যেকোনো খেলায় হ্যাটট্রিক একটি গৌরবময় অর্জন। ক্রিকেটে কোনো বোলার পরপর তিন বলে উইকেট নিলে তাকে হ্যাটট্রিক বলে। ফুটবল কিংবা হকিতে কোনো খেলোয়াড় একই ম্যাচে তিন গোল করলে হ্যাটট্রিক হয়। আবার কোনো দল পরপর তিনবার কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতলেও আমরা বলি হ্যাটট্রিক শিরোপা। তবে এই শব্দটি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই লেখায় জানাবো ক্রিকেটের হ্যাটট্রিক সম্পর্কে নানা কথা।

গোড়ার কথা

১৮৫৮ সাল। ইংল্যান্ডে এক প্রীতিম্যাচে কাউন্টি দল সারের বোলার স্টিফেনসন পরপর তিন বলে ৩ উইকেট নেন। এই কৃতিত্বের কারণে সমর্থক ও আয়োজকেরা তাকে দামি একটি হ্যাট উপহার দেয়। হ্যাট উপহার পাওয়ার সেই ঘটনাটি থেকেই ধীরে ধীরে বিষয়টির নাম হয়ে যায় হ্যাটট্রিক।
১৮৭৯ সালের ২ জানুয়ারি ইতিহাসের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন অজি বোলার ফ্রেডরিক স্পোফর্থ। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের ভার্নন রয়াল, ফ্রান্সিস ম্যাকিনন ও টম এমেটকে আউট করেন পরপর তিন বলে। আর ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন পাকিস্তানের জালালউদ্দিন। ১৯৮২ সালে হায়দরাবাদে অস্ট্রেলিয়ার রডনি মার্শ, ব্রুশ ইয়ার্ডলি ও লসনকে আউট করেন পরপর তিন বলে।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম হ্যাটট্রিক হয় বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০০৭ সালের টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার পেসার ব্রেট লি পরপর তিন বলে সাকিব আল হাসান, মাশরাফি মর্তুজা ও অলোক কাপালিকে আউট করেন।

আকরাম ও মালিঙ্গা

হ্যাটট্রিক নিয়ে আলোচনা হলে ওয়াসিম আকরামের নামটি সবার আগে উচ্চারিত হয়। টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে দু’টি করে হ্যাটট্রিক করেছেন পাকিস্তানের এই পেস বোলার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও দুটি হ্যাটট্রিক আছে তার। সব মিলে স্বীকৃত ক্রিকেটে তার হ্যাটট্রিক ৬টি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রচলন হওয়ার আগেই ওয়াসিম অবসর নিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কার পেসার লাসিথ মালিঙ্গার নামটিও আসবে শুরুর দিকেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মালিঙ্গার হ্যাটট্রিক ৫টি। ওয়ানডেতে ৩টি ও টি-টোয়েন্টিতে ২টি। তবে টেস্ট ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার কোনো হ্যাটট্রিক নেই।
টেস্টে ওয়াসিম আকরামের দুটি হ্যাটট্রিক একই দলের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে। ১৯৯৯ সালের মার্চে লাহোরে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের তৃতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করার পর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফাইনালে আবারো একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একই কীর্তি গড়েন।
ওয়াসিম আকরামের ওয়ানডে হ্যাটট্রিক দুটি আবার একই ভেন্যুতে। শারজায় ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ও পরের বছর মে মাসে এশিয়া কাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গড়েন হ্যাটট্রিকের কীর্তি।
ওয়ানডেতে মালিঙ্গার তিন হ্যাটট্রিকের দুটিই বিশ্বকাপে। ২০০৭ আসরে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ২০১১ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে।

যত হ্যাটট্রিক

চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক হয়েছে ৪৬টি। ইংল্যান্ডের বোলাররা সর্বোচ্চ ১৪টি হ্যাটট্রিক করেছেন। অস্ট্রেলিয়া ১১টি, পাকিস্তান ৫টি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪টি, ভারত ৩টি, বাংলাদেশ (অলক কাপালি ও সোহাগ গাজী), দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ড ২টি করে এবং জিম্বাবুয়ের বোলার করেছেন একটি হ্যাটট্রিক।
এই সময় পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক হয়েছে ৪৯টি। লাসিথ মালিঙ্গা তিনবার, ওয়াসিম আকরাম, সাকলায়েন মুশতাক, চামিন্দা ভাস, ট্রেন্ড বোল্ট ও কুলদ্বীপ যাদব করেছেন দুই বার করে। দেশের হিসেবে এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। তাদের বোলাররা ওয়ানডেতে মোট নয়টি হ্যাটট্রিক করেছেন। আর পাকিস্তানিরা করেছেন ৮টি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া ৬টি, ভারত ও বাংলাদেশের বোলাররা ৫টি করে হ্যাটট্রিক করেছেন। বাংলাদেশীদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদ ও তাইজুল ইসলাম ওয়ানডেতে একটি করে হ্যাটট্রিক করেছেন।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক হয়ছে ৩৪টি। এই ফরম্যাটে লাসিথ মালিঙ্গা ও রশিদ খানের কৃতিত্ব আছে পরপর চার বলে ৪ উইকেট নেয়ার। যেটিকে বলা হয় ‘ডাবল হ্যাটট্রিক’। একই ধরনের কীর্তি মালিঙ্গা ওয়ানডেতেও একবার গড়েছেন।

তিন ওভার মিলিয়ে হ্যাটট্রিক!

অবাক ব্যাপার হলেও সত্যি। পরপর তিন বলে উইকেট নেয়ার এই কৃতিত্ব একজন করেছেন তিন ওভার মিলিয়ে। সেটি কিভাবে? ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে পার্থ টেস্টের দ্বিতীয় দিনে অস্ট্রেলিয়ার মার্ভ হিউজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্টলি অ্যাম্ব্রোসকে আউট করেন ব্যক্তিগত ৩৬তম ওভারের শেষ বলে। সেটি ক্যারিবীয় ইনিংসের ছিল অষ্টম উইকেট। এর পরের ওভারে অন্য একজন বোলার একটি উইকেট নেন। তারপর ব্যক্তিগত ৩৭তম ওভার করতে এসে প্রথম বলেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ ব্যাটসম্যান প্যাট্টিক প্যাটারসনকে আউট করেন হিউজ। ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস শেষ হয়ে যায়। হিউজের হয় পরপর দুই বলে দুই উইকেট। ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই তিনি গর্ডন গ্রিনিজকে আউট করে গড়েন অবিশ্বাস্য সেই হ্যাটট্রিকের কীর্তি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশ হ্যাটট্রিক করেছিলেন এক ম্যাচের দুই ইনিংস মিলিয়ে। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসের শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে টনি ডডিমেডকে আউট করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম দুই বলে দুজন অজি টপ অর্ডারকে ফিরিয়ে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন। আরেক ক্যারিবীয় জারমেইন লসনও হ্যাটট্রিক করেছেন দুই ইনিংস মিলিয়ে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে হ্যাটট্রিক করেছেন পাকিস্তানের আকিব জাভেদ (১৯ বছর ৮১ দিন)। টেস্টে ম্যাচের প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব আছে ভারতের ইরফান পাঠানের। ওয়ানডেতে সেই কৃতিত্ব শ্রীলঙ্কার চামিন্দা ভাসের।

Share.

মন্তব্য করুন