ব্যস্ত এই ঢাকা শহরের যান্ত্রিকতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নগরবাসী ক্রমেই চিত্তবিনোদন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সময়ের সাথে সাথে বড় হয়ে উঠা এই জাদুর শহরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের শেকড়ের টান। ছুটির দিনগুলোতে পরিবার বা প্রিয়জন নিয়ে ঢাকার দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ দিতে পারে একটু প্রাণ। আজকের আয়োজনে রাজধানী ঢাকায় সময় কাটানো বা ঘুরে দেখা যায় এমন কিছু স্থান সম্পর্কে তোমাদের জানবো।

আহসান মঞ্জিল
আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ঢাকা শহরের প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য নিদর্শন। মার্বেল পাথরের এই প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে খাবার ঘর, লাইব্রেরি, জলসাঘর, দরবার হল এবং বিলিয়ার্ড খেলার জায়গা। আর দোতলায় রয়েছে অথিতিদের থাকার কক্ষ, বৈঠকখানা, নাচঘর, গ্রন্থাগার এবং আরো কিছু বসবাসের কক্ষ। প্রাসাদের ঠিক সামনে রয়েছে চমৎকার ফুলের বাগান ও সবুজ মাঠ। ১৯৯২ সালে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

লালবাগ কেল্লা
সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র যুবরাজ শাহজাদা আজম ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে লালবাগ দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। বর্তমানে লালবাগ কেল্লার সুবেদার শায়েস্তা খানের বাসভবন ও দরবার হল জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে আরো দেখতে পাবেন মনোরম বাগান, পরীবিবির সমাধি সৌধ, লালবাগ কেল্লা মসজিদ, ফোয়ারা, আরো কিছু সমাধি এবং তৎকালীন সময় যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান ইত্যাদি। সপ্তাহের রবি ও সোমবার পূর্ণ ও অর্ধ দিবস এবং সব সরকারি ছুটির দিনে লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে।

জাতীয় জাদুঘর
জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের যুগ যুগ ধরে বেড়ে উঠার সব স্মৃতিচিহ্ন ধারাবাহিকতার সাথে আগলে রেখে চলেছে। ১৯১৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একটি কক্ষে ঢাকা জাদুঘর নামে পথ চলা শুরু করে আজকের এই জাতীয় জাদুঘর। শাহবাগ এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এই জাদুঘরে ৪৬টি গ্যালারিতে রয়েছে প্রায় ৮৩ হাজারের বেশি নিদর্শন। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এ জাদুঘর প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ও সরকারির ছুটির দিন জাতীয় জাদুঘর বন্ধ থাকে। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি বিশেষ দিনে জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

বোটানিক্যাল গার্ডেন
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান (বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম) বোটানিক্যাল গার্ডেন হিসেবে অধিক পরিচিত। মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের অবস্থান। ২০৮ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে প্রায় ৮০০ প্রজাতির বিভিন্ন বৃক্ষ রয়েছে। এসব বৃক্ষরাজির মধ্যে রয়েছে নানান ধরনের ফুল, ফল, বনজ এবং ঔষধি গাছ। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ফুলের বাগান ছাড়াও রয়েছে পুকুর, দীঘি ও ঘাসে ঢাকা সবুজ মাঠ। রাজধানী ঢাকা শহরের ভেতরে সবুজের রাজ্যে ভ্রমণের জন্য বোটানিক্যাল গার্ডেন অনন্য। তাই প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থী এখানে বেড়াতে আসেন।

জাতীয় চিড়িয়াখানা
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মিরপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে ১৯৭৪ সালে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ঢাকা চিড়িয়াখানা। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা চিড়িয়াখানা নামে পরিচিতি পাওয়া এই প্রাণী সংরক্ষণাগারকে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা নামকরণ করা হয়। দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য এখানে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রাণিকুল। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী সংগ্রহ, প্রজনন, সংরক্ষণ, শিক্ষা-গবেষণা এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রায় ২০০ প্রজাতির ২ সহস্রাধিক প্রাণী রয়েছে। এছাড়া চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে রয়েছে ১৩ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত দু’টি লেক।

বায়তুল মোকাররম মসজিদ
বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ। মসজিদটি ঢাকায় অবস্থিত। এর স্থাপত্যশৈলী অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পদক্ষেপ গৃহীত হয়। আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি প্রথম ঢাকাতে বিপুল ধারণক্ষমতাসহ একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। মসজিদে একসঙ্গে ৪০ সহস্রাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের প্রধান কক্ষটি তিন দিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। মিহরাবটি অর্ধ-বৃত্তাকারের পরিবর্তে আয়তাকার। আধুনিক স্থাপত্যে কম অলঙ্করণই একটি বৈশিষ্ট্য- যা এই মসজিদে লক্ষণীয়। এর অবয়ব অনেকটা পবিত্র কাবা শরিফের মতো হওয়ায় মুসলমানদের হৃদয়ে এই মসজিদটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

তারা মসজিদ
পুরান ঢাকার আরমানিটোলা এলাকায় আবুল খয়রাত সড়কে তারা মসজিদটি অবস্থিত। ১৮ শতকের শুরুর দিকে তৎকালীন ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর তারা মসজিদ নির্মাণ করেন। মুঘল স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত মসজিদটি অনেকের কাছে সিতারা মসজিদ বা মির্জা গোলাম পীরের মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদের নকশায় তারার ‘মোটিফ’ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই বিশেষ নকশার জন্যই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। হাজারো শিক্ষার্থীর প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে অসংখ্য বৃক্ষ, পুকুর, ফুলের বাগান এবং পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন হয়ে থাকার মতো সুউচ্চ বহু দালান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষী বিভিন্ন স্থাপনা এবং বিভিন্ন ভাস্কর্য, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কার্জন হল, কলা ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, তিন নেতার মাজার, চারুকলা ইন্সটিটিউট, বকুল তলা, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবর, বাংলা একাডেমি, শহীদ মিনার, ডাকসু ভবন, টিএসসি, অপরাজেয় বাংলা ও রাজু ভাস্কর্য, দোয়েল চত্বর, মধুর কেন্টিন, হাকিম চত্বর, মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকজন মুক্তিপাগল মানুষের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ ঢাকার সেগুনবাগিচার একটি পুরনো বাড়ি ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের প্রয়াস নিয়েই যাত্রা হয় এই জাদুঘরের। ভাড়া বাড়ির স্থানস্বল্পতার কারণে সংগৃহীত স্মারকগুলো যথাযথভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব না হওয়ায় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আগারগাঁও এলাকায় জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১১ সালের ৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় ১০২ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় জাদুঘরের নয়তলা ভবন। ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল নতুন ভবনে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে সাত বীরশ্রেষ্ঠর প্রতীক হিসেবে প্রাচীন স্থাপত্যরীতির সাতটি স্তম্ভ রাখা হয়েছে। এই স্তম্ভগুলো নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় দিবর দীঘিতে স্থাপিত একাদশ শতকের রাজা দিব্যকের স্তম্ভের অনুকৃতি। ঐতিহাসিকদের মতে, দিব্যকের সেই স্তম্ভই বাংলার প্রথম বিজয়স্তম্ভ। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশীদের অবিস্মরণীয় বিজয়ের স্মারক হিসেবে এই স্তম্ভগুলো স্থাপন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মারক, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের ব্যবহৃত সামগ্রী, অস্ত্র, দলিল, চিঠিপত্র ইত্যাদি মিলিয়ে ১৭ হাজারের বেশি নিদর্শন রয়েছে জাদুঘরের বিশাল সংগ্রহশালায়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্রীষ্মকালীন (মার্চ-সেপ্টেম্বর) সময়সূচি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা। আর শীতকালীন (অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি) সময়সূচি হলো সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা। রোজার মাসে জাদুঘর খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার। প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা।

বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর
রাজধানী ঢাকা শহরের বিজয় সরণিতে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর। জাদুঘরটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য সংক্রান্ত নিদর্শন ও বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহ নিয়ে জাদুঘরটি সজ্জিত।
১৯৮৭ সালে প্রথম সামরিক জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৯৯ সালে জাদুঘরটি স্থায়ীভাবে বিজয় সরণিতে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের ব্যাজ, পোশাক, অস্ত্র, গোলাবারুদ, ক্যানন, এন্টি এয়ারক্রাফট গান এবং যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন যানবাহন জাদুঘরটিতে রক্ষিত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন যানবাহন এবং অস্ত্রও এখানে সংরক্ষিত রয়েছে।
শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর
ঢাকার পলাশীতে জহুরুল হক হলের ভেতরে অবস্থিত এই শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘর। স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষায় কথা বললে যে নামগুলো মনে তার মধ্যে অন্যতম নাম আবুল বরকত। তার স্মৃতি রয়েছে শহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘরে।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। প্রায় ৪৪ হেক্টর জায়গা নিয়ে সাভার উপজেলায় স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স স্থাপন করা হয়েছে। স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনের নকশায় ১৯৮২ সালের শেষের দিকে স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ শেষ হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূলকাঠামো সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের সাত জোড়া স্তম্ভ বা দেয়াল ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশের জন্য কোনোরকম অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। দর্শনার্থীদের পরিদর্শনের জন্য প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জাতীয় স্মৃতিসৌধ খোলা থাকে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
শহীদ মিনার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতির ধারক। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে শহীদ হওয়া সালাম, জব্বার, রফিকসহ নাম না জানা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। তোমরা সময় পেলেই একটি বিকেলে ঘুরে আসতে পারো ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ থেকে।

রোজ গার্ডেন প্যালেস
ঋষিকেস দাস নামের এক জমিদার ১৯ শতকে রাজধানী ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেন প্যালেসটি নির্মাণ করেন। রোজ গার্ডেন প্যালেসের নয়নাভিরাম সাজঘর ছিল তৎকালীন সময়ের মূল আকর্ষণ। প্রাসাদের সামনে বাগানে রয়েছে মার্বেলের তৈরি কয়েকটি সুদৃশ্য মূর্তি। ছুটির দিন ছাড়া অন্য সব দিনই রোজ গার্ডেন দেখতে পারবেন। তবে মূল ভবনের ভেতরে ঢোকার ক্ষেত্রে আপনার পূর্ব অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে।

মৈনট ঘাট
দোহার উপজেলার মৈনট ঘাট বর্তমানে ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে পরিচিত। ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে সোজা একটি রাস্তা এসে মিলেছে দোহারের মৈনট ঘাটে। পদ্মার এক পাড়ে দোহার আর অপর পাড়ে ফরিদপুর। ঘাটের পূর্ব পাশে বিশাল চর মানুষকে সাগরের বেলাভূমির কথা মনে করিয়ে দেয় আর সামনের বিস্তীর্ণ পদ্মা হয়ে যায় সাগর। আর চাইলে এখান থেকে নৌকায় করে পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়ানো যায় কিংবা পাড় ধরে হাটা যায় ইচ্ছে মতো। ঢাকার কাছে হওয়ায় এবং দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যায় বিধায় মৈনট ঘাট ভ্রমণ পাগল মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

গোলাপ গ্রাম সাদুল্লাহপুর
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নে তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত সাদুল্লাপুর গ্রামটিই বর্তমানে গোলাপ গ্রাম হিসাবে পরিচিত। নানা রঙের গোলাপ ফুল দিয়ে ঘেরা সমস্ত সাদুল্লাহপুর গ্রামটিকে একটি বাগান মনে হয়। গ্রামের বুকের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার দুই পাশের বিস্তীর্ণ গোলাপের বাগান সারাক্ষণ মোহিত করে রাখে। গোলাপ হিসাবে পরিচিতি পেলেও সাদুল্লাহপুর গ্রামে জারভারা, গ্লাডিওলাস এবং রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করা হয়। ঢাকার শাহবাগসহ অন্যান্য ফুলের বাজারের চাহিদা মেটানোর প্রধান জোগানদাতা হচ্ছে সাদুল্লাহপুর গোলাপ গ্রাম।

উত্তরা দিয়াবাড়ি
প্রকৃতির অপার মাধুর্য নিয়ে সুসজ্জিত ঢাকার উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত দিয়াবাড়ি। শুভ্রতায় পরিপূর্ণ দিয়াবাড়ি যেন এক মেঘের রাজ্য। বিশেষ করে শরৎকালে দিগন্তজোড়া কাশফুল দেখে মনে হয় যেন মেঘ পায়ের কাছে এসে লুকোচুরি করছে। কাশফুল, রোদ আর মেঘের খেলা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে এখানে আগত দর্শনার্থীদের। ইট, কাঠ ও কংক্রিটের এই নগরে এক মুঠো প্রশান্তির আশায় ছুটে আসা নগরবাসীর কাছে উত্তরা দিয়াবাড়ি যেন আলাদীনের চেরাগ। দিয়াবাড়ির বটতলা থেকে কিছু দূর সামনে গেলে একটি ছোট্ট প্রাণহীন নদী চোখে পড়ে। তুরাগ নদীর এই শাখার ওপর বর্তমানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি নান্দনিক সংযোগ সেতু। নদীতে পরিত্যক্ত নৌকা আর জেলেদের মাছ ধরার ব্যস্ততা এবং রোমাঞ্চকর পরিবেশে অনায়াসেই কাটিয়ে দেয়া যায় একটি বিকেল।

ফ্যান্টাসি কিংডম
সাভারের আশুলিয়ার জামগড়ায় ২০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ফ্যান্টাসি কিংডম। রোলার কোস্টার, শান্তা মারিয়া, ম্যাজিক কার্পেটসহ বিশ্বের জনপ্রিয় অনেক রাইড রয়েছে এই বিনোদন কেন্দ্রে। তবে ওয়াটার কিংডম হচ্ছে এখানকার প্রধান আকর্ষণ। ওয়াটার কিংডমে আনন্দময় অনেকগুলো রাইড ছাড়াও রয়েছে কৃত্রিম সমুদ্রসৈকত ওয়েবপুল, সøাইড ওয়ার্ল্ড, টিউব সøাইড ও বিশাল সুইমিংপুল। এছাড়া লেজি রিভার, ওয়াটার ফল, ডুম সøাইড, লস্ট কিংডম, প্লে জোন, ড্যান্সিং জোনের মতো মজার সব রাইডও আছে এখানে। ফ্যান্টাসি কিংডম সপ্তাহের ৭ দিনই খোলা থাকে। সাধারণ দিনগুলোতে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকলেও সরকারি ছুটির দিনে সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

নন্দন পার্ক
সাভারের নবীনগর-চন্দ্রা হাইওয়ের বাড়ইপাড়া এলাকায় প্রায় ৩৩ একর জমির ওপর ২০০৩ সালের অক্টোবর থেকে নন্দন থিম পার্কের যাত্রা শুরু। নন্দন থিম পার্কের সবুজ বৃক্ষরাজি অন্যান্য পার্ক থেকে একে দিয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানের রাইড, মানসম্পন্ন খাবারের দোকান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সত্যিই ভ্রমণকারীদের বারবার নন্দন পার্কে আসার ইচ্ছা জাগায়। সাথে রয়েছে সুনিশ্চিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও হকারমুক্ত পরিবেশ। আকর্ষণীয় রাইডগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাবল কার, ওয়েব পুল, জিপ স্লাইড, রক ক্লাইমরিং, রিপলিং, মুন রেকার, কাটার পিলার, ওয়াটার কোস্টার, আইসল্যান্ড, প্যাডেল বোট। এছাড়া রয়েছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ড। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শুধু শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

হাতিরঝিল
হাতিরঝিল রাজধানী ঢাকার একটি এলাকা, যা নগরবাসীর বিনোদনের জন্য মনোরম এক বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। হাতিরঝিল পরিবেশ ও নান্দনিকতায় খুব সহজেই নগরবাসীর মনে জায়গা করে নিয়েছে। হাতিরঝিলে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সেতু, চমৎকার শ্বেতশুভ্র সিঁড়ি এবং নজরকাড়া ফোয়ারা। এখানে ঝিলের পানিতে নৌকায় করে নৌবিহার করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া হাতিরঝিলকে ঘিরে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিশুপার্ক, বিশ্বমানের থিয়েটার, শরীর চর্চা কেন্দ্র।

রমনা পার্ক
ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র রমনা এলাকায় অবস্থিত সুনিবিড় ছায়াঘেড়া একটি উদ্যান রমনা পার্ক। ১৬১০ সালে মুঘল আমলে বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই উদ্যানটির। বর্তমানে রমনা পার্কে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে যা বাংলার ঐতিহ্য হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। পার্কটির আয়তন ৬৮ দশমিক ৫০ একর এবং উদ্ভিদ প্রজাতি দুই শতাধিক। প্রচুর ঘাস, লতাগুল্ম, ছোট ও মাঝারি গাছ, মৌসুমি ফুলে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী পার্ক এই রমনা। এখানে রয়েছে অতি দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ ও পাখি। রমনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রেইনট্রি ও মেহগনি গাছ। সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়েছে জাম, জলপাই, হরীতকী, পেয়ারা গাছ। পার্কের উত্তর পাশ লাগোয়া হেয়ার রোডে রয়েছে পাদাউক গাছ। পার্কে অসংখ্য গাছপালার ভিড়ে কিছু ফল এবং ঔষধি গাছও দেখা যায়। সবচেয়ে পুরনো মহুয়াগাছটি পার্কের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত ছিল। মহুয়াগাছের পূর্বদিকে আছে মিলেশিয়া ও গুলাচ। পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে আছে এক নামে পরিচিত রমনা বটমূল।
পার্কটিতে একটি লেক রয়েছে যা স্থানভেদে প্রস্থ ৯ থেকে ৯৪ মিটার পর্যন্ত এবং দৈর্ঘ্য ৮১২ মিটার। বৈচিত্র্য থাকায় রমনা পার্কে সারা বছরই কিছু না কিছু ফুল থাকে। পার্কে একটি সুন্দর অশোকবীথি আছে পূর্ব পাশে। বর্ষায় ঢাকায় আর কোথাও কেয়া না ফুটলেও রমনার কেয়া ফুল একেবারেই নিয়মিত। হেমন্তে ফোটে ধারমার বা পীতপাটলা। একদিনের আকর্ষণীয় ফুল পাদাউক। বসন্তের কোনো একদিন সোনালি হলুদ রঙের ফুলে ভরে ওঠে গাছ। পার্কের উত্তর পাশে আছে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া।

ঢাকা সদরঘাট
ঢাকা সদরঘাট একটি জনপ্রিয় নদীবন্দর তথা লঞ্চ টার্মিনাল, যা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুরান ঢাকায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশে দেখতে যাওয়ার মতো একটি জায়গা। ঐতিহাসিকভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সদরঘাট ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্রমবিকাশ এবং সুখ্যাতির পিছনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। তুমি যদি ঢাকা শহরের পুরনো ঐতিহ্য এবং এই শহরের গুরুত্ব অনুভব করতে চাও তাহলে অবশ্যই তোমার সদরঘাট ভ্রমণ করা উচিত।

Share.

মন্তব্য করুন