রঞ্জুর পেটে ভাত পড়েনি আজ পুরো দু’দিন হলো। ভাতের বদলে লঞ্চঘাটের দোকানদারদের হাতে-পায়ে ধরে কলা-বনরুটি খেয়েছে। এতে পেটের ক্ষিধা কমলো না বরং বাড়লোই যেন। তারপরও একেবারে উপোস থাকার চেয়ে এটাও কম নয়!
রঞ্জুর মা কোথায় সে জানে না। তার মা-বাবার সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিলো সেই স্মৃতি এখন অনেকটা ঝাপসা হয়ে বাতাসে উবে যাবে যাবে অবস্থা। স্পষ্ট স্মরণ করতে পারে না সে। মায়ের নাম মাজেদা। বাবার নামটুকু স্মরণে আনতে স্মৃতির অলিগলি চষে বেড়াতে হয়। স্মৃতির গলিপথ শেষ হয় তবুও বাবার নাম মনে করতে পারে না সে। লোকজন তারে রঞ্জুর বাপ বলেই ডাকতো। মানুষের মুখে শোনা এই নাম ছাড়া সে আর কিছু মনে করতে পারে না। শৈশবে মায়ের কোল ছেড়ে আসা বালক আর কতটুকুই বা মনে রাখতে পারে!
শৈশবে সে কোথায় ছিলো, কিভাবে দিন কেটেছিলো? এসব এখন ধূসর ধুলায় মলিন হয়ে যাওয়া স্মৃতি। এই একটু মনে আছে, এই আর মনে নেই। স্মৃতির নদীতে সাঁতার কেটে কিছু শৈশবকাল মনে করতে পারে সে। একটা পুরনো রেলস্টেশন। লাল ইটের স্থাপনা। রেললাইন। তার দু’পাশে ছোট্ট ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর। ভিটেমাটিহীন মানুষগুলো এখানে এসে ঘর বাঁধে। খেয়ে না খেয়ে মানুষ এখানে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। পিঠ ঠেকানোর একটা জায়গা মানুষের প্রয়োজন। শত তালিজোড়া পলিথিন মোড়ানো ঝুপড়ি ঘরটাতে থাকতো তারা। রঞ্জু, তার মা-বাবা। তার কোনো ভাই-বোন নেই। তারপর আর মনে নেই রঞ্জুর। সে কিভাবে এই লঞ্চঘাটে এলো বলতে পারে না।
রঞ্জুর পরিচয় সে এখন টোকাই। লঞ্চঘাট টোকাইদের অন্যতম একজন। লস্কর, সাকি স্টোরের দোকানের পোলা আর পথচারীরা কথায় কথায় তার পিতৃপরিচয় জানতে চায়। রঞ্জু তাদের বলে, ‘আমার মুনে নাই স্যার! ভুইলা গেছি স্যার’! আর কোনো টোকাই জিগাইলে সে বলে, জানি না। আমারে জিগাইস না এসব কথা। সে আরেকটু চটে গিয়ে বলে, ‘খবরদার এসব কথা আর জিগাইলে চটকানা দিয়ে দাঁত ফালাইয়া দিমু’। টোকাইরা রঞ্জুকে ভয় পায়। অনুগত সৈনিকের মতো বলে, ‘আচ্ছা’।
রঞ্জু এবার শান্ত স্বরে বলে, ‘যে অতীত ভুলে গেছে তাকে কি তোরা বারবার জিজ্ঞাসা করে কষ্ট দিতে চাস? যে তার মা-বাবার পরিচয় ভুলে গেছে, যে মা-বাবার কোলে বড় হইতে পারে নাই, যাকে মা-বাবার ভালোবাসা বুঝে উঠার আগেই একা একা বড় হওয়ার, বেঁচে থাকার সংগ্রামে নামতে হইছে- তাকে তোরা বারবার সেইসব জিগায়া কষ্ট দিতে চাস ক্যান! আর জিগাইস না। কষ্ট লাগে। মনে পড়লে কান্দন আহে।’
এই টোকাইদের আয়ের উৎস হলো এই লঞ্চঘাট। লঞ্চের মাস্টার সুকানিরা তাদের ছোটখাটো কাজ দেয়। লঞ্চ ধোয়াপালার কাজে তাদের ডাকে। রঞ্জুকে টোকাইদের নেতা বলে মনে করে লঞ্চের মাস্টার সুকানি লস্করেরা। তাই তাকে বললেই হয়- ‘রঞ্জু, কাইল কাজ আছে। পোলাপাইন নিয়ে আসিস’। সেও পোলাপান নিয়ে হাজির হয়। এতে তার কিছু টাকা পয়সা জোটে।
আর এখন লঞ্চঘাট ধর্মঘটে বন্ধ। বন্ধ থাকলে লোকজনের জনসমাগম হয় না। লঞ্চ চলাচল করে না। যাত্রীরা পড়ে বিপদে। তারচেয়েও বড় বিপদ আসে রঞ্জুদের। লঞ্চঘাট বন্ধ থাকলে কাজ থাকে না। কাজ না থাকলে টাকা জোটে না। টাকা না থাকলে ভাত জোটে না। পেটে খাবার না পড়লে মানুষ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। বেড়ে যায় চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসীর মতো ভয়ঙ্কর কাজ। প্রায় ই ঠিকমতো পেটকে বুঝ দিতে না পারলে সুস্থ চিন্তাও করতে পারে না। সদাসর্বদা চিন্তা থাকে খাবার জোগাড় করার, পয়সা জোগাড় করার। এটা করতে গিয়ে তারা অপর মানুষের ক্ষতি, কষ্ট, দুর্ভোগের বিষয়টা চিন্তা করতে পারে না। চুরি, ডাকাতি এসব রঞ্জুর স্বভাবজাত অভ্যাসের সাথে যায় না। অন্যান্য টোকাইরা এইসব অপকর্ম নির্দ্বিধায় করতে পারে, এটা তাদের অভ্যাস।
রঞ্জু উপোস। কাজ নেই। হাতে টাকা নেই। পেটে ভাত নেই। দুর্ভোগে পড়া যাত্রীদের কাছে ব্যাগ ধরতে পারলে কিছু পয়সা জুটতে পারে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই সে ছুটে যায়। কিন্তু সেই সুযোগও দিচ্ছে না কেউই। তারপরও চেষ্টা তদবির করছে রঞ্জু। কিছু টাকাপয়সা জুটলে অন্তত পেটে কিছু দেয়া যাবে। নাহ, ব্যর্থ। যাত্রীদের মাথা খারাপ। তারা এতদূর এসে নদী পার হতে পারছেন না। কিছু স্পিডবোট আছে, তাও হাতেগোনা। আবার চড়া দামে ভাড়া নিতে হচ্ছে। এতে মধ্যবিত্ত আর গরিব যাত্রীরা পড়েছে আরো বিপাকে। গরিব যাত্রীরা গালাগাল করছে। মেজাজ তাদের তুঙ্গে। এমনিতেই পাঁচ-সাতবার গুনে এক টাকা খরচ করতে হয়। সেই জায়গায় এখন লঞ্চঘাটে এসে আবার ফিরে যাওয়া মাথা খারাপ হওয়ার মতোই, যা এমনিতেই খরচ হচ্ছে। বৃথা খরচ।
২.

রঞ্জুর পেটের ক্ষিধা তীব্র হচ্ছে। থেকে থেকে পেট মোচড় দিয়ে উঠছে। সাবের হোটেল থেকে দু’গ্লাস পানি খেয়ে আসা দরকার। কিন্তু সে যাবে কি যাবে না দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। এখন মধ্যদুপুর। হোটেলের ব্যস্ততা বেড়েছে। বাকি সব হোটেল বন্ধ। লঞ্চঘাটে শুধু সাবের হোটেলই খোলা আছে। দুর্ভোগে পড়া যাত্রীরা এখনো নদী পার হওয়ার আশায় বুক বেঁধে আছে। তারাই সাবের হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছে। হোটেলের বয় ছেলেদের দু’পা এক করার ফুরসত নেই। এর মধ্যে বিড়ালের মতো টুক করে পানি খেয়ে যে বের হয়ে যাবে সেই সুযোগ নেই। টোকাই ছেলেদের চেহারা দেখলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে ম্যানেজার।
সাবের হোটেলের সাথে রঞ্জুর সম্পর্ক নেই তেমন একটা। জাফর হোটেলের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে তার। ম্যানেজার জাফর চাচা ভালো মানুষ। যেকোনো মুহূর্তে তার হোটেলে যাওয়া যায়। মাঝে মাঝে থালা-বাসন ধোয়ার কাজও পাওয়া যায়। সমস্যা হচ্ছে, জাফর হোটেল বন্ধ। না হয় চিন্তাই করতে হতো না। জাফর চাচার শাশুড়ি মারা গেছেন গত পরশু। ছেলেপেলে বৌ-বাচ্চা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছেন তিনি। সেই দিন থেকেই জাফর হোটেল বন্ধ।

ক্ষিধা বেড়েই যাচ্ছে। খাবারের একটা ব্যবস্থা করা দরকার। সরগরম সাবের হোটেল। মানুষের ভিড় লেগেই আছে। একটা উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। রঞ্জু হোটেলের সামনে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। তার সামনে দিয়েই হোটেল থেকে লোকজন বের হয়ে যাচ্ছে। কোট-টাই পরা একলোক হোটেল থেকে খাবার নিয়ে যাচ্ছে। রঞ্জু আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, আমারে একটু খাবার দেন, আমি তিন দিন ধরে ভাত খাই নাই স্যার’। ভদ্রলোক রঞ্জুর কথা শুনেও না শোনার ভান করে দৃঢ় পায়ে হাঁটছে। রঞ্জু পিছু পিছু হাঁটছে আর কাতর কণ্ঠে বলছে, ‘পেটের ব্যথা আর সহ্য হয় না স্যার। খুউব কষ্ট লাগে স্যার। স্যার, একটু খাবার দেন স্যার’।
ভদ্রলোক খানিক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আরে বাবা। আমি আমার স্ত্রী আর মেয়ের জন্য খাবার নিচ্ছি’।
রঞ্জু আবার বলে, ‘স্যার, একটু খাবার দেন না স্যার’।
ভদ্রলোক একটু রুঢ় ভাষায় বলে, ‘বললাম না, বউ-বাচ্চার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। তোমারে কিভাবে দেবো? অন্য কোথাও দেখো’।
ভদ্রলোক হেঁটে চলে গেলো লঞ্চঘাটের দক্ষিণ পাশে। রঞ্জু হতাশ হয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো। নেতিয়ে পড়া শরীরটা আর ধরে রাখতে পারছে না। পেটের ব্যথায় কাবু হয়ে যাচ্ছে সে। এক পৃথিবী বেদনায় নীল হয়ে চোখ বুজে আসে তার। মাথাটা টনটন করছে। যেনো পৃথিবী উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।

৩.

রঞ্জু চোখ খুলে তাকিয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে। ভাত-তরকারির পলিথিন স্ত্রীকে দিচ্ছে। স্ত্রী হাতে নিয়েই চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। বলল, ‘এত্তগুলা ভাত কে খাইবো? আর তিনটা তরকারি আনা লাগে’?
ভদ্রলোক বললেন, ‘ক্যান, তোমরা খাইবা’!
স্ত্রী বলল, ‘তোমার মাইয়া কি ভাত খাইবো? জিগাও তোমার মাইয়ারে’?
ভদ্রলোক বললেন, ‘আচ্ছা, এতো চিল্লাচিল্লি কইরো না’।
মেয়ের দিকে আদরমাখা চোখে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘আম্মু, কী হয়েছে তোমার? তোমার জন্য আব্বু ভাত এনেছি, মাছ এনেছি। তুমি ভাত খাবে না’?
মেয়ে বলল, ‘না। খাবো না। আমি চিপস্ খাবো। আমাকে চিপস্ এনে দাও’।
ভদ্রলোক বলল, ‘চিপস্ খেলে তো পেট ভরবে না আম্মু। একটু করে ভাত খেয়ে নাও, তারপর চিপস্ খাবে। ঠিক আছে’?
মেয়ে বলল, ‘না, খাবো না, বললাম তো’।
স্ত্রী বলল, ‘নাহ, মেয়েটা ভাত খাবে না। যাও এক্ষুনি ফেরত দিয়ে আসো’।
ভদ্রলোক দারুণ বিব্রতবোধ করছেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। স্ত্রীকে বললেন, ‘খাবার ফেরত দেওয়া যাবে না। বাজে কথা বলো না। মেয়েকে দুয়েক লোকমা খাওয়াতে পারো কিনা দেখো’।
স্ত্রী বহু ঝক্কিঝামেলা করে অবশেষে দুয়েক লোকমা খাওয়াতে পেরেছে মেয়েকে। বাকিটুকু পলিথিন মুড়িয়ে বলল, ‘যাও, এসব ফেলে দিয়ে আসো’।
ভদ্রলোকের মাথায় কথাটা চট করে লাগলো, এই খাবার ফেলে দেবো? খাবারগুলো আনতে আনতেই একটা ছেলে কত আকুতি মিনতি করল, তাকে একটু খাবার দেওয়ার জন্য। অথচ আমি তাকে খাবার দেইনি তোমাদের কম হওয়ার শঙ্কায়।
পলিথিন হাতে নিতে নিতেই ভাবলো, অন্তত এই খাবারগুলোও যদি দিতে পারি তাতেও ছেলেটা খুশি হবে হয়তো। চিন্তার জটিলতা কমছেই না। এখন ছেলেটাকে কোথায় পাবে?
হোটেলের দিকে ভালো করে নজর বুলাতে লাগলো ছেলেটাকে দেখা যায় কিনা। হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগোচ্ছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটি খাবারের দিকে।
কাছাকাছি আসতেই ভদ্রলোক দেখলেন ছেলেটার দু’গাল বেয়ে অশ্রুজল নামতে নামতে দাগ পড়ে গেছে। চোখ লাল হয়ে গেছে। ক্লান্ত শরীর। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে সে।
রঞ্জু ক্ষুধায় কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। চোখও বুজে আসতে চায় অবলীলায়। অবশ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যেনো তিন দিন ধরে উপোস রঞ্জুর খাওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। প্রয়োজন নেই কোনো ভাতের।
ভদ্রলোক রঞ্জুকে দেখে আঁতকে উঠলো। চরম অপরাধবোধে গিলে খাচ্ছে তাকে। ‘কী রকম কষ্টই না পেলো ছেলেটা’ বলতে বলতে চোখ ভারী হয়ে গেলো তার। বেঁচে যাওয়া খাবারের পলিথিন রঞ্জুর পাশে রাখলো। মাথায় হাত রাখতেই চমকে উঠলো সে। চোখ মুছে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমার জন্য একটু খাবার এনেছি। খাও’।
রঞ্জু চোখ নামাতেই ক্ষিধের টের পায়। পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে। চোখের অশ্রু ঝরছে আবার, যেমন করে মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে আসে।
রঞ্জু এই এতটুকু ভাত খেয়েই পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে গেলো। ভুলে গেলো সবটুকু যন্ত্রণা। ভুলে গেলো সে ভদ্রলোকটার কাছ থেকে খাবার চাওয়ার পরও না পাওয়ার কষ্টের কথা। সব ব্যথা ভুলে ভদ্রলোককে দু’বার সালাম করলো রঞ্জু। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সাবের হোটেলের দিকে চলে যাচ্ছে সে; যতটুকু তৃষ্ণা ততটুকু পানির আশায়।

Share.

মন্তব্য করুন