বিটাই আছে না, ওই যে সেবক রোড ধরে এগিয়ে দু’মাইল ফেলে, শালুগাড়া ফেলে আর একটু এগিয়ে বাঁ দিক দিয়ে শালগাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নেমে গেলে মহানন্দার প্রায় কাছেই ওর, মানে ওর বাবার দোতালা কাঠের বাড়ি, একেবারে ছবির মত। সেদিন বিটাই আর ওর বন্ধু টুবলু মহানন্দার বালি ঘেঁটে, পাথর টাথর দিয়ে আগের দিন যে ঘরটা বানিয়ে রেখে এসেছে সেটা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে। ওপরে শাল পাতার ছাউনিও দিয়েছে, দূর থেকে বেশ দারুণ লাগছিল। পাথরের দরজার মধ্য দিয়ে ভেতরে অন্ধকার অন্ধকার বেশ দিব্যি লাগছিল। ভেতরে গুঁড়ি দিয়ে ঢুকতে গিয়ে বিটাই পিছিয়ে এলো, আরে ওখানে কি দুটো জ্বলজ্বল করছে রে টুবলু?
টুবলুর ভয় টয় কম। বিটাইকে সরিয়ে দিয়ে একটু ভেতরে ঢুকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ফ্যাস করে একটা আওয়াজ। একটু থমকে গেছিল সে, তারপর হাত বাড়িয়ে ঘাড় ধরে যেটাকে বার করে আনল সেটাকে দেখে বিটাই বলল ‘আরে, এটাতো বেড়াল একটা।’ টুবলু জুল জুল করে ভিরু ভিরু চোখে তাকিয়ে থাকা ডোরাকাটা জীবটাকে দেখে বলল, ‘দূর! এটা তো একটা চিতার বাচ্চা। কোন চা বাগানে ওর মা’টা বাচ্চা পেড়েছিল। দুষ্টুটা পালিয়ে এসে ফিরতে পারেনি। ঠিক হয়েছে, কেমন জব্দ।’
বিটাই বলল ‘উল্টোটাও তো হতে পারে। ওর মা ওকে ফেলে রেখে চলে গেছে। হয়তো খাবারের খোঁজে গেছে।’
– হবে হয়তো।
– কি হবে! ওর মা’টা যদি খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে?
– আসে আসবে, ছানা নিয়ে চলে যাবে।
– তাহলে যা, তোর বাড়ি থেকে একটু দুধ নিয়ে আয়।

হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে ভারী গলায় বলল ‘এখন তার আর দরকার নেই বেটা। আমার কাছে দুধ আছে। দাও, ওকে খাইয়ে দাও। অনেকক্ষণ খায়নি বেচারা।’
ওরা দু’জনেই মুখ তুলে চমকে গেল। চামড়ার অদ্ভুত পোশাকে আগা পাশতলা মোড়া, হাঁটু পর্যন্ত অদ্ভুত একটা চামড়ার জুতো মতো কিছুতে মোড়া দীর্ঘকায় একটা লোক। বিটাইরা জানে, এ ধরনের মানুষরা পাহাড়ের একদম উঁচু আর দুর্গম গ্রামে থাকে। তিব্বত বা তার কাছাকাছি কোথাও। মাঝে মাঝে শিলিগুড়ি বাজারে দেখা যায়। কখনো কখনো নাকি পায়ে হেঁটে চলে আসে। একবার দালাই লামা যখন শিলিগুড়ি এসেছিলেন তখন শিলিগুড়িতে ভর্তি হয়ে গেছিল এরকম মানুষ। ইনি কি কোনো লামা? এখানে কি করে এলেন হঠাৎ? কোথা থেকে?
অদ্ভুত লোকটি বলে উঠল ‘আরে তোমরা কি এতো ভাবছ বলো তো? বাচ্চাটা ক্ষিদেয় কেমন করছে দেখেছ?’
টুবলু বলল ‘হ্যাঁ রে বিটাই ওর খুব ক্ষিদে পেয়েছে। চল খাইয়ে দি।’
দীর্ঘকায় লোকটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওদের হাতে একটা দুধের বোতল এগিয়ে দিল। ওরা দু’জনে বাঘের বাচ্চাকে আদর করে দুধ খাইয়ে দিলো। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল ওদের কোলে।
– কি করা যায় এবারে? ঘরে নিয়ে গেলে তো নির্ঘাত বকা খেতে হবে। তার চেয়ে এখানেই থাক। টুবলু বলল।
– যদি বেরিয়ে চলে যায়?
বিটাই-এর কথায় টুবলু বলল ‘না না আমরা ভালো করে বাইরে থেকে বড় পাথর দিয়ে এমনভাবে আটকে দেবো যাতে নিঃশ্বাসটুকু নিতে পারে আর কেউ যাতে ঢুকতে না পারে বা বুঝতে না পারে ভেতরে কেউ আছে।’
– কিন্তু ওর চোখ দুটো ভীষণ জ্বলজ্বলে।
– তাতে কি? ও দুধ খেয়েছে তো, পেট ভরে গেছে। এখন ঠিক ঘুমিয়ে যাবে। আমরা আবার সকাল বেলা এসে দেখে যাবো।
– হ্যাঁ তাই ভালো, চল আমরা ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে পাথরের দরজাটা দিয়ে ভালো করে আটকে দি।
ওদের কথার মাঝে ঐ অদ্ভুত চেহারার লোকটি বলে উঠল, ‘কোন চিন্তা নেই। তোমরা ঘরে যাও, তোমাদের মা-বাবা চিন্তা করবে, আর আমি ঠিক পাহারা দেবো, এখানেই বসে থাকবো আমি।’
ওরা দু’জন খেয়াল করল পাশের বড় পাথরটার ওপর লোকটি বেশ আয়েশ করে বসেছে আর একটা চওড়া ব্যাগ আর একটা বড় পানির বোতল বেশ সুন্দরভাবে পাশে গুছিয়ে রেখেছে।
– এখানেই বসে থাকবে? সারা সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি? তুমি বাড়ি যাবে না?
– পথই আমার বাড়ি, পথই আমার জীবন। কোনো চিন্তা করো না, তোমরা যাও, বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা করবে কিন্তু। পড়াশোনা না করলে আমি রেগে যাব।
ওরা লোকটির কথা শুনে অবাক হয়ে যায়, মনে হয় কত দিনের পরিচয়। খুব আপন মনে হল ওদের। এতো আন্তরিক আর এতো সহজ সরল। বড্ড ভালো লেগে যায়।
– আচ্ছা বেশ, তাই হবে। তোমার নাম কি গো? তুমি কোথায় থাকো?
– আমি শিচাং থেকে এসেছি। আমার নাম গ্রে।
– গ্রে! অবাক চোখে তাকায় বিটাই।
– শিচাং ! টুবলু আরো অবাক হয়।
– তোমরা শিচাং -এর নাম শুনেছ?
গ্রের প্রশ্নে দু’জনেই মাথা নাড়ায়। তারপর বলে শিচাং তিব্বতের একটা জায়গা।
– তিব্বত ! চোখ বড় বড় করে টুবলু তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ‘ওরে বাবা বলো কি! তুমি তিব্বত থেকে এসেছ নাকি?’
– হ্যাঁ তো, আমি সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াই।
– সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াও? তোমার বাড়ি কি শিচাং? বিটাই বড় বড় চোখ করে জানতে চায়।
– না, আমার বাড়ি লাসা।
– লাসা! আরে বাহ কি সুন্দর নাম, টুবলু বলে।
– হ্যাঁ তিব্বতের রাজধানী লাসা। লাসা মানে জানো?
ওরা মাথা নাড়ায়। গ্রে সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করে লাসা মানে হলো দেবতাদের আবাস। দালাই লামার বাসস্থান।
– দালাই লামা! একসাথে দু’জনেই চমকে যায়।
টুবলু বলে ‘দালাই লামাকে চিনি তো।’
– তাই! দালাই লামাকে চেনো! কিভাবে?
– হ্যাঁ ছবিতে দেখেছি। খুব ভালো দালাই লামা। তুমিও কি দালাই লামার মতো গোপনে দেশ ত্যাগ করে আমাদের দেশে এসেছ?
বিটাই-এর কথা শুনে গ্রে হেসে বলে ‘আমি তো সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই হেঁটে হেঁটে, দেশত্যাগ কেন করব? ইচ্ছে হলে আবার যাব।’
– হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় রে টুবলু। কি সব বলছে দেখ! চল চল এবারে বাড়ি যাই, না হলে মা বকবে কিন্তু।
– হ্যাঁ এখন তোমরা চলে যাও। এই বাঘের ছানাকে আমি পাহারা দেব। আর এই যে আমার সঙ্গে যে ব্যাগটা দেখছ অনেক খাবার আছে চিন্তা নেই, আমি খাইয়ে দেব ঠিক।
– আর ঘুমোবে কোথায়? বিটাই অবাক হয়ে জানতে চায়।
– আমার ব্যাগে চাদর আছে। আমাকে নিয়ে অতো চিন্তা করোনা তো, এই পাশেই ঘুমিয়ে পড়ব।

ওরা দু’জন অবাক হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে এসে কাউকে কিছুই জানায় না। এসব ঘটনা বললে রক্ষে আছে? আর বেরোতেই দেবে না।

২.
পরদিন ভাগ্যিস রবিবার। স্কুল ছুটি, পাড়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ডেকে বিষয়টা বলতেই হইচই পড়ে গেল। বাঘের বাচ্চা! বাঘের বাচ্চা কোথায় কোথায়? চল তাড়াতাড়ি চল। কেউ বলল আমার তো গ্রে-কে দেখতে ভারী ইচ্ছে হচ্ছে।
বাপ্পা বলে ‘গ্রে সত্যিই দালাই লামার আত্মীয়?’
বাপ্পার কথা শেষ হতে না হতেই মৈনাক বলল ‘দালাই লামাকে একবার আমার দাদু দেখেছিল, শিলিগুড়িতে এসেছিল তো, কী ভিড়, লোকে লোকে উপচে পড়েছিল।’
-তাই নাকি দালাই লামা এসেছিল শিলিগুড়ি?
– এমা পিকলু তুই জানিস না?
পিকলু উত্তর না দিয়ে বলে উঠল ‘আচ্ছা তোরা দুজন বাঘের বাচ্চার নাম ঠিক করেছিস?’
বিটাই বলে, ‘হ্যাঁ তো, জ্যাম্বো রেখেছি, কি সুন্দর না?’
এরপর বিটাই বর্ণনা করতে করতে এগিয়ে চলল
‘নীল চোখ, তুলতুলে শরীর, কাছে নিলেই মুখ ঘষে দেয়।’
ওরা প্রত্যেকে ভীষণ রকম উত্তেজিত হয়ে রীতিমত ছুটছিল। আসলে বাঘের বাচ্চাকে এতো কাজ থেকে দেখতে পাওয়া, তাকে কোলে নিয়ে আদর করা, চুমু খাওয়া, গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়া, উফ ভাবা যায়! ওরা প্রত্যেকে রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েছিল।

বাপ্পার সাফারি পার্কের সুন্দর একটি বাঘের গল্প মনে পড়ল। ছবির মতো বর্ণনা করে যাচ্ছিল সেই দৃশ্য। একটি ছোট্ট মেয়ে বাঘ, কি সুন্দর! ছোট্ট মেয়ে বাঘটি মাকে ফাঁকি দিয়ে একটু এদিক ওদিক করতেই মা বাঘ অমনি পথ আগলে রাখছিল। মাকে ফাঁকি দেওয়া অতোই সহজ! মায়ের গম্ভীর মুখ দেখে ভয়ে চুপ করে মায়ের কোল ঘেঁষে বসতেই মা আদর করে জিভ দিয়ে ওর সারা শরীর মুছে দিচ্ছিল।’
– আরেব্বাস! তুই নিজে দেখেছিস? পিকলু বলে উঠল।
– না পিসি বলেছিল। ডোরাকাটা বাঘের জন্মের কথাও বলেছিল। ওর বাবা-মাও হলুদ ডোরাকাটা। আমার পিসি সাফারি পার্কে যায় তো, ওখানে অনেকের সাথেই পরিচয় আছে পিসির। পিসি দেখেছিল ছোট্ট বাচ্চাটা মা আর দুই দিদির সাথে খেলা করছে। একটু দৌড়ঝাঁপ করে, আবার ক্লান্ত হলে মায়ের কাছে ছুটে যায়। আরাম করে মায়ের দুধ পান করে। তারপর আবার ছোটাছুটি করে, খেলা করে। বিশ্রাম নিতেই চায় না। তাই ওর মায়ের চোখে ঘুম নেই।
দুধের কথা উঠতেই বিটাই বলে উঠল ‘ইস আমাদের জ্যাম্বোর জন্য তো দুধ আনা হলো না, কি করি এবার?’
পিকলু বলল, ‘ঠিক আছে এক কাজ করি, রমেন জেঠুর দোকান থেকে একটা দুধের প্যাকেট নিয়ে নিচ্ছি। টাকা পরে দিলেও হবে।’
-হ্যাঁ রে তাড়াতাড়ি চল, জ্যাম্বোর বোধ হয় খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
টুবলু, বাপ্পা, মৈনাক, পিকলু, বিটাই খুব জোরে পা চালালো।
গর্তের সামনে এসে দেখল গ্রে তো নেই। কোথায় গেল? পিকলু বলল, ‘আশপাশে কোথাও গেছে হয়তো চা খেতে।’
বাপ্পা বলল, ‘তাই হবে, ঠিক আছে চল আমরা জ্যাম্বোকে দেখি, কুচু মুচু সোনা জাম্বোটাকে দেখব। ইস আমার ভেতরটা কেমন লাগছে রে! জীবনে এমন দিন কখনো আসবে ভাবতেই পারছি না। সত্যি সত্যি বাঘের বাচ্চা দেখব!’
বিটাই বলল, ‘আস্তে কথা বল, ভয় পেয়ে যাবে আমাদের চিৎকারে। ছোট্ট বাচ্চা না, দুষ্টু মাটা ফেলে রেখে কোথায় পালিয়েছে।’
সবাই মিলে সামনে গিয়ে ফিসফিস করতে লাগল। বিটাই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় চুপ করতে বলল। সবাই চুপ করতেই পাথরের দরজাটা সরিয়ে টুবলু হাত ঢোকালো, ‘আরে কোথায় জ্যাম্বো? নেই তো!’
– নেই! মানে! বিটাই কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।
সবাই একে একে খোঁজার চেষ্টা করল কিন্তু জ্যাম্বোকে কেউ কোথাও খুঁজে পেল না। ওরা তিনজনে টুবলু আর বিটাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘এভাবে রবিবারের সকালটা মাটি না করলেই পারতিস?’
বিটাই ছলছল চোখে বলল, ‘সত্যি ছিল এখানে।’
পিকলু বলল, ‘তোরা মিথ্যে কথা বলছিস। সব তোদের বানানো গল্প।’
টুবলু রেগে গিয়ে বলল, ‘যা খুশি বলে যাচ্ছিস তোরা সবাই। আমি আর বিটাই নিজের হাতে দুধ খাওয়ালাম।’
মৈনাক বলল, ‘আচ্ছা তোরা তোদের গল্প নিয়ে থাক, আমি চললাম। আজ আমাদের ক্রিকেট ম্যাচ আছে।’
মৈনাকের সাথে বাকিরাও ভীষণ একটা মুখ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
চোখ ফেটে জল আসছে বিটাই-এর। এত অপমান বন্ধুদের। ওরা এতটা মিথ্যেবাদী ভাবলো।
টুবলু বলল, ‘ছাড়তো ওদের কথা, এখন বল কি করা যায়? জ্যাম্বোকে চুরি করে কে নিয়ে গেল?’

– কে আবার? ঐ গ্রে। তখনই সন্দেহ হচ্ছিল লোকটিকে, দেখলি না কেমন সেধে সেধে দুধ নিয়ে হাজির আমাদের পেছনে। একেবারে দালাই লামা সেজে আমাদের উপকার করতে এসেছে।

– হ্যাঁরে অচেনা লোককে কখনো বিশ্বাস করতে নেই।
দু’জনেই ছলছল চোখে বিদায় নিতে যাবে হঠাৎ পেছন থেকে চেনা সেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর ‘এই যে বয় তোমরা এখানে! এদিকে জ্যাম্বো বেটার ভীষণ কান্নাকাটি সকাল থেকে, তোমাদের না পেয়ে মনোকষ্টে সেই কি অবস্থা। কিছুতেই থামাতে পারি না।’
– আরে তুমি ! জ্যাম্বোকে নিয়ে কোথায় চলে গেছিলে?
এক-ই সাথে দুজনেই কথাটা বলে উঠতেই গ্রে শান্ত গলায় বলে, ‘আমি তো ওকে নিয়ে অনেক দূরে ঘুরতে গেছিলাম, বলতে পারো মর্নিং ওয়াক।’
– মর্নিং ওয়াক! অবাক হয়ে যায় বিটাই।
– হ্যাঁ তো, কি করব বলো একেবারে এমন কান্নাকাটি শুরু করল যে ওকে রাখাই দায়। জায়গাটা নিরিবিলি তো, কাউকে দেখতে না পেয়ে কাঁদছিল।
– বাহ দারুণ! আমরা এদিকে পাগলের মতো করছি জ্যাম্বোর জন্য, আর তুমি মর্নিং ওয়াক করে বেড়াচ্ছ।
শুধু কি তাই বন্ধুদের কাছে কতো ছোট হয়ে গেলাম।
– মানে !
ভ্রু কুঁচকে গ্রে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওদের মুখ চোখ দেখে গ্রে চুপ হয়ে যায় ।
বিটাই ছুটে গিয়ে জ্যাম্বোকে কোলে নিয়ে আদর করে চুমু দিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। জ্যাম্বোও বিটাই এর স্পর্শে খুশিতে জিভ দিয়ে বিটাই এর হাত চাটতে লাগলো। দুধ খেয়ে পেটটা ভরা তাই মহানন্দে চুপ করে আছে। টুবলু এক বোতল জল নিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে, একটু একটু করে জল খাইয়ে দিল। নীল জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে জ্যাম্বো ওদেরকে দেখতে লাগল। একটু পরে ওদের রাগ উধাও হয়ে গেল। জ্যাম্বোকে নিয়ে ওরা তিনজনে গোল হয়ে বসে মহানন্দে গল্প জুড়ে দিলো।

৩.
দেখতে দেখতে দশ দিন হয়ে গেল। জ্যাম্বো বেশ চিনে গেছে ওদেরকে। ওরা আসলেই গোল হয়ে বসে তিনজনে, আর জাম্বো ওদের মাঝখানে খেলা শুরু করে। গ্রে প্রতিদিন ওর মস্ত ঝোলা থেকে ছোট ছোট শিশি বের করে কিশমিশ, কাজু ওদের সাথে ভাগ করে খায়। বাচ্চাদের গ্রে খুব ভালোবাসে। সারাদিন গ্রে পাহারা দেয় জ্যাম্বোকে আর বিকেল হলেই বিটাই আর টুবলুর জন্য প্রতীক্ষা করে। বিকেলের সব খেলা বাদ দিয়ে ওরা দু’জনে গ্রে আর জ্যাম্বোর সাথে লুকোচুরি খেলে। একটা বাচ্চা বাঘ যেন এক্কেবারে একটা বিড়ালের বাচ্চা, কোন হিংস্রতার চিহ্নমাত্র নেই।
একদিন দুই বন্ধু ঠিক করল ছোট্ট সোনাটাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে। মাকে- বাবা, বাড়ির সবাইকে দেখাবে। কিন্তু গ্রে বলল, ‘তোমরা কি ক্ষেপেছ? এমন কাজ ভুলেও করো না, তোমাদের বাড়ির লোক জানতে পারলে এমন রেগে যাবে, বাঘের বাচ্চাকে কেউ কি কুকুর ছানার মতো বাড়িতে রাখতে চাইবে বলো?’
বিটাই ভাবল ঠিকই তো। শেষমেশ রেগে গিয়ে বাবা যদি কেলেঙ্কারি করে। টুবলুও ভাবল ঠাকুমা দেখলে আর রক্ষে আছে? থাক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে লাভ নেই।
চারটে প্রাণীতে দিন চলছিল ভালোই। জীবনের অনেক অভিজ্ঞতাই ভাগ করে নিচ্ছিল পরস্পর। তিব্বতের জীবন যাপনের নানান ছবি দুই বন্ধুর হৃদয়ে ধরা পড়তে লাগল একের পর এক। গ্রে এখন ওদের কাছে মহান নায়ক।

একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ওরা দুই বন্ধু খেয়াল করল প্রচুর লোকের ভিড়, হই হট্টগোল। একটা বড়সড় বাঘ নাকি পাড়ার মধ্যে গর্জন করতে করতে ঢুকে পড়েছিল। অনেকের বাড়ির পাঁচিল টপকে নাকি একেবারে উঠোনে গিয়ে হাজির। চিৎকার চেঁচামেচিতে সব লোকজন জড়ো হতেই খেয়াল করে পাগলের মতো করছে সেই বাঘিনী। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টায় মত্ত। তারপর নাকি নদীর ধারে একটা নির্জন জায়গায় একটা বড়সড় লোককে কামড়ে দিয়ে একশেষ। পরে সেই লোকটিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে সেই বাঘিনী একটা বালির ঘর থেকে কিভাবে একটা বাঘের বাচ্চাকে উদ্ধার করে মুখে নিয়ে দৌড়।
প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন বললেন ‘বাঘিনীটা বাচ্চা হবার পর মনে হয় নির্জনে তাকে রেখে কোথাও গেছিল, কিংবা বাচ্চাটা পালিয়ে এসেছিল। তাই চারপাশে খুঁজে কোথাও না পেয়ে বাচ্চার সন্ধানে মানুষের বাড়িতে আক্রমণ করেছে।’
কেউ আবার বলল, ‘আরে না না নদীর ধারে এক বিশাল আকৃতির লোক একটা বাঘের বাচ্চাকে নিয়ে খেলা করছিল। আচমকা বড় বাঘটা এসে ওই লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর ঐ লোকটির চিৎকারে লোকজনের ভিড় দেখে মা বাঘটা বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে যায়।’
চোখের অশ্রু আটকাতে পারছিল না বিটাই আর টুবলু। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। জ্যাম্বোকে আর দেখতে পাবে না কখনো। আর গ্রে? কি সুন্দর মানুষটা, নিজের দেশ ছেড়ে এদেশে এসে কতো ভালো কাজ করছিল। তাকে আজ এভাবেই কষ্ট পেতে হলো? এত নিষ্ঠুর মা বাঘটা। প্রতিদিন দুধ, জল খাইয়ে আগলে রাখল যে মানুষটা তার-ই এমন ক্ষতি করল।
এতদিনে বাপ্পা, পিকলু, মৈনাকরা বুঝল ওরা যে জ্যাম্বো আর গ্রে-র কথা বলেছিল তা মিথ্যা নয়। প্রতিবেশীদের সবাইকে ওরা জানালো বিটাই আর টুবলু কিভাবে আগলে রেখেছিল জ্যাম্বোকে, আর গ্রে কতো ভালো মানুষ।
পরদিন ওরা দু’জনে হাসপাতালে গ্রেকে দেখতে গেল। হাসপাতালের বিছানায় গ্রে একা একা শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ, ভেতরে ঢোকা বারণ, বড় অসহায় লাগছে। গ্রে-র অবস্থা ভালো নেই। মনটা খুব খারাপ বিটাই আর টুবলুর। চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। নিঃশব্দে কতো কথা বলে গেল গ্রের উদ্দেশ্যে।
ওরা প্রতিদিন একবার করে গ্রে-কে দেখতে যায় আর বাড়িতে ফিরে স্রষ্টা কাছে গ্রে-র জন্য প্রার্থনা করে, আরো প্রার্থনা করে ছোট্ট জ্যাম্বো যেন ভালো থাকে খুব।
সামনেই পরীক্ষা, পড়ায় মন দিতে হবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। ধীরে ধীরে প্রবেশ করে আবার আগের জীবনে। একটা ছুটির রবিবার ওরা দু’জনে আবার গ্রেকে দেখতে যায় কিন্তু কোথাও গ্রেকে দেখতে পায় না। অসুস্থ মানুষটা গেল কোথায়! সারা শরীরে তো কতো নল লাগানো ছিল, চোখ বন্ধ নির্জীব অসহায় মানুষটার ছবি মনে মনে কল্পনা করে ওরা দুজনে ব্যাকুল হয়ে উঠল। হাসপাতলে দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করল কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারল না। ছোট বলে কি গুরুত্ব দিচ্ছে না ওদের কথা, এতো ব্যস্ততা সবার! ভালো করে শুনতেই চাইছে না কোনো কথা। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। বড় অসহায় লাগছে ওদের। পড়াশোনায় মন নেই বলে সারাদিন সবার কাছে এমনিতেই বকা খাচ্ছে। তাই বাড়িতে এসব নিয়ে আর তেমন কিছু আলোচনা করে না।

একদিন বিকেলে ওরা আবার সেই নির্জন জায়গায় এসে বসে, জ্যাম্বোর ঘরটার খুব কাছাকাছি। ছোট্ট জ্যাম্বোর জন্য মনটা কেঁদে ওঠে। পুচকুটা এখন কি করছে, কি খাচ্ছে, কতো বড় হলো।
পরক্ষণেই চোখের সামনে ভেসে উঠল গ্রে-র হাসিভরা মুখটা। হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল মানুষটা কোথায় চলে গেল। বেঁচে আছে তো, নাকি …
না আর কিছু ভাবতে পারছে না। কেমন যেন একটা শূন্যতা কাজ করছে মনের ভেতর।
টুবলু বলে উঠল, ‘চল বিটাই বাড়ি চল, কি হবে আর মন খারাপ করে, মা চিন্তা করবে রে।’
ছলছল চোখে বিটাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

রাতে ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল বিটাই। ওরা দুজনে আবার গেছে জ্যাম্বো ফিরে এসেছে কিনা দেখতে। নীল চোখের ছোট্ট সোনাটা ওদের দেখে সেই কি খুশি। টুবলু ওকে কোলে নিয়ে যেই না আদর করছে অমনি পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘হ্যালো ফ্রেন্ডস তোমরা সবাই এখানে বসে কি করছো? এই যে আমি এসে গেছি?’
চমকে ওঠে ওরা দুজনেই ‘আরে গ্রে তুমি! ভালো হয়ে গেছো? কোথায় ছিলে তুমি? বলো কোথায় ছিলে?’
জানালা দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে বিটাইকে কখন যে স্পর্শ করেছে। তার সাথে মায়ের কোমল স্পর্শ। এ কী স্বপ্ন না সত্যি! কোনটা সত্যি আর কোনটা স্বপ্ন?
মা বললেন ‘রবিবার বলে এতো ঘুমোতে হবে? আর ঘুমের মধ্যে কার সাথে এতো কথা বলছিলিস? আজ বলে তোদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট? কখন থেকে বন্ধুরা ডাকাডাকি করছে। আর শোন টুবলু ফোন করেছিল, তোকে খুব দরকার কি একটা সারপ্রাইজ নাকি তোর জন্য অপেক্ষা করছে, ওঠ ওঠ।’
– সারপ্রাইজ!
– হ্যাঁ তাই তো বলল, অসাধারণ সারপ্রাইজ। বিটাই আবার অস্ফূষ্ট উচ্চারণ করলো ‘সারপ্রাইজ!’
তারপর বিছানা ছেড়ে এক দৌড়।
– আরে আরে মুখ না ধুয়েই কোথায় চললি? পাগল হয়ে গেলি নাকি?
– এক্ষুনি আসছি মা, চিন্তা করো না এক্ষুনি আসছি। এই বলে বিটাই উদভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগল টুবলুর উদ্দেশ্যে।

Share.

মন্তব্য করুন