বৃষ্টি পড়ছে। ছোট ছোট অজস্র পানির ফোঁটারা ঝরে পড়ছে। রাস্তাঘাটগুলোর ধুলো ময়লা ধুয়ে নিচ্ছে। গাছগুলোকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে।
ঝমঝমাঝম বৃষ্টি পড়ে
গাছের পাতা নড়ে চড়ে
টুনটুনিরা মনের সুখে
ভিজছে দেখ কেমন করে!
জানালা দিয়ে, কিংবা বারান্দা দিয়ে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, পাখির ছানারা খোলা মাঠে বৃষ্টির পানিতে লুটোপুটি করছে, পাখা ঝাপটিয়ে কবুতরগুলো বাক-বাকুম বাক-বাকুম শব্দে মনের আনন্দে গোসল করছে। বৃষ্টির ফোঁটা যখন গাছের পাতায় পড়ছে তখন গাছের পাতারা কেঁপে কেঁপে উঠছে। দেখতে তখন খুবই ভালো লাগে। বৃষ্টি আমাদের এই শহরে দেখতে একরকম আর গ্রামে আরেক রকম মনে হয়। এই শহরের বিশাল বিশাল বিল্ডিংগুলো যখন সূর্যের তাপে তেতে থাকে তখন বৃষ্টির পানি তার ঠাণ্ডা পরশে হাত বুলিয়ে ঠাণ্ডা করে দিয়ে যায়। যেমনটা আমরা তৃষ্ণা পেলে পানি পান করে তৃষ্ণা মেটাই। মনের আনন্দে বিল্ডিংয়ের কার্নিশে কাকেরা, চড়–ই, টুনটুনিরা ভিজতে থাকে, লাফাতে থাকে। আমাদের তখন ঘরে বসে এসব দেখতে হয় নয়তো রেইনকোট পরে স্কুলের দিকে গুটিশুটি হয়ে ছুটতে হয়। গ্রামে বৃষ্টির পানিতে ফসল দ্রুত বড় হতে থাকে। বৃষ্টির পানি পেলে ফুল ফল পাতারা সজীব হয়ে ওঠে। গ্রামে তখন ছোটবড় সকলের মাঝে বৃষ্টিভেজার ধুম পড়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজে কেউ গোসল করে, কেউ যায় মাছ ধরতে, কেউ যায় ফসলের জমিতে পানি আটকে রাখতে। কেউ আবার বৃষ্টিতে খেলা করতে নেমে পড়ে। জ্ঞানী লোকেরা বৃষ্টির পানি নিয়ে দোয়া করে দোয়া কবুল হবে বলে। গ্রামে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কি মধুর! যেটা শহরের ইট সিমেন্টের ছাদে বুঝা যায় না। বন্ধুরা, গ্রামে বৃষ্টির পানি যখন বিশাল খোলা প্রান্তরে ঝরে পড়ে তখন সেদিকে তাকিয়ে থাকলে কি মনে হয় জানো! মনে হয়, অজস্র আনন্দের ফোঁটারা বৃষ্টির পানি হয়ে ঝরে পড়ছে। আর তখন সে আনন্দে নেমে পড়তে ইচ্ছে কার না করে। খালে নালায় পুকুরে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যখন পানিতে টপাটপ ঝরতে থাকে আর পুকুরের পানি সেই আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতেও ভারি আনন্দ।

বৃষ্টির সাথে যখন বাতাস থাকে তখন সেটা ঝড়ের মত, সেই ঝড়ো বৃষ্টিতে আম জাম লিচু ঝরে পড়ে, দলবেঁধে সেইসব কুড়িয়ে নেয়ার আনন্দ, তারপর ঘরে ফিরে ঝাল লবণ দিয়ে খেয়ে চোখ মুখ লাল করে ফেলা। আবার কখনও সেই কুড়ানো আম দিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে তুলে রাখা। বৃষ্টির সাথে যখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, চারদিক ফাটিয়ে বজ্রপাতের আওয়াজ হয়, তখন আমাদের শহুরে মানুষদের মনে ভয়ের কাঁপুনি ধরে যায়। কিন্তু গ্রামে তখন মাছ ধরার দল নেমে পড়ে। আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে বজ্রপাতের শব্দে পুকুর জলাশয়ের কইমাছগুলো পুকুর জলাশয় খাল বিল থেকে দলবেঁধে ঝাঁকে ঝাঁকে মাটিতে উঠে আসে, গ্রামের মেঠোপথের প্যাচপ্যাচে কাদায় সেই মাছগুলো যখন সারিবেঁধে হেঁটে চলে, সে এক দারুণ মজার দৃশ্য, মৎস্যশিকারির দল তখন সেই মাছ ধরার আনন্দে লাফাতে থাকে।

চলো এবার জেনে নেই এই বৃষ্টি কিভাবে আসে কিংবা কিভাবে হয়। সূর্যের তাপে খাল বিল নদী-নালার পানি ছোট ছোট অসংখ্য কণা হয়ে বাতাসের সাথে অনেক উপরে উঠে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে একসময় জমাটবদ্ধ হয়ে ওঠে। জমাটবদ্ধ এই জলকণার সমষ্টি হল মেঘ। উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ার সাথে এই মেঘেদের বন্ধুত্ব। সেখানে গেলে এই মেঘেদের সাথে আলিঙ্গন করা যায়। আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চল যেমন, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি অঞ্চলের পাহাড়ের উপর উঠলে অনায়াসে এইসব মেঘ স্পর্শ করা যায়। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ মেঘেদের পরশ পেতে সেখানে ছুটে যায়। সেইসব ছবি তুলে ফেজবুক মেসেঞ্জারে পোস্ট দেয়। সে এক দারুণ অনুভূতি, মনে হবে মেঘের দেশে আছি।

অধিক বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল নামে। তখন অনেক সময় ঘরবাড়ি ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে। গ্রামে ফসলের জমি ডুবে যায়। ফসলের জমি ডুবে যায়, তখন কৃষকের কষ্ট হয়। অধিক বৃষ্টির ফলে বন্যা হলে গাছপালা ঘরবাড়ি সব ডুবে যায়। ফলে গরিব মানুষদের কষ্ট আরো বেড়ে যায়। শহরে অধিক বৃষ্টিতে পুরান বাড়ির দেয়ালে নোনা ধরে যায়, শ্যাওলা জমে। ড্রেনগুলো ভরে ওঠে ময়লা পানিতে, রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকে, চলাচলে খুবই অসুবিধা হয় তখন। আবার পৃথিবীর অনেক দেশে বৃষ্টির অভাবে মানুষের খুবই কষ্ট হয়, যেমন আফ্রিকার দেশগুলোতে। ফলে সেইসব দেশে খাবার পানি ও ফসলের পানির খুবই অভাব দেখা দেয়। এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশে তাই বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। সেখানে বাড়িঘরগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকে, যাতে করে খাবার পানির অভাব হলে সেই পানি দিয়ে অভাব মেটানো যায়। আবার অনেকে বৃষ্টির পানির অপূর্ব স্বাদের কারণেও ধরে রেখে পান করে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জীবাণুমুক্ত থাকে। বন্ধুরা, আমরা যারা শহরে থাকি- পানির প্রকৃত স্বাদ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বৃষ্টির পানি পান করলে বোঝা যায় সত্যিই পানি কত স্বাদের জিনিস। এখনও গ্রামের অনেক বাড়িতে বৃষ্টির পানি পান করে থাকে।

একসময় আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা ছয় মাস কৃষিকাজ করতো। বাকি ছয় মাস অবসর, কাজহীন, বেকার সময়ে তার বাড়িঘরের আশপাশে উঁচু জমিতে ছোটখাটো কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখতো। কারণ তখন বন্যায় নিচু ফসলি জমি সব পানিতে ডুবে থাকতো। ফসল ফলানো হতো না। সেই অফুরন্ত সময়ে অনেকে আবার দলবেঁধে মাছ ধরতে যেত। কেউ কেউ ছিপ ফেলে বড়শিতে মাছ ধরতো। এই সময় সবচেয়ে মজার সময় কাটতো হাঁসদের। হাঁসেরা দলবল নিয়ে তাদের ছানাদের সাথে করে প্যাক প্যাক আওয়াজ তুলতে তুলতে বেরিয়ে পড়তো দারুণ উৎসাহে। জলাশয় পুকুর খাল-বিল দাপিয়ে বেড়াতো। এসময় তাদের সুস্বাদু খাবার থাকতো অফুরন্ত। পুকুরে জলাশয়ে অসংখ্য ছোট ছোট শামুক থাকতো যা হাঁসেদের খুবই প্রিয় খাবার। থাকতো কচুরিপানার পোনা, যা কিনা হাঁসের ছানারা চুক চুক করে খেতে খেতে খেলা করে। এসময় পুকুর ও খাল-বিলের পানিতে প্রচুর হাঁসের ডিম ভাসতে দেখা যেত। পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে পানিতে কখনও কখনও দিম পেড়ে দিত।
শহরে বৃষ্টির দিনে আমরা যখন খাবারের মজাদার স্বাদ খুঁজছি, প্রায় বাড়িতে ডিম-খিচুড়ি, গোশত-খিচুড়ি, গরম গরম ইলিশ মাছের ডিম ভাজা, ইলিশ ভাজা খেতে ব্যস্ত। কিংবা বিকেলে জানালার ধারে বসে বাদাম খেতে খেতে বৃষ্টি দেখছি। গ্রামেও তখন অনেক বন্ধু বৃষ্টিভেজা বিকেলে জানালার পাশে গুটিশুটি হয়ে বসে টিনের চালের বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ শুনতে শুনতে মটরশুঁটি ভাজার সাথে চাল ভাজা, বুট ভাজাগুলো কুটুরমুটুর করে খেতে খেতে বৃষ্টি দেখছে, কেউ কেউ আবার বৃষ্টি নিয়ে ছড়া বলছে সুর করে করে-
বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে।

Share.

মন্তব্য করুন