শুরুতেই একটা কুইজ! সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি ফেলুদার কোন গল্পে হাউসবোটের কথা আছে? উত্তরটা পরে দিচ্ছি, তার আগে তোমরা একটু ভাবতে থাকো। এই ফাঁকে ভারতের হাউসবোটের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
হাউসবোট হলো নৌকায় তৈরি ঘর। অর্থাৎ একটা ঘর কিন্তু সেটা নৌকার আদলে তৈরি এবং পানিতে ভাসমান- এটাই হাউসবোট। সাধারণভাবে বাসাবাড়িতে যে সকল সুযোগ সুবিধা থাকে, হাউসবোটেও সেগুলো বিদ্যমান। আমাদের দেশের বেদে নৌকার সাথে এর কোনো মিল নেই। কারণ বেদেদের নৌকাগুলো নৌকাই, ওখানে তারা বাস করে। অন্যদিকে হাউসবোটে বেডরুম, ড্রইং রুম, ডাইনিং, টয়লেট ইত্যাদি যেমন থাকে, এসকল রুমের আনুষঙ্গিক আসবাবপত্রও থাকে। তাছাড়া বেদে বহরের নৌকাই তাদের চিরস্থায়ী আবাসস্থল, অন্যদিকে হাউসবোট মূলত স্বল্প সময়ের জন্য বসবাসের জায়গা।
পৃথিবীর অনেক দেশেই হাউসবোটের দেখা পাওয়া যায় কিন্তু হাউসবোটের কথা উঠলেই সবার আগে আমাদের পাশের দেশ ভারতের কথা আসবে কারণ ভারতের হাউসবোটগুলো পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্যস্থল। বিশেষ করে, হাউসবোটে ভ্রমণ না করলে দক্ষিণ ভারতের কেরালা ভ্রমণ যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
অঞ্চলভেদে হাউসবোটগুলোর নকশা, আকৃতি-প্রকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। একইভাবে ভেসে থাকার নিয়মেও বিভিন্নতা রয়েছে। কিছু অঞ্চলের হাউসবোটগুলো নদী বা লেকের পানিতে ভেসে ভেসে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যায় এবং ফিরে আসে। আবার কিছু হাউসবোট স্থির। সেগুলো ডাঙ্গা থেকে একটু দূরে পানিতে নোঙর করা অবস্থায় থাকে। কখনও তীরে খুঁটির সাথে বাঁধা থাকে। যে কোন প্রয়োজনে তীর থেকে ঘুরে আসা যায়। স্থির হোক বা চলমান, একটা বিষয় সকল ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা হয়- পানিতে যেন জোয়ার ভাটা না হয় এবং পানি যেন সর্বদা স্থির বা নিশ্চল থাকে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণের ক্ষেত্রে হাউসবোট পর্যটকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ। এক্ষেত্রে এক নম্বর অবস্থানে আছে দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্য। কেরালার হাউজবোটগুলো অত্যন্ত স্বল্প গতিতে পানিতে ভেসে চলে। এই হাউসবোটগুলো মূলত কেরালার বিশেষ এক ধরনের নৌকার আধুনিক সংস্করণ। একে বলা হয় কেট্টুভাল্লাম। ভাল্লাম মানে নৌকা আর কেট্টু মানে হলো দড়ি দিয়ে বাঁধা। অর্থাৎ কেট্টুভাল্লাম হলো দড়ি দিয়ে বাঁধা নৌকা। আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগেও এই নৌকাগুলো ধান, চাল বা অন্যান্য উপকরণ বহন করার কাজে ব্যবহার করা হতো। নৌকার এক প্রান্তে বাঁধা রশির অন্য প্রান্ত থাকতো নদীর তীরে একদল মানুষের হাতে। তারা রশি ধরে নৌকাটিকে টেনে নিয়ে যেত। এই থেকে কেট্টুভাল্লাম নামের কারণ বোঝা যায়।
এই একই পদ্ধতিতে আমাদের এই বাংলাদেশেও নৌকা টেনে নেয়া হতো। একে বলা হয় গুণ টানা নৌকা। মূলত যখন দাঁড় টানা নৌকা প্রচলিত ছিল এবং মালবাহী নৌকা যখন দাঁড় টেনে চালানো কষ্টকর হতো তখনই নৌকায় গুণ টানা হতো।
কেরালার কেট্টুভাল্লাম বিশাল আকৃতির নৌকা ছিল যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ছিল ষাট থেকে সত্তর ফুট, প্রস্থ ছিল পনেরো ফুট বা তার কিছু বেশি। ফলে ইঞ্জিনচালিত নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ ইত্যাদির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় কেট্টুভাল্লাম বাতিল হয়ে পড়ে। তখন কেট্টুভাল্লামের এই ব্যতিক্রম ব্যবহার শুরু হয় এবং পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত করা হয়। বর্তমানে এই কেট্টুভাল্লাম পর্যটকদের নিরিবিলিতে কিছু সময় কাটানোর অন্যতম প্রিয় আকর্ষণ। আলাপ্পুজা, ভেমবানাদ, কল্লাম ইত্যাদি হলো এমন কিছু জায়গা যেখানে হাউসবোটে ভ্রমণ করা যায়।
কেরালার পরেই ভারতের জম্মু-কাশ্মির হাউসবোটের জন্য বিখ্যাত গন্তব্য। কাশ্মিরের ডাল লেক আর নাগিন লেকের হাউসবোটগুলো স্থির। অর্থাৎ তীর থেকে কিছু দূরে নোঙর করা বা খুঁটিতে বাঁধা থাকে। এখানকার কিছু হাউসবোট আছে যেগুলোর বয়স একশ বছরেরও বেশি। রাজকীয় এই হাউসবোটগুলো কাঠের তৈরি এবং বিশাল আকৃতির। কোন কোন হাউসবোটে তিনটি বেডরুম, লিভিং রুম, মাছ ধরার জন্য বারান্দা ইত্যাদি রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় এই হাউসবোটগুলোকে বলা হয় শিকারা। এই শিকারা কাশ্মিরের সংস্কৃতির পরিচায়ক। শুরুতেই যে প্রশ্নটি করেছিলাম তার উত্তর এখানে দিচ্ছি। ফেলুদার যে গল্পে হাউসবোটের কথা বলা আছে তার প্রেক্ষাপট এই কাশ্মিরেই। ডাল লেকের উপর একটি হাউসবোটে ছিলেন ফেলুদা-তোপসে-জটায়ু আর পাশের আরেকটি হাউসবোটে ঘটে যাওয়া একটি খুনের রহস্য সমাধান করেছিলেন প্রখর বুদ্ধির এই বাঙ্গালি গোয়েন্দা। বইয়ের নাম ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর’।
যদি কেরালা বা কাশ্মিরের হাউসবোটে বেড়ানো ব্যয়বহুল মনে হয় তাহলে বাংলাদেশের ঠিক পাশেই অবস্থিত আসামের হাউসবোটে বেড়ানো যেতে পারে। আসামের হাউসবোটে বেড়ানোর প্রধান আকর্ষণ হলো আশপাশের পাহাড়ি পরিবেশ, পাখপাখালি, ডলফিন ইত্যাদি। তবে আসামের হাউসবোট কিন্তু কেরালা-কাশ্মিরের হাউসবোটের মতো ঐতিহ্যম-িত নয়। এরকম আরও হাউসবোট আছে গোয়া, মহারাষ্ট্র, পন্ডিচেরী, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানে। তবে এখানে হাউসবোটের তুলনায় রিভার ক্রুজের সুযোগ বেশি এবং হাউসবোটগুলো কেরালা-কাশ্মিরের হাউসবোটের অনুকরণ মাত্র।
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগবে- হাউসবোটে ভ্রমণ কত সময়ের জন্য হয়? হাউসবোটগুলো ভাড়া দেয়া হয় ফলে একদিন থেকে শুরু করে সাতদিন বা পনেরো দিনের প্যাকেজে ভাড়া নেয়া যায়। ডাল লেকের হাউসবোটগুলো যেহেতু স্থির, তাই এগুলো হোটেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং সারাদিন কাশ্মির বেড়িয়ে হাউসবোটে রাত্রিযাপন করার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, কেরালার হাউসবোটগুলোতে গন্তব্যের দূরত্ব আর সময় দু’ভাবেই ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। কেবলমাত্র সামান্য সময়ের জন্য বেড়ানোর জন্য ছোট কিছু হাউসবোট আছে যেগুলোতে ছয়-আটজন বসা যায় এবং অন্য কোন সুবিধা নেই।
ভারতের এই হাউসবোটের আইডিয়া কি আমাদের বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব? অথচ এই অঞ্চলের নদীতে একসময় জমিদারদের বজরা চলতো, সেগুলো তো এক প্রকার হাউসবোটই, নাকি? কালের বিবর্তনে এইসব বজরা হারিয়ে গেছে। কিন্তু উদ্যোগ নিলে হয়তো এই ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে। তোমাদের কেউ কি বড় হয়ে এই উদ্যোগ নেবে?

Share.

মন্তব্য করুন