ক্রীড়াঙ্গনে একই পরিবারের সদস্যদের পদচারণা ইতিহাসে অনেক আছে। যেসব পরিবারের দুই বা তারও অধিক সদস্য সমৃদ্ধ করেছেন নিজ নিজ দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে। কোথাও বা কয়েক পুরুষ ধরে প্রতিনিধিত্ব করেছেন দেশকে। এবারের লেখায় তার মধ্য থেকে কয়েকটি পরিবারের গল্প শোনাবো।

খান পরিবার
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম তারকা আকরাম খান। তার নেতৃত্বেই ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ জিতেছে আইসিসি ট্রফি। সেখান থেকেই বাংলাদেশ সুযোগ পায় বিশ্বকাপ খেলার। আকরাম খান জাতীয় দলে খেলেছেন ২০০৩ সাল পর্যন্ত। টাইগারদের হয়ে ৮টি টেস্ট ও ৪৪টি ওয়ানডে খেলেছেন এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। অবসরের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন আকরাম।
আকরাম খানের বড়ভাই ইকবাল খান ছিলেন ক্রিকেট সংগঠক। তরুণ বয়সে খেলেছেন ফুটবল, ক্রিকেট দুটোই। ফুটবলে চট্টগ্রাম মোহামেডানের অধিনায়কত্বও করেছেন। তবে অল্প বয়সেই খেলা ছেড়ে খেলোয়াড় তৈরি করতে মনোযোগী হন তিনি। চট্টগ্রামে ক্রিকেটের বিকাশে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। অনেকে তাকে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনের অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বন্দর নগরী থেকে অনেক ফুটবলার ও ক্রিকেটার উঠে এসেছে বাংলাদেশ দলে। এর সূচনাটা হয়েছিলো ইকবাল খানের হাত ধরেই।
ইকবাল খানের দুই ছেলে নাফিস ইকবাল ও তামিম ইকবাল। নাফিস বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের নায়ক তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ১১টি টেস্ট ও ১৬টি ওয়ানডে খেলেছেন এই ডানহাতি ওপেনার।
নাফিস ইকবালের ছোট ভাই তামিম ইকবালের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু হয়তো বলার দরকার নেই। টাইগারদের এই বামহাতি ওপেনার বাংলাদেশ ক্রিকেটের এযাবৎ কালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। ব্যাটিংয়ের অনেক রেকর্ড তার দখলে। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর তিন ফরম্যাটেই দলের সেরাদের একজন তিনি।
চট্টগ্রামের খান পরিবার বাংলাদেশের একটি অভিজাত পরিবার। ইতোমধ্যেই এই পরিবার অনেক কিছু দিয়েছে ক্রিকেটকে। ভবিষ্যতেও হয়তো খান পরিবার থেকে আরো উজ্জ্বল নক্ষত্র আসতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

গ্রেস পরিবার
ডব্লিউ জি গ্রেস ছিলেন ক্রিকেটের এক কিংবদন্তি। অনেকে তাকে বলেন ক্রিকেটের অতিমানবীয় বুড়ো। কেউ বলেন ফাদার অব ক্রিকেট। ইংল্যান্ডের হয়ে ২২টি টেস্ট খেলেছেন। সে সময় আন্তর্জাতিক ম্যাচ নিয়মিত হতো না। নইলে তার ম্যাচ সংখ্যা অনেক বেশি হতো। ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৫ টেস্টে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি করেছেন ৫০ হাজারের বেশি রান, সেঞ্চুরি ১২৪টি। ২৮টি মৌসুমে তিনি এক হাজারের বেশি রান করেছেন। দুই হাজারের বেশি রান করেছেন পাঁচ মৌসুমে। ছিলেন অলরাউন্ডার, ৮৭০ ম্যাচে নিয়েছেন দুই হাজারের বেশি উইকেট।
তার আরো দুই ভাই অ্যাডওয়ার্ড গ্রেস ও ফ্রেড গ্রেস ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলেছেন একটি করে। তিন ভাই এক সাথেও খেলেছেন একটি টেস্ট। এই কৃতিত্ব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর আছে শুধু পাকিস্তানের হানিফ মোহাম্মাদ ও তার ভাইদের।
গ্রেসদের আরো পাঁচজন কাজিন খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। ডব্লিউ জি গ্রেসের দুই ছেলে ডব্লিউ জি গ্রেস জুনিয়র ও চার্লস গ্রেস খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। অ্যাডওয়ার্ড গ্রেসের এক ছেলে এবং গ্রেস পরিবারের আরো দুই সদস্য খেলেছেন কাউন্টি ক্রিকেটে। ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোতে ডব্লিউ জি গ্রেসের প্রোফাইলে তার মোট ১১ জন ক্রিকেটার আত্মীয়ের নাম পাওয়া যায়।

হানিফ মোহাম্মাদ অ্যান্ড কোং
হানিফ মোহাম্মাদের পরিবার বললে- আর কোন পরিচয় দরকার হয় না। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন হানিফ মোহাম্মাদ। ক্রিকেটের প্রথম লিটল মাস্টার খেতাব পেয়েছিলেন তিনিই। ১৯৫০ ও ’৬০ এর দশকে পাকিস্তানের হয়ে খেলা হানিফ ৫৫ টেস্টের ক্যারিয়ারে ১২ সেঞ্চুরিতে প্রায় ৪৪ গড়ে করেছেন তিন হাজার ৯১৫ রান।
টেস্ট ইতিহাসে সময়ের হিসেবে দীর্ঘতম ইনিংসটি খেলার রেকর্ড তার। হানিফ মোহাম্মাদ ছিলেন পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। তিনি ছাড়াও বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মাদ, চতুর্থ মোশতাক মোহাম্মাদ ও পঞ্চম সাদিক মোহাম্মাদ খেলেছেন পাকিস্তানের হয়ে। ওয়াজির ২০ টেস্ট, মোশতাক ৫৭ টেস্ট ও ১০ ওয়ানডে এবং সাদিক ৪১ টেস্টের পাশাপাশি ১৯ ওয়ানডে খেলেছেন পাকিস্তানের হয়ে। ওয়াজিরের টেস্ট সেঞ্চুরি দু’টি, মোশতাকের ১০টি, সাদিকের পাঁচটি। মুশতাকের টেস্টে ৭৯টি উইকেটও আছে। হানিফ ও মোশতাক পাকিস্তান দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন।
ওয়াজির ও হানিফ এক সাথে ১৮টি টেস্ট খেলেছেন। হানিফ ও মোশতাক খেলেছেন ১৯ টেস্ট। মোশতাক ও সাদিক ২৬ টেস্ট। ওয়াজির ও মোশতাক এক সাথে খেলেছেন একটি টেস্ট। হানিফ, মুশতাক ও সাদিক একই সাথে খেলেছেন একটি ম্যাচে। একমাত্র মেজো ভাই রাইস মোহাম্মাদের খেলা হয়নি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। একটি টেস্টে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের দ্বাদশ খেলোয়াড়।
হানিফ মোহাম্মাদের পিতা-মাতা দু’জনেই ক্রীড়াবিদ ছিলেন। বাবা ছিলেন ক্রিকেটার। আর মা ছিলেন দেশভাগের পূর্বে ভারতের জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন ও ক্যারমের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন।
এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের গল্পটাও দারুণ। হানিফ মোহাম্মাদের ছেলে শোয়েব মোহাম্মাদ পাকিস্তানের হয়ে খেলেছেন ৪৫ টেস্ট ও ৬৩ ওয়ানডে। টেস্টে সাতটি, ওয়ানডেতে একটি সেঞ্চুরি আছে তার। শোয়েবের ছেলে ও হানিফের নাতি শেহজার মোহাম্মাদ এখন পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলছেন। এখন পর্যন্ত ৪৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা শেহজারও স্বপ্ন দেখছেন পাকিস্তানের হয়ে ব্যাট হাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার। হানিফ, শোয়েব ও শেহজার তিন পুরুষেরই আছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করার কীর্তি। মেজো ভাই রাইস মোহাম্মাদের তিন ছেলে শহিদ, আসিফ ও তারিক খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। এমন ক্রীড়া পরিবার আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে!

মালদিনি পরিবার
ইতালি ও বিশ্ব ফুটবলের এক বনেদি পরিবার মালদিনিরা। ইতালি ও এসি মিলান ক্লাবের ফুটবলার সিজার মালদিনি ক্লাব ক্যারিয়ারে চারটি সিরি-আ লিগ শিরোপা ও একবার ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছেন। ১৯৬০ থেকে ৬৩ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ইতালি জাতীয় দলের হয়ে। তার সময়ে ছিলেন দুর্দান্ত ডিফেন্ডার। ক্লাব ও জাতীয় দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন সিজার।
খেলা ছাড়ার পর এসি মিলান ক্লাব, ইতালি ও প্যারাগুয়ে জাতীয়দলসহ অনেকগুলো দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কোচ হিসেবেও এসি মিলানকে এনে দিয়েছেন ইউরোপিয়ান কাপ।
তবে কৃতিত্ব আর অর্জনে বাবাকে ছাড়িয়ে গেছেন তার ছেলে পাওলো মালদিনি। ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারদের একজন তিনি। সেরা ফুটবলারদের ছোট তালিকাতেও তাকে রাখতে হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ইতালির হয়ে। ইতালির হয়ে কোন শিরোপা না জিতলেও বিশ^কাপ, ইউরো ও অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ^কাপে রানার্সআপ হয়েছেন। ক্লাব ক্যারিয়ারের দীর্ঘ ২৫টি বছর খেলেছেন শুধুমাত্র এসি মিলানের হয়ে। ক্লাবটির হয়ে সাতটি লিগ শিরোপা, পাঁচটি ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়ন্সলিগ শিরোপা ও একবার ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন।
ক্লাবের হয়ে ৬৪৭টি ও জাতীয় দলের হয়ে ১২৬টি ম্যাচ খেলেছেন পাওলো। তার দুই ছেলেও বর্তমানে ক্লাব ফুটবলে খেলছেন। বড় ছেলে ক্রিস্টিয়ান মালদিনি এসি মিলান যুবদলের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও দাদা-বাবার সুনামটা ধরে রাখতে পারেননি। যে কারণে খেলছেন ইতালির একটি তৃতীয় বিভাগের দলে। ছোট ছেলে ড্যানিয়েল মালদিনির বয়স ২০ বছর। তার মধ্যে কিছুটা দেখা যাচ্ছে পূর্বপুরুষের ছায়া। ইতোমধ্যেই ইতালি অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। ২০২০ সাল থেকে এসি মিলানের সিনিয়র দলেও খেলছেন। তবে তিনি বাবা-দাদার মতো ডিফেন্ডার না হয়ে, হয়েছেন মিডফিল্ডার।

অমরনাথ পরিবার
ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরিটি করেছিলেন লালা অমরনাথ। স্বাধীন ভারতের প্রথম ক্রিকেট অধিনায়কও ছিলেন তিনি। ১৯৩৩-৫২ সাল পর্যন্ত ২৪টি টেস্ট খেলেছেন ভারতের হয়ে। প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন ১৮৬টি।
তার ছেলে মহিন্দর অমরনাথ ভারতের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ^কাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারে ৬৯টি টেস্ট ও ৮৫টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন মহিন্দর। মহিন্দরের ভাই সুরিন্দর অমরনাথও ভারতের হয়ে ১০টি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডে খেলেছেন। একটি টেস্ট সেঞ্চুরিও আছে তার। লালা অমরনাথের আরেক ছেলে সুরিন্দর অমরনাথ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। তবে জাতীয় দলে সুযোগ হয়নি। সুরিন্দরের ছেলে দিগি¦জয় অমরনাথও ছিলেন ক্রিকেটার। প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন বেশ কয়েকটি।
সব মিলে ভারতের বিখ্যাত এই ক্রীড়া পরিবারের তিনজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। আরো দুজন খেলেছেন পেশাদার সার্কিটে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ।

আকমল ব্রাদার্স
পাকিস্তান দলের সাবেক তিন ক্রিকেটার কামরান আকমল, ওমর আকমল ও আদনান আকমল। তিনজনই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। কামরান সবার বড়, এরপর আদনান ও সবার ছোট ওমর। এদের মধ্যে বড় ও ছোটজন বেশ দাপটের সাথেই পাকিস্তান দলে খেলেছেন অনেকদিন। মেজো ভাই আদনান অবশ্য ২১টি টেস্ট ও পাঁচটি ওডিআইয়ের বেশি খেলতে পারেননি।
এই তিনজনের চাচাতো ভাই আবার পাকিস্তান দলের বর্তমান অধিনায়ক বাবর আজম। একই সাথে বড় হয়েছেন চারজন। ছোটবেলায় বাড়ির উঠানে খেলেছেন একই সাথে। একটি বাড়ি থেকে চারজনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সহজ বিষয় নয়।
এখানেই শেষ নয়। ওমর আকমলের শ্বশুর আবার পাকিস্তানের কিংবদন্তি লেগ স্পিনার আবদুল কাদির। ১৯৭৭-৯৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান দলের হয়ে খেলা কাদিরের টার্ন, গুগলি, ফ্লিপারে ব্যাটসম্যানদের ঘুম হারাম হয়ে যেত এক সময়। আবদুল কাদিরের তিন ছেলেই হয়েছেন বাবার মতো লেগস্পিনার। তবে বাবার খ্যাতির ধারে কাছেও যেতে পারেননি কেউ। বড় ছেলে রেহমান কাদির ছয়টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। মেজো সুলামান কাদির পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। ছোট ছেলে উসমান কাদির এখন পর্যন্ত পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৫, ১৯ ও ২৩ দলে খেলেছেন। খেলেছেন পিএসএল ও অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশেও। তাকে হয়তো ভবিষ্যতে পাকিস্তানের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা যেতে পারে। এদের চাচা অর্থাৎ আবদুল কাদিরের ভাই আলী বাহাদুরও খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট।

Share.

মন্তব্য করুন