আমাদের আব্বু মজার মানুষ। সব সময় মজা করেন। আমরা আব্বুর কথা শুনে হেসে খই ফোটাই। আজ রাতের খাবার খেতে বসেছি সবাই। সবাই মানে বড় আপু অর্ণা, আমি পর্ণা, ছোট বোন ঝর্ণা আর আম্মু। কাজের মেয়ে রুমালি সাহায্য করছে এটা-সেটা এগিয়ে দিয়ে। আমি ক্লাস সেভেন, আপু নাইন আর ঝর্ণা থ্রি-তে পড়ে। আমরা তিন বোন আনন্দ করলেও তিনজন তিন মেরুতে অবস্থান। আপু ফেসবুক, আমি অ্যানিমেশন ছবি আর ঝর্ণা গেম পছন্দ করে। কিন্তু আব্বু যে সময়টুকু সঙ্গ দেন সে সময়টুকু আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে। আব্বু খেতে খেতে বললেন, আজ তোমাদের একটা মজার জিনিস দেখাব।
‘কী জিনিস আব্বু? প্রশ্ন করে ঝর্ণা।’
‘দেখলেই বুঝতে পারবে।’
‘কোথায় দেখতে পাব, কখন?’ -উৎসুক হয়ে বলি আমি।
‘আমাদের গেস্টরুমে। খাবার পর দেখাব।’
আব্বু এমন গম্ভীর হয়ে কথাটি বললেন যেন সিরিয়াস কিছু। কিন্তু আমি ধরেই নিচ্ছি আব্বু আজও ফান করছেন। আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমিও থেকো- সবারই দেখা জরুরি।’
আম্মু মুচকি মুচকি হাসেন। তবে কি আম্মু আগে থেকেই জানেন কী দেখানো হবে? রুমালি গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘আমিও কি দেখতি যাব খালুজান?’
ওর কথায় সবাই হেসে উঠি। আব্বু বলেন, ‘অবশ্যই যাবি, তোকেই তো বেশি করে দেখতে হবে। কারণ তুই যাতে ওটা দেখার পর টিভিতে বাংলা সিনেমা কম দেখিস।’
মুখটা একটু বেজার করল রুমালি। আমরা মুখ টিপে হাসি। রুমালি চলে যায়। রান্নাঘরে যেতে ও যে চুপিচুপি গেস্টরুমের দিকে গেল তা সবাই বুঝতে পারলাম। তার মানে রুমালি সবার আগেই দেখে আসবে ওখানে কী আছে। কিন্তু আমরা জানি অতিথি কক্ষে একটি খাট আর বিছানা-বালিশ ছাড়া তেমন কিছু নেই। তবে কি আব্বু লুকিয়ে কোনো কিছু এনে রেখেছেন? হতে পারে কঙ্কাল। প্লাস্টিক অথবা রাবারের কঙ্কালে রেডিয়াম দেয়া আছে। ঘর অন্ধকার করলে সেই কঙ্কালটি ভয়ঙ্কর মনে হতে পারে। আমাদেরকে চমকে দেবার জন্য আব্বু এমন কিছু একটা আনতে পারেন। কিছু অনুমান করতে পারছি না। আমার মতো আপুও চিন্তিত। বলে ফেলল, ‘আব্বু জিনিসটা কি তোমার সায়েন্স ফিকশন গল্পের নায়ক?’
‘না রে মা, না। কোথায় সায়েন্স ফিকশন আর কোথায় গেস্টরুম? অত টেনশন করছিস কেন? ভয়ের কিছু নেই, আমি আছি না সাথে?’
আব্বুর কথায় এবার রহস্যের গন্ধ। তিন বোনেরই ভয়টা যেন বেড়ে গেল। কারণ আব্বুর মাথায় কখন কী ঢোকে বলা মুশকিল। তিনি একটি বিদেশি সংস্থায় চাকরি করেন। বিদেশি বই পড়েন। বানিয়ে বানিয়ে আজগুবি গল্প লেখেন। আমি একটি গল্প পড়তে গিয়ে তো ভয়ে অস্থির।
একটি কুচকুচে কালো ঘোড়া শূন্যে পা ফেলে হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটছে। তাও আবার ঘন কালো অন্ধকারে। অন্ধকারের রঙ আর ঘোড়ার রঙ মিশে গেছে। কোনটা আঁধার আর কোনটা ঘোড়া চেনা যাচ্ছে না। ঘোড়া ছুটছে। হঠাৎ সে পেল এক ভিনগ্রহের প্রাণীর দেখা।
ঘোড়াটি বলল, ‘কে হে তুমি প্রাণী?’
প্রাণীটি বলল, ‘আমি না-ঘোড়া না-মানুষ। আমার নাম ঘোনুষ।’
‘ঘোনুষ কোনো প্রাণীর নাম তা জানা ছিল না।’
‘আমার পূর্বপুরুষ ঘোড়া ছিল, তা থেকে ‘ঘো’ আর তার পূর্বপুরুষ মানুষ ছিল তা থেকে ‘নুষ’। এবার হল তো ঘোনুষ।’
‘তা হলে তো তুই ঘোড়ার মতো শক্তিশালী আর মানুষের মতো বুদ্ধিমান। তোর সাথে আমি কিছুতেই পারব না। তবুও তোর সাথে একবার লড়াই করে দেখতে চাই তুই সত্যিই ঘোনুষ বংশের কেউ নাকি।’
এমন সময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো এবং পাঁচ রঙের ঘোনুষের সাদা দাঁতগুলি পঞ্চাশ ফুট লম্বা দেখা গেল।
এরকম একটি গল্প পড়ার পর আমি আর অর্ণা আপু আব্বুকে হাজারটা প্রশ্ন করেছিলাম।
‘ঘোড়ার রঙ কালো তা মেনে নিলাম। কিন্তু মাটিতে যদি পা না রেখে চলে তবে তো ছুটে চলা বলা যায় না। উড়ে চললে কী ক্ষতি হতো?’
আব্বুর উত্তর, ‘গল্পের ঘোড়া ছুটে চলাও যে কথা উড়ে চলাও সে কথা।’
আমাদের প্রশ্ন, ‘হাজার কিলোমিটার ঘোড়ার গতি সম্ভব কি?’
আব্বুর উত্তর : আমি তো লিখিনি সে প্রতি ঘণ্টায়- এক মাসে এক হাজারও হতে পারে। এটাই রহস্য।
আমাদের প্রশ্ন, ‘ঘোনুষের দাঁত পঞ্চাশ ফুট লম্বা হলে ঘোনুষ কত ফুট লম্বা?’
আব্বুর উত্তর, ‘পাঁচ ফুটও হতে পারে, সাত ফুটও হতে পারে। ঘোনুষের উচ্চতা গল্পের কোথাও লেখা নেই। তবে তোমরা যে দাঁতের কথা বলছ সেটা অনুমান করার বিষয়। কারণ সেখানে বিদ্যুৎ চমকানোর কথা ছিল। বিদ্যুতের ঝলক দাঁত বরাবর ধরলে পঞ্চাশ ফুট হয় নাকি পাঁচশ ফুট হয় তা কে মেপে দেখেছে?’
আব্বুর এমন কথা শুনে আমরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। আব্বুর লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর কাছে আমরা পরাজিত।
রুমালি খাবার টেবিলের কাছে এলে আম্মু বললেন, ‘তুই তাহলে আগেই দেখে এলি গেস্টরুমে কী আছে।’
‘কী যে কন খালাম্মা, খালুজানের জিনিস আমি কেমনে চিনুম। ঐ দিকে গিছলাম বিছানাডা গোছানোর জন্যি।’
ওর কথায় আমাদের সবার হাসি পায়। আব্বুও মৃদু মৃদু হাসতে থাকেন। খাওয়া শেষ করে আমরা নিজ নিজ চেয়ারে বসে থাকি। আব্বু আমাদেরকে গেস্টরুমে নিয়ে যাবেন সেই প্রতীক্ষায়।
ঝর্ণা বলল, ‘আব্বু গেস্টরুমে নিয়ে যাচ্ছ না যে?’
‘একটু দেরি করছি। রহস্যটা বাড়–ক। সকলের মনের মধ্যে একটা অজানা রহস্য ঘুরপাক খেতে থাক।’
আম্মু বললেন, ‘এতটুকু সব মেয়েদের কাছে এত গুরু-গম্ভীর কথা কেন যে বলো-।’
আব্বু বললেন, ‘না, এটা তোমার ভুল ধারণা। আমার তিনটি মেয়ের কেউ এখন ছোট নেই। ওদেরকে আমরা কেন ছোট রাখব? ওরা অনেক বড়। প্রত্যেকটি শিশুই অনেক বড়। কারণ শিশুদের অন্তরে স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের সমান একটি বড় মানুষ কখনো হয় না।’
ঝর্ণা বলল, ‘আব্বু, আমিও ছোট না?’
‘তুমি ছোট, তবে যতটা ভাবছ, অতটা না। তুমি পড়ালেখা করো না?’
‘করি।’
‘গেম খেলো না?’
‘খেলি।’
‘তাহলে ছোট বলি কিভাবে?’

সবাই আব্বুর দিকে মনোযোগ দিই। আব্বু বলেন, ‘আজকাল পত্রিকায় ব্লু হোয়েল নামে একটি গেম নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। বাংলায় বলা হচ্ছে নীল তিমি। এই নীল তিমির খপ্পরে যাতে কেউ না পড়ে সে দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।’
অর্ণা আপু বলল, ‘কিন্তু আব্বু, পত্রিকায় যতটা লিখেছে সব সত্য নয়।’
‘সেটা আমিও জানি। তবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। অনেক শিশুকিশোর ফেসবুকে বা গেম খেলে প্রচুর সময় নষ্ট করছে। আনন্দের জন্য সবই প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা হতে হবে প্রয়োজনমাফিক। কথায় আছে, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। ’
আমার ও আপুর মুখ একটু শুকিয়ে গেল। কারণ আমরা দুজনেই কম্পিউটারে বেশ সময় ব্যয় করি। আব্বু খুবই মজা করে করে সময় সম্পর্কে জ্ঞানের কথা বলে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আব্বু তাঁর গল্পের নায়ক নিজেই। ভেবে অবাক যে তিনি এত কিছু জানেন কিভাবে? আমি বললাম, ‘আব্বু, তুমি কিন্তু তোমার সায়েন্স ফিকশনের গল্পে ঢুকে যাচ্ছ। গেস্টরুমে কী যেন দেখাতে চেয়েছিলে-।’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই দেখাব। চলো সবাই।’
রুমালি কিছু তরকারির বাটি হাতে করেছিল, রান্নাঘরে নেবে বলে। সেগুলো টেবিলেই রেখে দিল। ওর এমন আগ্রহ দেখে মজা পেলাম। সবাই আব্বুকে অনুসরণ করে গেস্টরুমে গেলাম। আব্বু সুইচ অন করে বাতি জ্বালালেন। বললেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
আমরা চারদিকে তাকিয়ে তেমন কিছু দেখতে পেলাম না। আব্বু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
আমরা বললাম, ‘না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
কারণ ঘরটিতে প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া তেমন কিছুই দেখা গেল না। আব্বু এবার চোখ ফিরিয়ে দেয়াল ঘড়িটি দেখালেন। বললেন, ‘এই ঘড়িটি দেখতে পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ-।’ বলল ঝর্না।
‘এবার দেখ সেকেন্ডের কাঁটা একমনে ঘুরছে। কত দ্রুত। তাই না?’
‘হ্যাঁ-।’ বলল অর্ণা আপু।
‘তাহলে এবার চলো যার যার ঘরে যাই।’
আব্বুর মুখে তৃপ্তির হাসি। যেন সারা দুনিয়ার রহস্য তিনি সেকেন্ডের কাঁটার মধ্যে এক সেকেন্ডে দেখিয়ে দিয়েছেন। আম্মু বললেন আব্বুকে, ‘তোমার রহস্যের ঢঙ দেখে আর বাঁচি না। দেয়াল ঘড়ি তো ডাইনিং রুমেও ছিল। ওখানে বসেই সেকেন্ডের কাঁটা দেখাতে পারতে।’
আব্বু হো হো করে হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘তাহলে কি রহস্যের গন্ধ পাওয়া যেত?’
আমি আর ঝর্ণা একরুমে থাকি। অর্ণা আপু অন্যরুমে। আগে ঝর্ণা আব্বু-আম্মুর রুমে থাকত। এখন আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। কিছু গেম শিখিয়ে দিয়েছি, সেগুলো খেলে। কি-বোর্ডের বাটন টিপে খেলতে হয়। জাম্প দিতে গিয়ে সৈনিকটি নিচে পড়ে গেলে খেলা শেষ। আবার শুরু করতে হয়। আমি ঝর্ণাকে কাছে বসিয়ে আব্বুর দেখানো সেকেন্ডের কাঁটার কথা ভাবছি। এমন সময় অর্ণা আপু এলো। দেখি তার চোখ ছলোছলো। আপু বলল, ‘জানিস পর্ণা, আজ আমি নতুন করে ভাবতে শিখলাম।’
‘কী বিষয়ে আপু?’
‘সময়। আমি কত সময় যে অকারণে ব্যয় করেছি তার হিসাব নেই। ফেসবুকও খারাপ না যদি সময় মেপে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমি বোধ হয় একটু বেশি সময় দিয়ে ফেলেছি।’
আমি আর আমার কথা বলি না। চেপে যাই। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি অ্যানিমেশন আর কাটুনের পেছনে এত সময় দেব না। পড়ালেখার জন্য অধিক সময় দেয়া জরুরি।
পরদিন সকালে দেখি আব্বুর লেখা গল্পটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ‘ঘোনুষ’ নামের গল্পটি আমরা তিন বোন বসে পড়লাম। ‘ঘোনুষ’ পড়ে মানুষ হবার চিন্তা বেড়ে গেল। গল্পের শেষ দিকে আব্বু লিখেছেন বিজ্ঞানীরা নতুন করে আরেকটি গ্রহ আবিষ্কার করেছে। গ্রহটির নাম ধ্বংস। ধ্বংস গ্রহটি পৃথিবীর দশগুণ বড়। এই গ্রহটি নাকি শুধুই পৃথিবী নয়, অন্যান্য সকল গ্রহ ধ্বংস করে দিবে। সে নাকি একাই টিকে থাকবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। প্রথমে ধ্বংস করবে পৃথিবী। এই কথা শুনে ঘোনুষ সাত আসমানের মাঝখানে অর্থাৎ সাড়ে তিন আসমান উপরে উঠে দাঁড়িয়ে থাকল। ঘূর্ণনকালে ধ্বংস-গ্রহের সাথে পৃথিবীর টক্কর লাগবে এবং সাথে সাথেই পৃথিবী শেষ। টক্কর লাগার মুহূর্তে ঘোনুষ ধ্বংসকে সজোরে ধাক্কা দিল। ধ্বংস টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাত সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস সময়মতো কালোঘোড়াটি ঘোনুষকে ধ্বংসের সংবাদ দিতে পেরেছিল।

Share.

মন্তব্য করুন