সোনা সোনা রোদ পড়ে যে শুভ্র শিশিরে
কণা কণা হীরে ঝড়ে ঘাসের উপরে॥

গানের এ অপরূপ সৌন্দর্য মেলে কেবল বাংলাদেশের শরতের প্রকৃতিতে। আমাদের পৃথিবীতে প্রধান ঋতু চারটি (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ও বসন্ত) হলেও আমরাই ভাগ্যবান যে আমাদের ঋতু ছয়টি। ঐ চারের সাথে যুক্ত হয়েছে শরৎ, হেমন্ত। গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীতের আগমন জানান দেয় গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দর-নগর সর্বত্র। প্রকৃতিতে তাদের শক্ত প্রভাব সবাইকে জানিয়ে দেয়- এই যে আমি হাজির হলাম মাদল দিনের বাদল সমেত বর্ষাকাল। কিংবা হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডায় আমাদের আকুতি এই বুঝি বাঁচা দায় এবারের এই শীতে। আর প্রচণ্ড ঝঞ্ঝার উথাল-পাথাল, উত্তাল গতির বাতাসের গোলাকার আবর্তনের কালবোশেখিকে আমরা সবাই চিনি। ওটাই তো গ্রীষ্মকালের নিত্যবার্ষিক কর্মসূচি।
বসন্তের পরিচিতি নিয়ে কথা হবে অন্য কোনো দিন। ও যে ঋতুরাজ বসন্ত। হ্যাঁ তাই তো। বসন্ত যে ঋতুরাজ তাহলে তার রাণী যেন কে? খানিক খুঁজে ফিরি। খুঁজে ফিরি ষড়ঋতুর মাঝেই। দেখা পাব নিশ্চয়ই। সবুজাভ পত্র-পল্লব, প্রকৃতির শ্যামলিমা, শান্তি আর স্বস্তির বার্তাবাহী ঋতু আমাদের বসন্ত। বসন্তের আচরণ অত্যন্ত সদাশয়ী, কোমল। বসন্তে থাকে না উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। তবে থাকে সুপ্ত ভীতি। এই বুঝি তেড়ে এলো কালবোশেখির তাণ্ডব।
গ্রীষ্ম, বর্ষা পাশাপাশি দুটি ঋতু। ঝড়-বৃষ্টি তো পাশাপাশি হবে এটিই স্বাভাবিক। বৃষ্টির বাড়াবাড়ি খানিকটা ফিকে হয়ে আসে শ্রাবণের মধ্যেই। সহসা প্রকৃতির মন জুড়িয়ে দেয় শরতের আগমনী বার্তা। শরতের মায়াবী আবহ। সে আবহের স্নিগ্ধতা পরশ বুলিয়ে দেয় প্রকৃতির সর্বত্র সফেদ চেতনার, শুভ্র মননের। সত্যিই শরৎ ভালোবাসার অমূল্য ধন। ভালোবাসায় অমর। এ ঋতুকেই কেবল মানায় ঋতুরাণী উপাধির। আমরা মনে করি শরৎ ঋতুই ঋতুরাণী। অবশ্য অনেকে শরৎকে ঋতুকুমারীও বলে থাকে।
ভাদ্র এবং আশ্বিন শরতের দুই মাস। বাংলার প্রকৃতির বিশেষ এ ঋতুকে চিহ্নিত করা খুবই দুষ্কর। বিশেষত শহুরে বাঙালিরা এর আগমন হয়তো টেরই পায় না। কিন্তু শরতের অনন্য রূপময়তা উপভোগ করে শ্যামল বাংলার চিরায়ত গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দারা। শরতের সৌন্দর্য ভেলায় ভেসে বেড়ায় তারা। শরৎ শোভার সৌন্দর্য সমুদ্রে স্নানে সিক্ত হয় তারা। অপরূপ রূপের পসরা সমেত ধরা দেয় আমাদের কাছে শরৎ ঋতু বিচিত্র ঢঙে। বাঙালির মননে, কাননে।
শরৎ ঋতুর বৈচিত্র্য সত্যিই মনোলোভা। এ ঋতুতে শ্রাবণ মেঘের দিনের সেই মেঘ-বর্ষার আনাগোনা কমে এলেও তা একেবারেই শেষ হয়ে যায় না। আবার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের রৌদ্রের সেই তাপদাহ না থাকলেও তাল পাকা গরম তখনও রয়ে যায়। একইভাবে বসন্তের মতোই নানা ফুলের পসরা না থাকলেও শরৎ সাজিয়ে তোলে প্রকৃতিকে কাশ আর শিউলি ফুলে। তবে পার্থক্য হলো- বসন্তের ফুলগুলো সবুজে-শ্যামলে ভরা। আর শরতের ফুলগুলোতে শুভ্রতার মাখামাখি। প্রকৃতই শরতে যেন বহুমুখী বৈচিত্র্যের সমাহার। বাড়ির গৃহিণীর যেমন নির্দিষ্ট কোনো কাজ থাকে না। তেমনি শরতেরও একমুখী কোনো চরিত্র নেই। সে জন্যই তো শরৎ ঋতুরাণী।
শরৎ শব্দের মধ্যেই এক ধরনের শুভ্রতার গন্ধ রয়েছে। শরৎ যেন শুভ্রতাকে ধারণ করে। শরৎ যেন সফেদকে লালন করে। শরৎ-অভ্যন্তরে অবস্থান করে শুভ্রতার হাতছানি। উন্মত্ত কালবোশেখির সৃষ্ট ক্ষতকে বর্ষা দিনের বাদলে ধুয়ে-মুছে সফেদ-সুন্দর হবার সূচনাকাল শরৎ। তাই শরৎ মানেই নির্মল প্রকৃতি, স্নিগ্ধ পরিবেশ, সাদা আকাশের সকালে ঘাসের ডগার রূপালি শুভ্র শিশির আর তাতে দিনমণির মোলায়েম পরশ।
শরতে শুভ্রতার স্পর্শ থাকে প্রকৃতির সর্বত্র। শুভ্রতা যেন শরতের চাদর। শরৎ প্রকৃতির আবরণ। শরতের সকালে বাড়ি হতে বেরুলেই নয়ন জুড়িয়ে দেয়- ঘাসের ডগার শুভ্র শিশির। হাঁটতে হাঁটতে নদীতীর কিংবা জলাধারের পাশে গেলে দেখা মেলে সফেদ-শুভ্র সারি সারি কাশফুল। নদী, দীঘি বা পুকুরে সাঁতার কাটে সাদা হাঁসের দল। যেখানে সেখানে দেখা যায় সাদা সাদা শিউলি ফুল। মাথা উঁচু করে উপরের দিকে তাকালে পেঁজো তুলার সাদা মেঘের হৃদয় কাড়া বিচরণ। বিল-ঝিল কিংবা পাথারে ভেসে থাকে সাদা-সবুজের শাপলা-পদ্ম। সর্বত্রই যেন শুভ্রতার প্রলেপ। এই শুভ্রতা কেবল সৌন্দর্য বিতরণের জন্য নয়। এ যেন মননকে সাদা করার উদাত্ত আহ্বান। মনন শুভ্রতার প্রকৃতির এই নিখাদ আহ্বান আর কোনো ঋতুতে পাওয়া দুষ্কর। তাই আমরা বলি- শরৎ ঋতু প্রকৃতির আশীর্বাদ। শরতের শুভ্রতায় স্নাত হয়েই টিকে থাকে প্রকৃতি বারোটি মাস।
১৪২৯ বঙ্গাব্দ চলমান। এবারের শরৎ আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত বার্তাবাহী। দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের মহাসড়ক বিনির্মাণের সুবর্ণ সময়। দেশ গঠনের মহান আহ্বানে দেশের তরুণ ও কিশোরদের জানাই শরতের শুভ্রবার্তা।
শরৎ বছরের মধ্যাহ্ন পূর্ব ঋতু। এ ঋতুতে কৃষকের হাতে থাকে ব্যাপক অবসর। স্বপ্নের সোনালি ধান হাতে আসার আন্তরিক আকুতি। থেমে থেমে চলে ফসল উঠানোর পূর্ব প্রস্তুতি। আমাদের কিশোর সোনামণি যারা বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী তাদের জীবনের শরৎ বহমান। তাদের মননে-মানসে শরতের আকুতি, আগামীর প্রস্তুতি খেলা করছে প্রতিনিয়ত। আমরা প্রত্যাশা করি- তাদের আকুতি হবে ইতিবাচক, প্রস্তুতি হবে পূর্ণাঙ্গ। বিস্মৃত হলে চলবে না আমাদেরকে কাজে লাগাতে এই শরৎকে।
কিশোর বন্ধুরা! প্রতি বছর আমাদের মাঝে শরৎ আসে। কাশফুল ফোটে। সময় পরিক্রমায় তা আবারও হারিয়ে যায়। কিন্তু কিশোরদের শরৎ তো কাজে লাগানোর জন্য। হারিয়ে যাবার জন্য নয়। তাই শরতেই তোমাদেরকে স্বপ্ন দেখতে হবে। টেকসই দেশ গড়ার স্বপ্ন। কাশ-শিউলির মতো কলঙ্কহীন স্বপ্ন। শিমুল ডালে শোভা পাওয়া শিমুল যেমন নিজেকে বিসর্জন দিয়ে মানবকল্যাণে তুলার সরবরাহ নিশ্চিত করে। তেমনি তোমাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের কল্যাণে আপন সত্তাকে উজাড় করে দেবার।
কবি বলেছিলেন-
আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়
লুকোচুরি খেলা
নীল আকাশে কে ভাসালো
সাদা মেঘের ভেলা॥
কবির সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে শরতের পূর্ণ চিত্রায়ণ হয়েছে এ পঙক্তি কয়টিতে। পঙক্তির শব্দগুলো আমাদেরকে নিয়ে যায় এক নতুন আলোকরেখায়। আমাদেরকে প্রস্তুত করে এক নতুন সম্ভাবনার জন্য। কবি কেবলই কৃষকের ধানের ক্ষেতে রোদের লুকোচুরি খেলার কথা বলেননি। শুনিয়েছেন পরিবর্তনের অমোঘবার্তা। আকাশ নীল সে তো সবাই জানে। কিন্তু শরতের আকাশে থাকে সাদা মেঘের ভেলা। আকাশ তখন পরিণত হয় শুভ্র দিগন্তে। পেঁচানো তুলার সৌন্দর্যে দিগন্ত হয়ে উঠে বাঙময়। বর্ষা বা শ্রাবণের কালো আসমানকে সফেদ-শুভ্র করে তোলে শরতের আবহাওয়া। তাই শরৎ যেন আকাশ বদলানোর মহানায়ক। যেমন তোমরা কিশোররা দেশ বদলে দেবার মহান কারিগর। আকাশের সৌন্দর্যের মতোই দেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মহান রূপকার।
বাংলাদেশের প্রকৃতিতে রয়েছে শরতের বিশেষ মর্যাদা স্মারক। এ মর্যাদার নেপথ্যে রয়েছে মানুষের মনকে বদলে দেবার এক মোহময় শক্তি। শরৎ একটি সময়ের নাম। বাহ্যত যার কোনো শক্তি নেই, সামর্থ্য নেই। সে যদি এমন পরিবর্তনের নায়ক হতে পারে। তবে জীবনের শরতে অবস্থানরত কিশোর বন্ধুরাও নিশ্চয়ই এমন শক্তির মালিক হতে পারবে। যা দিয়ে সে দেশের নৈতিকতার চেহারা পাল্টে দিবে। জাতির অবস্থানকে উত্তুঙ্গে ধারণ করবে। এ জন্য কাজ করতে হবে তোমাদেরকে সংঘবদ্ধভাবে। একাকী এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুবই দুরূহ।
শরতের আরো এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা না বললেই নয়। শরতের বৃষ্টি অবিরাম নয়। যেমন তা নয় বৃষ্টিশূন্য। ছোট ছোট পশলার বৃষ্টি, থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি, মাঝে মাঝে বৃষ্টির রিনিঝিনি বাংলাদেশিদের মনে আনন্দের ঝড় তোলে। শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির অঞ্জলি যেন আনন্দ-বারি। এই অনাবিলতা প্রতিটি মনেই আনন্দের সুখ ঢেউ খেলে যায়। আনন্দরা পাখা মেলে যখন বৃষ্টির পর দেখা মেলে রৌদ্র ঝলকানির। কিংবা রোদ-বৃষ্টির একত্র বসবাস। মাঠের ঝকমকানির মতোই মনের ভেতরেও চলে আনন্দের ঝলকানি। একটুপরেই দেখা মেলে রঙধনু সাতরং। সেই রঙধনুতে সার্থক হয় দিগন্ত পৃষ্ঠ।

কিশোর বন্ধুরা! জীবনকে বিকশিত করো। আমরা যারা পরিণত, বৃদ্ধ, বয়স্ক কিংবা তোমরা ছাড়া আর সকলেই তাদের দিগন্তে তোমরাই রঙধনুর দীপ্তি ছড়াও। রঙধনুর সৌন্দর্য ও আলোতে এই দেশ এবং বিশ^কে রাঙিয়ে দাও।

তোমরাই আমাদের আগামী দিনের সূর্য সন্তান।
তোমরাই আমাদের কাশফুল। তোমরাই দেশের শিউলি।
তোমরাই আমাদের বর্ষা শেষের সাদা মেঘের ভেলা।
তোমরাই আমাদের স্বপ্ন জাগানিয়া, আশা জাগানিয়া ভবিষ্যতের বুনিয়াদ।
তোমাদের সফলতার প্রত্যাশা সর্বক্ষণের।
তোমাদের জন্যই কেবল শরৎ-শুভ্র অকৃত্রিম ভালোবাসা॥

Share.

মন্তব্য করুন