রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনা নিয়ে ফুটবল ভক্তদের মাঝে উন্মাদনা সারা বিশ্বেই আছে। ভক্তদের কাছে এই ক্লাব দু’টির মতো তাদের স্টেডিয়াম নিয়েও আছে আগ্রহ। রিয়াল-বার্সা নিয়ে ভক্তদের ভালোবাসা, আবেগ আর ফুটবল উত্তেজনার সাথে জড়িয়ে আছে দুটি স্টেডিয়ামের নাম। কোন স্টেডিয়ামটি বেশি সুন্দর সেটি নিয়েও আছে বিতর্ক। চলো জেনে আসি বিখ্যাত দুই ক্লাবের নিজস্ব স্টেডিয়াম বা হোম ভেন্যু সম্পর্কে।

সান্তিয়াগো বার্নাব্যু

রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়ামটির নাম সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। রিয়ালের নিজস্ব স্টেডিয়াম হলেও স্পেনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাচও আয়োজন করা হয়। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত স্টেডিয়ামটি। সাবেক ফুটবলার ও ক্লাবটির সাবেক প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু রিয়ালের সাবেক স্ট্রাইকার। ১৯১১ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত রিয়ালের হয়ে খেলে ৭৯ ম্যাচে করেছেন ৬৮ গোল। তবে তার চেয়েও বড় ভূমিকা তিনি রেখেছেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে (১৯৪৩-১৯৭৮)। ফুটবল বিশ্বে রিয়াল মাদ্রিদের আজকে যে অবস্থান তার নেপথ্যের নায়ক তিনি।
শুরুর দিকে রিয়াল মাদ্রিদ খেলতো ক্যাম্পো ডি ও’ডনেল নামের একটি মাঠে। ১৯২৪ সালে খেলতে শুরু করে ক্যাম্পো ডি শামার্টিন মাঠে; কিন্তু এর গ্যালারি ছিলো ছোট। বার্নাব্যু রিয়ালের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর উদ্যোগ নেন নতুন ও আধুনিক একটি স্টেডিয়াম তৈরির, যেখানে অন্তত এক লাখ রিয়াল সমর্থক খেলা দেখতে পারবে।
শামার্টিন স্টেডিয়ামের পাশেই নতুন জায়গা কিনে ১৯৪৫ সালে শুরু হয় নির্মাণকাজ। ১৯৪৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি প্রীতি ম্যাচ দিয়ে উদ্বোধন করা হয় স্টেডিয়ামটি। শুরুতে নতুন শামার্টিন স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত ছিলো এটি। ৮ বছর পরে ক্লাব প্রেসিডেন্টের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এর নামকরণ করা স্টাডিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যু।
মাঠের দৈর্ঘ্য ১০৫ মিটার, প্রস্থ ৬৮ মিটার। শুরুতে সান্তিয়াগো বার্নব্যুর গ্যালারি ছিল দুই স্তরবিশিষ্ট, যার ধারণক্ষমতা ছিলো ৭৫ হাজার দর্শক। চেয়ার ছিলো ২৭ হাজার ৬০০, আর দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে পারতো ৪৭ হাজার ৫০০ জন দর্শক। ১৯৫৪ সালে এক পাশের গ্যালারি তিন স্তরবিশিষ্ট করা হয় এবং ধারণক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ২৫ হাজার।
১৯৮২ সালের বিশ্বকাপকে সামনে রেখে অর্ধেক গ্যালারিতে চেয়ার বসানো হয়। ফলে দর্শক ধারণক্ষমতা নেমে আসে ৯০ হাজার ৮০০ জনে। ১৯৯০ এর দশকে উয়েফা পুরো স্টেডিয়ামে চেয়ার বসানোর নির্দেশ দিলে ধারণক্ষমতা কমে আসে ৫৫ হাজারে; কিন্তু দর্শকের চাপ সামলাতে তা যথেষ্ট ছিলো না। যে কারণে চারদিকের গ্যালারিই তিন স্তরবিশিষ্ট করা হয়। চারকোনায় চারটি প্রবেশ টাওয়ার যুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালে সবদিকের গ্যালারির ওপর ছাদ যুক্ত করা হয়। ধারণক্ষমতা দাঁড়ায় ৮১ হাজার ৪৪ জনে।
স্টেডিয়ামটি ২০২১ সাল পর্যন্ত চারটি ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল আয়োজন করেছে। এছাড়া ১৯৬৪ ইউরো ও ১৯৮২ বিশ^কাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় এখানে।
২০১৭ সালে স্টেডিয়ামটির বাইরের নকশা বদলে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ছাদ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই ছাদ অবশ্য চাইলেই সরিয়ে ফেলা যায়। এছাড়া হসপিটালিটি সুবিধা, খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফদের বাসস্থান সুবিধাসহ অনেক কিছুতে পরিবর্তন আনা হয়। এছাড়া রেস্টুরেন্ট, বার, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভিআইপি সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি বাড়ানো হয়। এই সংস্কারকাজের ব্যয় ধরা হয় ৫২৫ মিলিয়ন ইউরো। যার ফলে সম্পূর্ণ নতুন চেহারা পায় সান্তিয়াগো বার্নাব্যু।
ম্যাচের দিন ছাড়া অন্য যে কোন দিন ২৫ ইউরোর ফি দিয়ে যে কেউ স্টেডিয়ামটি ঘুরে দেখতে পারে। এই ট্যুরে গ্যালারি ছাড়াও ডাগআউট, প্রেসিডেন্সিয়াল বক্স, প্রেস রুম ঘুরে দেখা যাবে। ট্রফি রুমে গেলে দেখা যাবে রিয়াল মাদ্রিদের জেতা সারি সারি ট্রফি। আছে কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী।

ক্যাম্প ন্যু

স্পেনের কাতালোনিয়া অঞ্চলের বন্দরনগরী বার্সেলোনার ক্লাব এফসি বার্সেলোনা। এই নগরীর কিছুটা বাইরে অবস্থিত স্টেডিয়াম ক্যাম্প ন্যু।
ক্যাম্প ন্যুয়ের দর্শক ধারণক্ষমতা সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর চেয়ে কিছু বেশি। ধারণক্ষমতার দিক থেকে স্পেনেরও সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম এটি। আর সারা বিশে^ ফুটবল স্টেডিয়ামের মাঝে চতুর্থ। এখানে এক সাথে খেলা দেখতে পারেন ৯৯ হাজার ৩৫৪ জন দর্শক।
মাঠের দৈর্ঘ্য ১০৫ মিটার, প্রস্থ ৬৮ মিটার। মাঠে লাগানো হয়েছে গ্রাসমাস্টার নামের এক প্রকার হাইব্রিড ঘাস। এর আগে বার্সেলোনার হোম ভেন্যুর নাম ছিলো ক্যাম্প ডে লেস কোর্টস। সেটিতে দর্শক ধারণক্ষমতা কম থাকায় নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। যার নির্মাণকাজ ১৯৫৪ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৫৭ সালে।
১৯৮২ বিশ^কাপের সময় স্টেডিয়ামের দুই স্তরবিশিষ্ট গ্যালারিকে তিন স্তরে রূপ দেয়া হয়। যার ফলে ধারণক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ২৫ হাজার। ৭৩ হাজার দর্শকের জন্য চেয়ার এবং এছাড়াও ৫০ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে পারতো। ওই সময় প্রেসিডেন্ট বক্স, ভিআইপি লাউঞ্জ, প্রেস রুম যুক্ত করা হয়। ওই বিশ^কাপে আর্জেন্টিনা-বেলজিয়ামের উদ্বোধনী ম্যাচ আয়োজন করে স্টেডিয়ামটি। এছাড়াও একটি সেমিফাইনালসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ এর দশকে স্টেডিয়ামের সবগুলো গ্যালারিতে চেয়ার যুক্ত করা হলে ধারণক্ষমতা কমে আসে ৯৯ হাজারে।
এখন পর্যন্ত দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল, একবার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ, একবার অলিম্পিক ফুটবলের ফাইনাল আয়োজন করেছে ক্যাম্প ন্যু। এছাড়া ২১ বার স্প্যানিশ সুপারকাপ ফাইনাল, চারটি কোপা ডেল রে ফাইনালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আয়োজন হয়েছে এখানে।
ম্যাচের দিন ছাড়া সপ্তাহে সাত দিন দর্শকরা ২৪ দশমিক ৫ ইউরো ফি দিয়ে ক্যাম্প ন্যু স্টেডিয়াম ও সেই সাথে বার্সেলোনা জাদুঘর ঘুরে দেখার সুযোগ পায়। বার্সেলোনার ফুটবল ইতিহাসের নানা স্মারক ও প্রিয় তারকাদের পদচিহ্ন পড়া জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে প্রতিদিন ভিড় করেন দেশ-বিদেশের অনেক ফুটবল ভক্ত।

Share.

মন্তব্য করুন