টিটু…টি…টু…!
বারান্দা থেকে কেউ যেন ডাকছে বুঝতে পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় টিটু। দেখে বারান্দার গ্রিলে বসে টিয়া পাখিটা পাখা ঝাপটাচ্ছে আর টিটু-টিটু বলে ডাকছে।
পাখিদের সাথে টিটুর এক অদ্ভুত ভালোবাসা রয়েছে। পাখিদের ভাষা টিটু বুঝতে পারে। ওরা কিচিরমিচির করে কী বলে সেটা টিটু মনে মনে অনুবাদ করতে পারে। প্রায় সময়ই টিটু কোন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একা একাই আপন মনে পাখিদের সাথে কথা বলে। পাখিরাও টিটুকে দেখে তার কাছে এসে ওদের মনের কথা বলে।
আজ এই টিয়া পাখিটা হঠাৎ এভাবে এসে টিটুকে ডাকছে কেন? ড্রয়িংরুমে বসে নিবিষ্ট মনে ছবি আঁকছিল টিটু। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্কুলে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। শুধু স্বাধীনতা দিবস নয়, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও স্কুলে চিত্রাঙ্কনসহ গান ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হয়। টিটু প্রতিবারই চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায়। গত বছর বিজয় দিবসে এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে এমন ছবি এঁকে প্রথম হয়েছে। টিটু ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। ওর ক্লাসের রোহান এবং ক্লাস ফোরের সালমানও খুব সুন্দর ছবি আঁকে। ওরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে। এবার ওরা প্রথম হওয়ার জন্য অনেক আগে থেকে প্র্যাকটিস করছে। আজমল স্যারের ‘এসো আঁকা শিখি’ কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। গত বছর ক্লাস টুয়ে পড়ার সময় টিটুও ওই স্যারের কোচিংয়ে তিন মাস ছবি আঁকা শিখেছে। এবার এখনো ভর্তি হয়নি। তবে সে নিজেই বাসায় একা একা ছবি আঁকা প্র্যাকটিস করছে। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কী ছবি আঁকা যায় এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে সে ভাবছে। আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি নীল আকাশে ডানা মেলে একটি পাখি উড়ছে এরকম ছবি আঁকার কথা বলেছেন। আম্মুর আইডিয়াও এমনই। তবে টিটু নতুন কিছু আঁকার কথা ভাবছে।
পাখিটার ডাক শুনে ড্রয়িংরুম থেকে টিটু বারান্দায় যেতেই টিয়া পাখিটা এসে ওর কাঁধে বসে। টিটু টিয়ার গায়ে আলতো হাত বুলিয়ে আদর করে। জিজ্ঞেস করে, কিরে কী হয়েছে? এই অসময়ে এসে এভাবে ডাকছিস কেন?
: টিটু… টিটু আমাদের মহাবিপদ আসছে। আমাদের তুমি বাঁচাও।
: কী হয়েছে, কী বিপদ আসছে?
: স্কুলের মাঠের কোণের বড় গাছটা বিক্রি করে দিচ্ছে। হেডমাস্টার একটু আগে ব্যাপারি নিয়ে গাছের কাছে এসেছিলেন। আমি তখন তাদের কথা শুনেছি।
: বলিস কী, শতবর্ষী এই গাছটা বিক্রি করে দেবে। এ হতেই পারে না। এ গাছটা আমাদের স্কুলের সৌন্দর্য, বলা যায় আমাদের সবার ভালোবাসা।
: হ্যাঁ টিটু। এটাতো আমাদের আশ্রয়। এই গাছ কেটে ফেললে আমরা যাব কোথায়। এই এলাকায় এত বড় প্রাচীন গাছতো আর নেই।
: হুম, খুব চিন্তার বিষয়। কী করা যায়… কী করা যায়…। টিটু হাতের পেন্সিলটা দাঁতে চেপে ভাবতে থাকে। কিন্তু কী করবে কিছুই ভেবে পায় না। টিয়াও খুব চিন্তায় পড়ে যায়। টিয়া বেশ আতঙ্কের সুরে বলে, ‘এই টিটু, আমাদের এখন কী হবে?’
ভাবতে ভাবতে টিটুর এবার ওর দাদুর কথা মনে পড়ে। দাদু বলেছেন বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হয়। ইস, দাদু যদি এখন বাসায় থাকতেন তাহলে ঝট করে একটা উপায় বলে দিতেন। এত চিন্তা করতে হতো না। দাদু তো গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাঝেমধ্যে শহরে টিটুদের বাসায় আসেন। দাদু এলে কি যে মজা হয়। দাদুর সাথে টিটু খেলা করে, গল্প করে। দাদুর সাথে স্কুলে যায়। দাদু তো বলা যায় গল্পের এক ভাণ্ডার। কত গল্প জানেন দাদু। ভূতের গল্প, পরীর গল্প, রাজকুমার ও রাজকুমারীর গল্প, রাক্ষসের গল্প আরো কত কিছু। এখন দাদু থাকলে খুব ভালো হতো। আসন্ন এই বিপদ থেকে মুক্তির একটা উপায় দাদু ঝট করে বলে দিতেন। টিটু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুটা গম্ভীর গলায় বলে, টিয়া তুই এবার যা। আমি রাতে এ বিষয়ে ভেবে একটা উপায় বের করবো। এরপর সকালেই আমি আসবো।
কোন কিছুতেই টিটুর মন বসছে না। ছবি আকার রঙতুলি পাশেই পড়ে আছে। আঁকার বিষয় কিছুতেই ভাবনায় আসছে না। ওর মনে এখন একটাই ভাবনা- কী করে স্কুলের গাছটাকে রক্ষা করা যায়। এই জেলা শহরটাতে গাছপালা খুব একটা নেই। গত বছর গ্রীষ্মকালে দাদু যখন এসে ছিলেন তখন প্রচণ্ড গরম ছিল। দাদু তখন বলেছিলেন- শহরে দিন দিন গাছপালা কমে যাচ্ছে বলেই এত গরম পড়ছে। বৃষ্টির সময় বৃষ্টি হচ্ছে না। আজ থেকে আট দশ বছর আগেও এই শহরে অনেক বড় বড় গাছ ছিল। কলেজের মাঠের চার পাশে বড় বড় রেইনট্রি গাছ ছিল। এগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ওদিকে স্টেডিয়ামের পাশে প্রচুর গাছ ছিল, কোর্ট এলাকায় বড় বড় গাছ ছিল। গত কয়েক বছরে এসব গাছ কেটে সেসব স্থানে বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। ডোবা-নালা ভরাট করা এবং গাছপালা কেটে ফেলার ফলে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। দাদু সব সময় বলেন, আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে চাই তাহলে যত বেশি সম্ভব গাছ লাগাতে হবে। কারণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণে বৃক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, একজন মানুষের জন্য এক বছরের অক্সিজেন সরবরাহ করতে দু’টি পূর্ণ বয়স্ক গাছের প্রয়োজন। গাছ হলো আমাদের পরম বন্ধু। তাই নিজেদের বাঁচার কথা চিন্তা করে আমাদের গাছ লাগানো উচিত।
শহরে এখন এই একটাই বড় গাছ আছে। কত শত পাখি এই গাছে বাসা বেঁধে আছে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় পাখির কলকাকলিতে স্কুল প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকে। এ গাছের ছায়ায় ছেলে মেয়েরা ছোটাছুটি করে। গাছটা যেন ছাতার মতো ছায়া দিয়ে স্কুলটাকে আগলে রেখেছে। অথচ স্যার কি না এই গাছটাকেই বিক্রি করে দেবে। ব্যাপারিরা এ গাছটা কেটে ফেলবে!
না-টিটু কিছুতেই এটা হতে দেবে না। সবাই মিলে স্যারকে বুঝাবে। প্রয়োজন হলে স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে গাছটাকে ঘিরে মানববন্ধন করবো। ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ পেয়েছি পেয়েছি… উপায় পেয়েছি’। হঠাৎ করেই টিটুর চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যায়। টিটু মনে মনে ভাবে, খুব সকালেই সে গাছের কাছে যাবে। ওই গাছে যেসব পাখি বসবাস করে তাদের সবাইকে বলবে নিচে নেমে গাছটাকে ঘিরে রাখতে। সব পাখি মিলে পাখিবন্ধন করে গাছকে রক্ষা করতে হবে। টিটুর মনটা মুহূর্তে আনন্দে ভরে ওঠে।
পাশেই পড়ে থাকা রঙতুলি নিয়ে টিটু ছবি আঁকা শুরু করে। একটি বড় গাছ কাটার জন্য লোক আসছে। আর এর প্রতিবাদে গাছে থাকা পাখিরা সব মাটিতে নেমে এসে গাছটাকে ঘিরে রেখেছে। এরকমই একটা ছবি আঁকে টিটু। ছবির নিচে লিখে দেয় গাছ রক্ষায় পাখিবন্ধন।

Share.

মন্তব্য করুন