সকালবেলা। প্রচণ্ড গরম পড়ছে। এ সময় সাপ গর্ত ছেড়ে গাছের ডালে আশ্রয় নেয়। বনের পশুপাখিরাও গরমে অতিষ্ঠ। বন দীঘি মাঠে সব পশুপাখি জড়ো হয়েছে। সবাই খুব চিন্তিত। সবার মুখ ফ্যাকাশে। বনের রাজা সিংহ ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পায়চারি করছে। বাঘ বলল, ঘটনা কি রাজা মশাই? জরুরি কোন কথা আছে বলে মনে হয়? একটু তাড়াতাড়ি বলেন। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। নদীর তীর ঘেঁষে উঁচু পাহাড়ে শিকারে যাবো।
খুব ভয়ে দিন কাটছে আমার। কাউকে বলে বুঝাতে পারব না। এক নিদারুণ কষ্টের ভেতর দিয়ে দিন রাত পার করছি। ভাবলে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সিংহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
আর একটু খুলে বলুনতো! খুলে না বললে আমরা বুঝবো কিভাবে? জিরাফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল।
হাতি তার শুঁড়ে পেঁচিয়ে একটা ছাগল নিয়ে এলো। হাতি বলল, এই নিন মহারাজা আপনার সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছি।
আরে রাখ তোমার নাস্তা। আমি খুব চিন্তায় আছি। সিংহ বসে। সাথে সাথে সমস্ত পশুপাখিও বসে।
হাতি কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, কী হয়েছে? সবার মুখ ফ্যাকাশে কেন?
গতকাল রাতে লোকালয়ে গিয়ে ছিলাম। সব সময় পশুপাখি খেতে মন চায় না। মাঝে মধ্যে মানুষ খেতে ইচ্ছে হয়।
ওয়াক থু। একবার আমি মানুষের মাংস খেয়ে যা বিপদে পড়ে ছিলাম। লোকটা ছিল চোর। আর চোরের মাংস এমন বাজে হবে তা আমি বুঝতে পারিনি। বমি করতে করতে প্রায় মরতে বসে ছিলাম। সেই থেকে মানুষের মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। বাঘ বিমর্ষ মুখে বলল।
আমি মানুষের মাংস তেমন খাই না।
বললাম না মাঝে মধ্যে…। একবার নদীর ধারে আমাকে ভাগে পেয়ে রামধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেয়। যা হোক মানুষ থেকে দূরে থেকো সবাই। লোকালয়ে গিয়ে নিজ কানে শুনে এসেছি, দুই লোক নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করছে, বনে আগুন দিবে।
সিংহের কথা শুনে সবাই হইচই করে, চেঁচামেচি করে। মুহূর্তে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হাতি রাগে গজ গজ করতে করতে বলল, ঐ লোকগুলোর ঠিকানা দিন। শুঁড়ে পেঁচিয়ে এমন আছাড় মারবো না। বাকি জীবন সোজা হয়ে হাঁটতে পারবে না।
দশ বছর আগে বনে আগুন লাগলে কোনো রকম পালিয়ে রক্ষা পাই। কিন্তু আমার সব আত্মীয় স্বজন মারা যায়। সে থেকে আমি একা। সাদা বাঘ বলল।
হুঁ। শক্তি দিয়ে না। বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে। মানুষের মাথায় অসাধারণ বুদ্ধি। মানুষ বুদ্ধি দিয়ে কত কাজ করছে। সিংহ ওঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথে সব পশুপাখি ওঠে দাঁড়ায়।
সব মানুষ না রাজা মশাই। পেঁজা বলল।
তাও ঠিক। শুন তাহলে সবাই মন দিয়ে-রোজ ঐ লোক দুটো মাঠে কাজ করে। ভর দুপুরে হঠাৎ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবে বাঘ। বাঘ দেখে প্রচণ্ড ভয় পাবে তারা। বাঘের তর্জন গর্জন শুনে পালাতে চেষ্টা করবে। তারপর-
তারপর কী? বাঘকে খুব উৎফুল্ল দেখায়। খুশিতে সে শূন্যে লাফিয়ে ওঠে।
আমরা কী করবো? সজারু বলল।
ঠিক এ সময় আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবো। বাঘকে বাধা দিবো। কিন্তু বাঘ দমানোর পাত্র নয়। সে তার শক্তি দেখাবে। এমন ভাব করবে যে মানুষ দুটোর ঘাড় মটকাবে।
তারপর তারপর…। হাতি বলল। সবার চোখে মুখে কৌতূহল!
এক পর্যায়ে আমার আর বাঘের মধ্যে লড়াই শুরু হবে। সিংহ বসে। সাথে সাথে সব পশুপাখি বসে।
না না রাজা মশাই আমি আপনার সাথে লড়াই করতে পারবো না। বাঘ হাতজোড় করে বলল।
আরে এটাতো সত্যি সত্যি লড়াই না, অভিনয়। সিংহের কথা শুনে সবাই তালি দেয়। কেউ কেউ শিসও বাজায়।
আমাদের লড়াই করতে দেখে মানুষ দুটো পালাতে থাকবে। প্রাণে বেঁচে গিয়ে তাদের এই উপলব্ধি হবে যে সব পশুপাখি খারাপ না। পশুপাখিদের মধ্যেও ভালো মন্দ আছে। আর…। সিংহ কথা শেষ না হতেই স্লোগান ওঠে। সিংহ রাজা জিন্দাবাদ। সিংহ রাজার জয় হোক।
পরদিন ভর দুপুরে লোক দুটো মাঠে কাজ করছিল। প্রচণ্ড রোদ। এক মনে ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে যাচ্ছে। অন্য কিছুর দিকে তাদের খেয়াল নেই। এমন সময় পা টিপে টিপে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় বাঘ। দূরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সিংহ। বাঘ মুচকি হাসে। ভালো করে চারদিক দেখে নেয়। এ সময় কোথাও কেউ নেই। শুধু মানুষ দু’জন। হঠাৎ বাঘ গর্জন করে। লোক দুটো প্রচণ্ড ভয় পায়। ভয়ে চিৎকার করতে চায়। কিন্তু গলা জড়িয়ে আসে।
এ সময় সিংহ আসে। ক্ষেতের চারপাশে ঘুরে। লোক দুটোর শরীর কাঁপে। সিংহ এক লাফে ক্ষেতের মাঝখানে আসে। বাঘের ওপর লাফিয়ে ওঠে। বাঘ দূরে সরে যায়। বাঘ সিংহের তর্জন গর্জন চলে। বাঘ লোক দুটোকে মেরে ফেলবে এমন ভান করে আক্রমণ করে। আর সিংহ তা প্রতিহত করে। একজন লোক বলল, আমরা ভেবে ছিলাম বনে আগুন দিবো। গাছপালা পশুপাখি মরে ছাপ হয়ে যাবে। কিন্তু –।
হুঁ। কিন্তু আজ সিংহ রাজা না আসলে আমাদের কি হতো। নিশ্চিত প্রাণে মারা যেতাম। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জীবনের দাম বুঝছি। অন্য একজন বলল।
এখনও বিপদ কাটেনি। সিংহ রাজা আমাদের হয়ে লড়াই করে যাচ্ছে।
আসলে সব পশুপাখি খারাপ না। মানুষের মধ্যে যেমন ভালো মন্দ আছে ঠিক তেমনি পশু-পাখির মধ্যেও আছে।
ঠিক বলেছো। বনে আগুন দিলে অনেক নিরীহ পশুপাখি মারা যাবে। এ কাজ আমরা করবো না। চল পালিয়ে যাই। এই বলে দৌড়। একটানা দৌড়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে ।
লোকগুলো চলে গেলে বাঘ আর সিংহের লড়াই থামে। বাঘ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, রাজা মশাই অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যি আপনাকে মেরে বসেছি। আমি দুঃখিত।
না না তোমার অভিনয় ভালো হয়েছে। চল বনে ফিরে যাই। সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
হ্যাঁ চলুন। সিংহ রাজা আমার একটা পরামর্শ ছিল।
চলুন সবাই মিলে অনেক দূরে চলে যাই। এ বনে আর না। মানুষের মাথায় আবার কখন দুষ্ট বুদ্ধি খেলে কে জানে।
ঠিক বলেছো। কিন্তু কোথায় যাবো? সমানে বন উজাড় করে বাড়িঘর ফ্যাক্টরি তৈরি করছে মানুষ। ফ্যাক্টরির কালো ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারি না।
গভীর রাত। জোছনা প্লাবিত পুরো বন। রাতের খাবার খেয়ে বন দীঘি মাঠে জড়ো হয় সব পশুপাখি। সিংহ রাজার অনুমতি নিয়ে স্টেজে ওঠে ময়না। চারদিকে আনন্দ আর হইচই। ফুরফুরে বাতাস বইছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে। ময়না একটার পর একটা গান শুনিয়ে যাচ্ছে। কি চমৎকার সুরেলা গলা-
পশুপাখি হয়ে কেন জন্মাইলাম
কেন মানুষ হইলাম না
মানুষ হইলে…।

Share.

মন্তব্য করুন