশের ভাষা জনেন না। বোঝেন না। একদিন হোটেলে খেতে গিয়ে এ জন্য মহা বিপদে পড়লেন। তিনি কী খাবেন সে কথা ঐ হোটেলের লোকজনদের বোঝাতে পারছেন না। এখন কী করবেন? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো। তিনি পকেট থেকে কলম বের করে সঙ্গে থাকা স্কেচ খাতায় ছবি এঁকে হোটেল বয়কে বোঝালেন তিনি কী কী খেতে চান। তিনি খাতায় একটি মুরগির ছবি এঁকে তার পেছনে একটি ডিমের ছবি এঁকে তীর চিহ্ন দিয়ে বোঝালেন যে, তিনি ডিম খেতে চান। এভাবে আঁকলেন মাছের ছবি, গরু এবং গরুর মাংসের ছবি, ফলমূল এবং চায়ের কাপের ছবি। তিনি কিন্তু আরো একটা ছবি আঁকলেন। আর সেটা হচ্ছে মদের বোতলের ছবি। কারণ বিদেশে আবার মদ পান করা সহজ। হোটেলে মদ দেওয়া হয়। সে জন্য শিল্পী জয়নুল ঐ আঁকা মদের বোতলের গায়ে ক্রস চিহ্ন দিয়ে হোটেলের বয়কে বোঝালেন তিনি মদ্যপান করেন না। হোটেলের বয় সহজেই সব কিছু বুঝে সব ধরনের খাবার পরিবেশন করলেন। মজার ঘটনা। এ জন্যই চিত্র ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলা হয়, যা সবাই বোঝে।

শিশু একাডেমিসহ প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এই আন্তর্জাতিক ভাষা অর্থাৎ ছবি আঁকার সুন্দর ব্যবস্থা আছে আমাদের দেশে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এ ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে বিশেষ বিশেষ দিনে যেমন পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষে, স্বাধীনতা দিবসে এবং বিজয় দিবসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। ঐসব প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য শিশু অংশগ্রহণ করে থাকে এবং মজার মজার ছবি আঁকে। অনেকে অপূর্ব সুন্দর ছবি এঁকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। প্রতিযোগিতা শেষে যারা ভালো ছবি আঁকে তাদেরকে পুরস্কারও দেয়া হয়। এভাবে শিশুরা ছবি এঁকে আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। শুধু দেশই নয়, আমাদের দেশের শিশুরা বিদেশেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার জিতে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদেশে। এভাবে বাংলাদেশের নাম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এই শিশুরা আমাদের সম্পদ। শুধু তা-ই নয়, দেশের ভবিষ্যৎও তারাই। সুতরাং তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ করে দেয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব।

Share.

মন্তব্য করুন