মুন্নার সাত খালা আর এক মামা। মামা অর্থাৎ আবুল হোসেন একমাত্র ছেলে হওয়ায় নানা তার সব আবদারই মেটাতো। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মামা বললো, বিকো সাইকেল কিনে দিতে হবে। তখন পাকিস্তান আমল। ‘বিকো’র খুব সুনাম।
নানা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে।
কলেজের স্টুডেন্ট বলে কথা! হাতঘড়ি না হলে চলে? মামার আব্দার, ‘সিটিজেন নিউ মাস্টার’ ছাড়া অন্য কিছু কিনবে না।
নানা রাজি; আচ্ছা, ‘সিটিজেন’ই নিও।
১৯৭২/৭৩ সালের দিকে যুবকদের অনেকেই স্যুট পছন্দ করতো। মামারও সখ হলো স্যুট পরার। নানা তো সাব রেজিস্ট্রার অফিসের হেড ক্লার্ক ছিলেন। পয়সার অভাব ছিল না। মুন্নাদের রংপুরের বাসায় যখন আসতেন, মুন্না খেয়াল করেছে, নিচু আলমারির ওপরের পাটাতনে রাখা তার ছোট কাপড়ের ব্যাগটা পাঁচ টাকার নোট ও খুচরা পয়সায় পেট-টুমটুম করতো। মুন্না ২/৩ বার ওখান থেকে পয়সা সরিয়েছেও। পাঁচ টাকার নোট নেওয়ার সাহস হয়নি। তো নানা মৃদু হেসে বললো, ‘আবুল! তোর স্যুট পিন্দার সঅখ হইছে? আচ্ছা হউক! শীতের তো অ্যালাও মেলা দেরি। সময় মতো কিনি দেমো’।
আ! আবুল মামার হাসি তখন দেখার মতো। সেই আবুল মামা বিরক্ত হলে বা খুব রেগে গেলে চেহারা যে কতো বিশ্রী হয়ে ওঠে সে কথা না বলাই ভালো।
আবুল হোসেন সেই পাক আমলের বি কম পাস। মুন্নারা যখন সেনপাড়ায় বাসায় থাকতো তখনই তিনি বি কম পরীক্ষা দিয়েছিলেন। যখন রেজাল্ট বেরুলো মুন্নারা ততদিনে রাধাবল্লভ এসে পড়েছে। মুন্নার বাবা আব্দুস সামাদ আগেই পিটিশন দিয়ে রেখেছিলেন। মুন্নার ক্লাস টুতে পড়ার সময় সামাদ সাহেবের নামে বাসা বরাদ্দ হলো। তিন রুমের ছোট সুন্দর বাসা। ভবনগুলো সদ্য নির্মিত। বিদ্যুত, লাইনের পানি, ভেতরের দিকে বারান্দা, বারান্দা সংলগ্ন উঠোন… এসব ছিল। আর ওইসব সরকারি কোয়ার্টারসের পেছনে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ওপাশে কুকুটিয়া বিল। ভরা বর্ষায় নদীর মতো হয়ে যেতো। কতো রঙের কতো ধরনের পাখি যে বসতো ওই বিলে!
রংপুর শহরে টানা চার বছর কাটানোর ফলে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তো, গ্রামের বাড়িতে আবুল হোসেনের একটানা বেশিদিন থাকতে ভালো লাগতো না। ধামশ্রেণী ফিরে গেলেও, দেখা যেত, ৮/১০ দিন পর আবার রাধাবল্লভে এসে হাজির। মুন্নার আম্মাকে আবুল ‘বুবু’ বলে ডাকে। আব্দুস সামাদও তার এই সৌখিন শ্যালকটিকে খুব ভালোবাসে। সামাদ সাহেব ভোজনরসিক মানুষ। মুন্নাদের বাসায় ভালো-মন্দ রান্না হয় সবসমই। তারপরেও আবুল হোসেন এলে রুই/ইলিশ, খাসির মাংস ইত্যাদি কেনা হতোই। কেবল ছুটির দিনগুলোতে পরোটা হতো। বাকিসব দিনে মুন্নার আম্মা সকালেই ভাত রান্না করতো। সব্জি, ভর্তা, ডিমভাজা, সাথে হয়তো একটু ঘি থাকতো; দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে অফিসের দিকে হাঁটা দিতো মুন্নার আব্বা। না, ডাইনিং টেবিল ছিল না। সে যুগে শুধু উচ্চ পদস্থ চাকরিজীবীদেরই ঘরে ও জিনিসি দেখা যেতা। অ্যাকাউন্টস সেকশনের প্রধান হওয়ার পর আব্দুস সামাদও ডাইনিং টেবিল নিয়ে আসে বাসায়। সে অনেক পরের কথা। মুন্না তখন ক্লাস নাইনে। তাহলে আগে ভাত খাওয়া হতো কোথায়? মাদুর ছিল। কারুকাজ করা লম্বা, চওড়া মাদুরে গৌতম বুদ্ধের স্টাইলে বসে ভাত খেতো মুন্না ও তার বাবা। খাওয়ার সময় আবুল হোসেনের ভঙ্গি ছিল অদ্ভুত। মুখে ভাতের গ্রাস তোলার আগে সে প্লেটের ওপর একদম ঝুঁকে পড়তো! আর মুন্না তা দেখে ভাবতো, এতখানি বাঁকা হয়ে, মুখ একদম প্লেটের কাছে নিয়ে এসে মানুষ কী-করে যে ভাত খায়! যতদিন মাদুর পর্ব ছিল ততদিন আবুল হোসেন ওভাবেই ভাত খেয়েছে।
৩/৪ বছর বয়স থেকে মুন্না ফুটবল পাগল। নাইনে ওঠার পর জেলা স্কুলের ফুটবল টিমে তার জায়গা হয়। সুযোগসন্ধানী গোলদাতা ছিল মুন্না। রংপুরের বহু জায়গায় সে খেলেছে। কখনো কখনো হায়ার করে নেয়া হতো তাকে। আবুল হোসেন ক্রীড়ামোদী মানুষ। ফুটবলার ভাগ্নেটাকে সে খুবই আদর করে। একবার বেশ দামি একটা ফুটবলও গিফট দিয়েছে তাকে। মুন্না স্কুল টিমে চান্স পাওয়ার পর খুশির চোটে আবুল হোসেন কয়েক সের রসগোল্লা এনে সবাইকে খাইয়েছিল। প্রতিবেশীরাও বাদ যায়নি। ফূর্তিবাজ মানুষ বলতে যা বুঝায় এই লোক ছিল ঠিক তাই। ক্লাস নাইনে উঠেই মুন্নারা দল বেধে ‘মনিং শো’ দেখা শুরু করেছিল। সে সময় শহরের ‘ওরিয়েন্টাল’ হলে সকাল সাড়ে আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। মুন্নার সহপাঠী চকলেট, কেরানিপাড়ায় চকলেট করতো কি সবার আগে ‘মর্নিং শো’ দেখে ক্লাসে এসে তার বর্ণনা দিতো। সে কী জীবন্ত বর্ণনা! আর খালি বর্ণনা নয়, ইংরেজি মিউজিক এবং ওইসব ছবিতে ব্যবহৃত সাউন্ড সে প্রায় হুবহু তুলে আনতো ঠোঁটে! মুন্না ও তার অন্য বন্ধুরা চোখ বড় বড় করে শুনতো। সিনেমার প্রতি আকর্ষণটা এভাবেই তৈরি হয়েছিল মুন্নার। একদিনের কথা। আবুল হোসেন গ্রামে দিন পনের কাটিয়ে আবার শহরে ফিরে এসেছে। দু’দিন আগে, আসার সময়, তার চোখে পড়েছিল পোস্টার। উর্দু রোমান্টিক ছবি ‘মেহবুবা’ চলছে রংপুর ক্যন্টনমেন্ট হলে। হঠাৎ এক দুপুরবেলা আবুল হোসেন বলে, চলো বাবু, আজ ক্যন্টনমেন্ট যাই।
মুন্না বলে, ক্যান্টনমেন্ট! ওখানে কেন মামা? আবুল হোসেন রহস্য রাখতে চায়, আগে চলো তো! গেলেই দেখবা।
মুন্না বলে, নাআ; আগে বলেন!
এ ছেলেটা জেদী টাইপের, মামা ভালো করেই জানে। তাই বলতেই হয় তাকে, রংপুর ক্যন্ট. হলে একটা দারুণ সিনেমা চলতেছে। হেভি রোমান্টিক ফিল্ম, বুঝছো মামু? উজ্জল হয়ে ওঠে মুন্নার চোখ-মুখ। তাই নাআ! সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, হ্যাঁ মামা, আমি যাবো। কিন্তু শো কখন?
শো আরম্ভ হবে ঠিক তিনটায়। এখন তো পৌনে এক বাজে। আমরা লাঞ্চ খেয়ে আড়াইটার মধ্যে বের হয়ে যাবো বুঝলা? রিকশায় উঠলে বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না। এর আগে মামা-ভাগ্নে একবার মাত্র ছবি দেখেছিল একসঙ্গে। সেটা ছিল বাংলা সিনেমা। তো ওই ‘মেহবুবা’ দেখে আসার পর থেকে একটা জিনিস মুন্নার মাথায় সেটে আছে। ছিপছিপে সুশ্রী নায়িকাটির বড় বড় চোখের পাতা। মেয়েটার ছড়া করে বাধা খোঁপার স্টাইলও দৃষ্টি কেড়েছে ছেলেটার। মামা জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগলো রে সিনেমাটা?
মুন্না বলে, এরকম ফ্লিম আগে কখনো দেখি নাই মামা! পাকিস্তানের পাহাড়ি সিনারিগুলো, আহা! আর নায়িকার ওই খোঁপা, ড্রেসের স্টাইল!
হঠাৎ তার সেই লম্বা চোখের পাতা মনে পড়ে। এবং আবুল হোসেনকে সেটা বলে। আবুল হোসেন বলে, ও-ও! ভালো জিনিস খেয়াল করেছিস তো! শোন, নায়িকা হলো কাশ্মিরের মেয়ে। কাশ্মিরের মেয়েদের চোখের পাতা লম্বা লম্বা হয়। আবুল হোসেন গ্রাজুয়েট। তাছাড়া লোকটা অনেক বইপত্র পড়ে। গল্প-কবিতা, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি থেকে বাইবেল, কোরআন, হাদিস… সবকিছু। মুন্না ভাবে, মামা নিশ্চয় জেনেই বলেছে কথাটা। উনি তো গুল মারার লোক না। মুন্না মনে মনে হাসে।
ক্লাস এইট থেকে টেন পর্যন্ত-এই তিন বছরে মুন্না অনেক জায়গায় গেছে মামার সঙ্গে। সৈয়দপুর রেল কারখানা, দিনাজপুরের রামসাগর, বগুড়ার মহাস্থানগড় দেখে এসেছে। আবুল হোসেন ভাগ্নেকে মহররমের মেলায়ও নিয়ে গিয়েছিল দু’বার। তখন রংপুরের কালেকটরেট মাঠে আশুরা উপলক্ষ্যে জমজমাট মেলা বসতো। পরে আর মামার সঙ্গে কোথাও যাওয়া তো দূরের কথা, কোনো রকম আমোদ-স্ফূর্তিই হয়নি। তার কারণ আবুল হোসেনের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এসে যায় চল্লিশ বছরে পড়তে না পড়তেই। সেই সকালটার কথা মুন্না জীবনেও ভুলতে পারবে না।
রোববার। ছুটির দিন। ন’টার মতো বাজে। মুন্নারা কেবল নাশতা খেতে বসেছে। ছোট ভাই বাবু সব্জি দিয়ে পরোটা খাবে না। ও ডিম ভাজার জন্য জেদ করছে। বাসায় ডিম নেই। মুন্নার আম্মা কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না ছেলেটাকে। বাইরের দরজার কপাট একটু ফাঁক করা ছিল। আব্দুস সামাদ বলে, যা তো বাবা, ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে আয়।
মুন্না উঠে দরজার দিকে এগোতেই কানে আসে রিকশার শব্দ। কপাট খুলেই দ্যাখে, একজন যুবক মৌলভী রিকশা থেকে নামছে। মাথায় কিস্তি টুপি। মুখে বড় বড় দাড়ি। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত নামানো খয়েরি পাঞ্জাবি। আরে! এটা কে? পর মুহূর্তেই শুনতে পেল- ‘আসসালামু আলাইকুম’। এবার মুন্না আরও অবাক হয়। কারণ সে এতদিন জেনেছে ছোটরাই মুরুব্বীদের সালাম দেয়। কিন্তু এ লোক দেখি আমাকেও সালাম দিলো! মুন্না ওয়া আলাইকুমুস সালাম বলেই বুঝতে পারে এ ব্যক্তি অন্য কেউ না, তারই আবুল মামা! কেননা পোষাকে আচরণে পরিবর্তন হতেই পারে। কণ্ঠস্বর তো আর বদলানো যায় না।
আবুল হোসেন ভাগ্নের হাত ধরে হাসি হাসি মুখে ঘরে ঢোকে। আব্দুস সামাদ খাচ্ছিল। তাই সে ভগ্নিপতিকে সালাম দেয় না। তার পরিবর্তে বলে, বুবু আসসালামু আলাইকুম। বুবু মানে মুন্নার আম্মাও কম অবাক হয়নি। আবুলের কাছ থেকে এই প্রথম সে সালাম পেলো। মুন্না ভাবে, কীভাবে হলো এটা? হঠাৎ মামার এই পরিবর্তন!
পরে জানা গেল, ছবেদ নানার মাধ্যমে এমনটা হয়েছে। ছবেদ আলী ধামশ্রেণীরই মানুষ। পাশের মহল্লায় থাকে। আবুল হোসেন তাকে কাহা (কাকা) বলে ডাকে। তো সেই কাহাই তাকে চল্লিশ দিনের চিল্লায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরেই তার এই পরিবর্তন। মুন্না আজও ভাবে, মানুষ চেঞ্জ হয়। কিন্তু আবুল মামার পরিবর্তনটা কল্পনার বাইরে। ভাবা যায় না!

Share.

মন্তব্য করুন