মহাবিশ্বের অন্তিম মুহূর্তে কী ঘটবে? প্রশ্নটি অবশ্যই প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্নভাবে চিন্তাশীলদের মনে এসেছে। প্রশ্নটি এমনও হতে পারে যে মহাবিশ্ব ও মানব সভ্যতার চূড়ান্ত পরিণতি কী হতে পারে? কেবল গত দুই-তিন দশকে এ ধরনের প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দেয়ার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাবিশ্বতত্ত্ব প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। আমি চেষ্টা করবো বর্তমানে অর্জিত জ্ঞানের প্রেক্ষিতে এর উত্তর দিতে।
মহাবিশ্বের সম্ভাব্য চূড়ান্ত পরিণতি নির্ভুলভাবে জানতে হলে মহাবিশ্বের বর্তমান কাঠামো এবং মহাবিশ্ব বর্তমান অবস্থায় কিভাবে এসেছে তা বোঝা প্রয়োজন। মহাবিশ্বের মৌলিক উপাদানগুলো বিবেচনা করার সময় বড় আকারের কাঠামোগুলোকে গ্যালাক্সি হিসাবে ধরে নেয়া যেতে পারে (চিত্র-১); যা মহাশূন্যের মাঝে তারকার দ্বীপের ন্যায়। একটি সাধারণ ছায়াপথ ১০০ বিলিয়ন (১০১১) তারকা (যেমন-সূর্য) দ্বারা গঠিত যারা পারস্পরিক মহাকর্ষ বল দ্বারা একসাথে আবদ্ধ। আমরা যে ছায়াপথে বাস করি (সূর্য ও এর গ্রহগুলো নিয়ে গঠিত অংশকে সৌরজগৎ বলা হয়) তাকে মিল্কিওয়ে ছায়াপথ বলা হয়। এই বিশ্বজগৎকে মূলত ছায়াপথের সমষ্টিও বলা যায়, যা পর্যবেক্ষণযোগ্য ও অবশিষ্ট উপাদানগুলো কার্যত এর সাথে সংশ্লিষ্ট। স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যে, ছায়াপথগুলো সময়ের সাথে মহাবিশ্বে সুষম হারে বিস্তৃত হচ্ছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে যে, ছায়াপথগুলো স্থির নয় বরং গতিশীল এবং এরা একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। একে অপরের থেকে ছায়াপথগুলোর এরূপ দূরে সরে যাওয়াকে উল্লেখ করা হয় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হিসাবে। যে হারে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে তা থেকে এটি অনুমান করা যায় সমস্ত ছায়াপথ অবশ্যই ১০-২০ বিলিয়ন বছর আগে খুব কাছাকাছি সংযুক্ত ছিলো। ধারণা করা হয় যে, সেসময় একটি মহাজাগতিক বিস্ফোরণ হয়েছিলো এবং পদার্থগুলো তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। পরবর্তীতে পদার্থগুলো ঘনীভূত হয়ে গুচ্ছে পরিণত হয় ও ছায়াপথের রূপ নেয়। মহাজাগতিক বিস্ফোরণ বা ‘বিগ ব্যাং’ এর ফল হিসেবে এখনো ছায়াপথগুলো দূরে সরে যাচ্ছে।
মহাজগতের সম্প্রসারণ কি চিরকাল অব্যাহত থাকবে নাকি এটি একটি নির্দিষ্ট আকৃতি লাভ করবে তা মহাজাগতিক বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর উত্তর এখনো নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। মহাজাগতিক যে মডেলে এর অব্যাহত সম্প্রসারণ ধরা হয় তাকে ‘উন্মুক্ত মহাবিশ্ব’ বলে। অন্যদিকে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধির পর সঙ্কোচন শুরু হয় তাকে ‘বদ্ধ মহাবিশ্ব’ বলে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে যে, আমরা কি মুক্ত না বদ্ধ মহাবিশ্বে বাস করি? মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ভর করছে এর উত্তরের উপর। কিছু ইঙ্গিত রয়েছে যে, মহাবিশ্ব উন্মুক্ত। তবে এটি কোনোভাবেই নিষ্পত্তি হয়নি।

উন্মুক্ত মহাবিশ্ব হলে এর পরিণতি কি হবে?

যেহেতু মহাবিশ্বের মূল উপাদানগুলো ছায়াপথ, তাই আমরা উন্মুক্ত মহাবিশ্বের একটি সাধারণ ছায়াপথের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ে কী ঘটবে তা থেকে মহাবিশ্বের পরিণতি নির্ণয় করতে পারি। একটি সাধারণ ছায়াপথ বিবেচনা করুন। এটি প্রধানত তারকা দিয়ে গঠিত। তারকাগুলো সময়ের সাথে বিবর্ধিত হয় ও অবশেষে মারা যায়। অর্থাৎ তারকাগুলো একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই এদের বিবর্তন ঘটে। এটি ঘটতে ১০০ বিলিয়ন বছর প্রয়োজন।
তারকাদের তিনটি চূড়ান্ত পর্যায় রয়েছে; এরা হলো সাদা বামন, নিউট্রন তারকা ও কৃষ্ণগহ্বর। সংক্ষেপে বলা যায়, এগুলো হলো এমন পর্যায় যখন পদার্থ খুব ঘনভাবে সঞ্চিত থাকে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরের। উপযুক্ত সময় পর ছায়াপথের সব তারকা মারা যাবে; যা সাদা বামন, নিউট্রন তারকা ও কৃষ্ণগহ্বরের চূড়ান্ত পরিণতি। এ তিন পর্যায়ের তারকাগুলোকে আমরা মৃত তারকা বলে উল্লেখ করে থাকি। এ প্রক্রিয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় হলো ১০০-১০০০ বিলিয়ন বছর বা আরো বেশি। এভাবে প্রায় ১০০০ বিলিয়ন বছরের মধ্যে মৃত তারকা এবং নক্ষত্রমণ্ডলীয় পদার্থে ছেয়ে যাবে ছায়াপথ। এর মধ্যে তারকাগুলো গ্রহ, গ্রহাণু ও বিভিন্ন পদার্থের আকারে থাকবে এবং তখনো পারস্পরিক মহাকর্ষ বল দ্বারা একসাথে আবদ্ধ থাকবে। বিভিন্ন ছায়াপথ তখনো একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। ফলে তখন ছায়াপথগুলোর গড় দূরত্ব বর্তমানের থেকে অনেক বেশি হবে।
আরো বৃহৎ কোন সময়ের মানদণ্ডে ছায়াপথের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটবে, যেখানে তারকাগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে যথেষ্ট পরিমাণে মৃত তারকা একত্রে ছায়াপথ থেকে নিক্ষিপ্ত হবে। এভাবে প্রায় বিলিয়ন বিলিয়ন (১০১৮) বা বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন (১০২৭) বছরে ৯৯% মৃত তারকা ছায়াপথ থেকে নির্গত হবে। বাকি ১% মৃত তারকা খুব ঘনভাবে সন্নিবেশিত হয়ে একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে যার ভর হবে প্রায় ১ বিলিয়ন সূর্যের ভর। আমরা একে বলতে পারি ‘ছায়াপথের কৃষ্ণগহ্বর’। প্রক্রিয়াকে ছায়াপথের গতীয় বিবর্তন বলে চিহ্নিত করা যায়।
আমি মৃত তারকাগুলোর তিনটি চূড়ান্ত দশা বর্ণনা করেছি যার পরিবর্তন ঘটতে প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর লাগবে। যখন সময় বিলিয়ন বছর এর বেশি বিবেচনা করা হয় তখন এই চূড়ান্ত পর্যায়ে পরিবর্তন হয়। বাস্তবে একটি সূর্যের সমপরিমাণ ভরের কৃষ্ণগহ্বরে প্রতি মিনিটে যে পরিমাণ বিকিরণ হয় তাতেও এর ভর হারাতে থাকে। সূর্যের ভরের একটি কৃষ্ণগহ্বরের পুরোপুরি অদৃশ্য হতে ১০৬৫ বছর লাগবে। অন্যদিকে, একটি ছায়াপথ কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে অনেক কম সময় লাগবে। কৃষ্ণগহ্বরের এই ধরনের বিকিরণ তাৎপর্যপূর্ণ নয় যখন ছায়াপথ গতীয় বিবর্তন লাভ করে। যাই হোক, একবার এরূপ ছায়াপথের কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়ে গেলে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে এটি কি চিরস্থায়ী হবে নাকি এরও পরিবর্তন ঘটতে পারে? আবার একটি ছায়াপথের কৃষ্ণগহ্বর বাষ্পে পরিণত হতে ১০৯০ বছর লাগতে পারে। একটি মহা ছায়াপথের কৃষ্ণগহ্বর, যা ছায়াপথের বৃহৎ গুচ্ছের সংঘর্ষে তৈরি হয়েছে, সম্পূর্ণ বাষ্পীভূত হতে ১০১০০ বছর সময় লাগবে। এভাবে প্রায় ১০১০০ বছরের মধ্যে সকল কৃষ্ণগহ্বর অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং মহাবিশ্বের সকল ছায়াপথ বিলীন হয়ে যাবে। মহাবিশ্ব তখন ছেয়ে যাবে দলছুট নিউট্রন তারকা, সাদা বামন ও অসংখ্য ক্ষুদ্র পদার্থে যেগুলো ছায়াপথের গতীয় বিবর্তনের সময় নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো। মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান শূন্যতার মাঝে এসব মৃত তারকা ও পদার্থের টুকরাগুলো এককভাবে বিচরণ করবে।
অবশিষ্ট পদার্থে কিছু ধীর ও সূক্ষ্ম পরিবর্তন হবে যার সময়কাল হবে প্রায় ১০১০০ বছর। অবশিষ্ট পদার্থগুলোর চূড়ান্ত পরিণতি কি হবে? এখন আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আসি পদার্থের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিয়ে, যার উত্তর এখনো জানা যায়নি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আইনের আলোকে একটি সম্ভাবনা এরূপ যে, সাদা বামনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃষ্ণগহ্বরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে ও পরবর্তীতে বাষ্পীভূত হবে। সময় স্কেলে এর জন্য লাগবে ১০৭৬ বছর (যদি আমি শব্দটিকে বিলিয়নের বিলিয়ন গুণ ধরি, তবে তা হবে ১০৭৬ বছরের সমতুল্য)।
উন্মুক্ত মহাবিশ্বে মানব সভ্যতা ও জীবনের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব কিরূপ হতে পারে? এর ভবিষ্যদ্বাণী করা প্রায় অসম্ভব যে জীবসত্তাগুলো কোন রূপে ভবিষ্যতে টিকে থাকবে। যাই হোক, সভ্যতা ও জীবনের টিকে থাকা নির্ভর করে শক্তি উৎসের পর্যাপ্ত প্রাপ্তির উপর, যা পরবর্তী সময়ে একজন আলোচনা করতে পারবে। অন্তত তত্ত্বের আলোকে এটা বলা যায়, প্রায় ১০১০০ বছর পর্যন্ত পর্যাপ্ত শক্তি থাকবে। এ সময় পর সভ্যতাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি নিয়ে অনির্দিষ্টকাল টিকে থাকতে হবে। এটি একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন।
উপরের ছবিটি নির্দেশ করে সম্ভাব্য উন্মুক্ত মহাবিশ্ব। মহাবিশ্ব বদ্ধ হলে কী হবে? ধরুন, মহাবিশ্ব এমনভাবে বদ্ধ মহাবিশ্বে পরিণত হয় যখন তার সর্বোচ্চ সম্প্রসারণ হলো- বর্তমানে বিদ্যমান আন্তঃছায়াপথের দূরত্বের দ্বিগুণ। তাহলে সর্বোচ্চ সম্প্রসারণ হতে প্রায় ৪০-৫০ বিলিয়ন বছর লাগবে। মহাবিশ্ব সর্বোচ্চ সম্প্রসারণ শেষে পুনরায় একই হারে সংকুচিত হবে, যেমন সিনেমা পেছনে টানা যায়। কিন্তু ৯০-১১০ বিলিয়ন বছর পর মহাবিশ্ব কেমন হবে? মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি হবে খুবই ঘন ও উত্তপ্ত এবং তারপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে, যেখানে বিভিন্ন জ্বলন্ত পদার্থ কেন্দ্রীভূত হবে। এক্ষেত্রে কোন জীবসত্তার টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণের পর কী ঘটবে বা এরপর কিছু আছে কিনা তা জানা যায়নি।
আমার মনে হয় এটা বলা উচিত যে, মহাবিশ্বের আদর্শ মডেল সঠিক বলে অধিকাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন। অবশ্য অল্পসংখ্যক বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের অন্য মডেল মেনে চলে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো যে, ব্যতিক্রমী মডেলগুলোর একটি, স্থির পর্যায় তত্ত্ব। এখনো কোন কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কিছু শক্তিশালী তত্ত্ব ও পরোক্ষ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও কিছু সম্মানিত বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না, কিন্তু মহাকর্ষ তত্ত্বে বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই এর উপস্থিতি বিশ্বাস করেন। এখানে আমরা ধরে নিচ্ছি যে, কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। কিছু বিজ্ঞানী উল্লেখ করেছেন প্রোটন, যা সকল পদার্থের উপাদান, দীর্ঘসময়ের সাপেক্ষে অস্থিতিশীল। কিছু পদার্থবিদ অনুমান করেন যে, সকল প্রোটনই ভেঙে যাবে।
এই সম্ভাবনা মহাবিশ্বের সুদূর ভবিষ্যতের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। কেন মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত? এই প্রশ্নের একটি উত্তর হলো মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণের প্রশ্নের অনুরূপ। কারণ সমস্যা বিদ্যমান এবং মানুষের মনের স্বভাব হলো অবিরাম জ্ঞানের নতুন ক্ষেত্রে অনুসন্ধান করা।
মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি একটি আকর্ষণীয় সমস্যা, যা ক্ষুদ্র কিছু নয়। কারণ আমরা এই বইতে দেখবো যে, এটি পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান এবং জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে, যার উত্তর জানা গেলে এসব ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হবে।
[লেখাটি পৃথিবী বিখ্যাত বাংলাদেশী বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব ইউনিভার্স’ গ্রন্থের ভূমিকা থেকে নেয়া।

Share.

মন্তব্য করুন