প্রিয় বন্ধুরা, আজ আমি তোমাদের এমন একজন মানুষের কিছু ঘটনা বলবো, যা তোমাদের অবাক করবে। মানুষটা ছিল ইহুদি। শুধু ইহুদি বললে কম বলা হবে। সে ছিল ইহুদি ধর্মযাজক পরিবারের সন্তান। বাবা ছিল রাব্বী অর্থাৎ পুরোহিত। বাবার ইচ্ছা ছেলেও পুরোহিত পণ্ডিত হবে। তাই মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে হিব্রু ভাষায় খুবই পারদর্শী করে তোলা হয়। কিন্তু সেই ছেলেই কিনা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে লিওপোল্ড লুইস থেকে হয়ে গেলো মুহম্মদ আসাদ। পরবর্তীতে যে কিনা হয়ে উঠেছিল ইউরোপের বিখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী।
১৯০০ সালে বর্তমান পোল্যান্ডের লেমবার্গ শহরে তার জন্ম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন স্কুল পালিয়ে দুঃসাহসিক অভিযান আর উত্তেজনায় ছদ্মনামে অস্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যান। কিন্তু বয়স ১৮ না হওয়ায় তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পরে ১৮ বছর বয়সে যখন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গেল তখন যুদ্ধ শেষ হল, তারও স্বপ্নভঙ্গ হলো। নিরুপায় হয়ে ভিয়েনা ইউনিভার্সিতিতে ভর্তি হলো দর্শন ও শিল্পের ইতিহাস পড়তে। তখন শিল্প-সাহিত্য আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভিয়েনা ছিল ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত শহর। সেখানকার কফি হাউজগুলোতে তখন শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিকদের জমজমাট আড্ডা চলত। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক লেখাপড়া ভালো না লাগলেও কফি হাউজগুলোর আড্ডায় সে ঠিকই তর্কে হারিয়ে দিত অনেক বড় বড় পণ্ডিতদের। কেননা দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, মনোবিজ্ঞানে তার জ্ঞান ছিল খুবই প্রখর। ১৯২০ সালে ভিয়েনা থেকে ইউরোপ ভ্রমণে বের হন এবং ভ্রমণের সুবাদে ও সুবিধার্থে ছোট ছোট ও স্বল্পকালীন অনেক চাকরি করেন। এই সময়েই তার সাথে যোগাযোগ হয় বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির স্ত্রীর সাথে। তিনি তখন তার সাথে রাশিয়ার সাহায্যের জন্য গোপন মিশনে কাজ করেন। একজন টেলিফোনিস্ট থেকে যোগ্যতাবলে একজন সাংবাদিক হয়ে ওঠেন। তখন সাংবাদিকতার কাজ ছিলো যেমন সম্মানের তেমনি ঝুঁকিরও।
১৯২২ সালে ইউরোপ ত্যাগ করে চাচার সাথে জেরুজালেমে সংক্ষিপ্ত সফরে বের হন। সেখানে আরবদের জীবনদর্শন দেখে তাদের মত করে ইসলামকে জানতে ও বুঝতে শেখেন। এখানেই তার কৈশোর ও যৌবনের চিন্তা-চেতনার মোড় ঘুরে যায়। কিভাবে মানুষ তার প্রতিদিনের জীবনকে শান্তি ও সুন্দরের পরশে অর্থবহ করে তুলছে প্রতি মুহূর্তে তা দেখে তিনি বিস্মিত হন। এই বছরেই ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানজনক পত্রিকা ফ্রাংকফুর্টার যাইটুং এর সাংবাদিক হিসেবে ব্যাপক ভ্রমণ শুরু করেন ফিলিস্তিন, মিসর, জর্ডান, ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানে। মিশতে থাকেন মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সাথে। এখানে এসেই তিনি বুঝতে পারেন ইসলামের সাথে ইউরোপের অন্যান্য ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার পার্থক্য। ইউরোপ যেখানে শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে টাকা-পয়সা, খ্যাতি-প্রতিপত্তির দিকে, আর তাদের দেবতা বানিয়ে নিচ্ছে ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ, নায়ক, গায়কদের- তখনই ভোগ-বিলাস আর আরাম-আয়েশের জীবনে তারা হারিয়ে ফেলেছে সুখ-শান্তি। তাদের জীবন হয়ে উঠেছে অশান্তিময় উচ্ছৃঙ্খল। যে জীবন থেকে তারা বেরুবার পথ খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। অথচ মুসলিম জীবনপদ্ধতিতে বাড়াবাড়িরকম ভোগ-বিলাসের কোন আশ্রয়-প্রশ্রয় নেই। এখানে ইহকাল-পরকাল দুই কালের জন্য জবাবদিহিতার প্রয়োজনেই একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। এখানে মানুষে মানুষে টাকা-পয়সা ও খ্যাতির প্রতিযোগিতার চাইতে একে অন্যকে সহযোগিতার হাত বেশি প্রসারিত। আর এতেই এই জীবনের শান্তি। ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্ত্রীসহ পাতালরেলে এক দামি বগিতে ভ্রমণ করার সময় লিওপোল্ড লুইস লক্ষ্য করেন কিছু অভিজাত পরিবারকে, যাদের পোশাক খুবই দামি ও মার্জিত, তাদের খাবারের মান খুবই ভালো, চলাফেরায় আভিজাত্য স্পষ্ট হলেও তাদের মুখে হাসি নেই, চেহারায় আনন্দ নেই। কি অসুখী আর উদ্বিগ্ন চোখে ওরা তাকিয়ে আছে, কি বেদনাদায়ক মহিলাদের চোখগুলো। স্ত্রী এলসাকে বলতেই, এলসা বিষয়টা লক্ষ্য করে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, মনে হচ্ছে এরা নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে। বাড়ি ফিরে সংরক্ষিত কুরআন শরিফের পৃষ্ঠা উল্টাতেই তার চোখে পড়লো। তার নিজের ভাষায়, আমার চোখ আমার সামনে খোলা পৃষ্ঠায় পড়েছিল এবং আমি পড়লাম।
‘…তুমি যে নরকে আছো তা তুমি সত্যিই দেখতে পাবে।
সময়ের সাথে সাথে তুমি নিশ্চিতভাবেই এটি দেখতে পাবে।
আর সেদিন তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি জীবনের বর নিয়ে কি করেছো?
এক মুহূর্তে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার মনে হয় বইটি আমার হাতে কেঁপে উঠল। তারপর আমি এটি আমার স্ত্রী এলসার হাতে দিয়ে বললাম, এটি পড়। এটি কি পাতালরেলে আমরা যা দেখেছি তার উত্তর নয়? লোভের আকাক্সক্ষা গতকালের চেয়ে আজ আরো বেশি, লোভের এই ক্ষুধা মানুষের আত্মাকে চিরকালের জন্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংস থেকে বাঁচতে ঐ বছরেই লিওপোল্ড লুইস সস্ত্রীক ইসলাম গ্রহণ করলেন। নবী মুহম্মদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মুহম্মদ ও সাথে আসাদ যুক্ত করে হয়ে গেলেন মুহম্মদ আসাদ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কারণে বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, ছেড়ে দেন সংবাদপত্রের চাকরি। স্ত্রী এলসাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হজযাত্রায় মক্কার উদ্দেশে। আর এই যাত্রার মধ্য দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন ইসলামে শান্তির কোনো অভাব নেই, ইসলামী জীবনবিধানের কোন কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। এই ভ্রমণ ও ইসলামের এই চিন্তা থেকেই তিনি লিখে ফেলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘রোড টু মক্কা’। তার এই মক্কা ভ্রমণে প্রচুর দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা আছে, যা তার নিজের জীবনে ঘটে গেছে।
ইউরোপ থেকে মক্কার তথা আরবের পথ তখন সহজ ছিল না। আরবে তখন গড়ে ওঠেনি এখনকার মতো সুন্দর সুন্দর রাস্তাঘাট প্রাসাদ অট্টালিকা। তখনকার আরব ছিল বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর। আর সেই মরুতে চলাচলে একমাত্র বাহন ছিল উট। বালুময় মরুতে উটের পিঠে চড়ে শত শত মাইল তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। আবার কখনও পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে বহু পথ যেখানে ছায়া বলতে কোন গাছপালা বাড়িঘর ছিলো না, মাথার উপর প্রচণ্ড গরম সূর্য, উত্তপ্ত বালুর পথে হাঁটতে হয়েছে দিনের পর দিন। প্রচণ্ডক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন, কাতর থেকেছেন পানির পিপাসায় অনেক দিনরাত। মরুঝড়ে হারিয়ে ফেলেছেন উট, হারিয়েছেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা একমাত্র সঙ্গীকে তবু হাল ছাড়েননি। আল্লাহর উপর অসীম আস্থা রেখে পথ চলেছেন। এভাবে চলতে চলতে আবার ফিরেও পেয়েছেন নিজের উট, নিজের সঙ্গীকে। পথে পেয়েছেন ছোট বাজার যেখানে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন খাবার খেয়েছেন বিশ্রাম নিয়েছেন। আবার পথ চলেছেন, দেখেছেন রাতের মরুভূমির জ্যোৎস্না, বালুরাশির উপর জ্যোৎস্নœায় চাঁদের আলোর কি অপরিসীম মহিমা। সেই অভূতপূর্ব রাত দেখে ভুলে গেছেন ভ্রমণের কষ্টের কথা। রাতের পর রাত মরুভূমির নির্জনতা উপলব্ধি করেছেন। মাঝে মাঝে কিছু খেজুর গাছের বাগান সমৃদ্ধ গ্রাম চোখে পড়েছে। মনে হয়েছে এই তার বাড়ি, আশ্রয় নিয়েছেন, দারুণ আতিথেয়তায় বিস্মিত হয়েছেন। আবার পা বাড়িয়েছেন পথের উদ্দেশ্যে যে পথ তাকে মক্কায় নিয়ে যাবে। মরুভূমির বেদুঈনদের তাঁবুর সাক্ষাৎ পেয়ে মনে হয়েছে তিনি যান তাঁর নিকটজনদের কাছে এসেছেন। হ্যাঁ বেদুঈনরাও তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, তাদের জীবন দেখেছেন, তাদের জেনেছেন, রাত জেগে তাদের সাথে মরুভূমির গল্প বলেছেন, শুনেছেন, সাহসী হয়ে আবার ছুটেছেন। মরুভূমির পাহাড়, উপত্যকার পথে রক্তিম সূর্যের লুকিয়ে পড়াকে দেখেছেন বিমুগ্ধ চোখে, মাথার ওপর শিকারি পাখির চক্রাকারে চক্কর খাওয়া দেখে ভয়ে শিউরে উঠেছেন কখনও। আবার দূরে কোন যাত্রীদল দেখে সাহস ফিরে পেয়েছেন। এভাবে প্রচুর চড়াই-উতরাই আর অ্যাডভেঞ্চার পেরিয়ে একসময় মক্কায় উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন বাদশাহ সৌদের, যিনি বর্তমান সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা। এরপর তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। বাদশাহর দরবারে প্রথমে মেহমান, পরে তার শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে বাদশাহর বিভিন্ন রাজকীয় কার্যে সহায়তায় সম্পৃক্ত হন। বাদশাহ ইবনে সৌদের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠে। ছয় বছর তিনি আরব দেশে বসবাস করেন। এসময় তিনি আরবি ভাষা ও আরব জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হন। এর ফলে কুরআনের তরজমা করতে উদ্যোগী হন। এরপর তিনি বহু দেশে বহু বড় বড় কাজে সম্পৃক্ত হন। একসময় তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের মধ্যপ্রাচ্যে ডিভিশনের প্রধান হন। জাতিসংঘেও তিনি কাজ করেন বেশ কিছুদিন। ‘রোড টু মক্কা’ ছাড়াও তার আরেকটি শ্রেষ্ঠ কাজ হলো ‘দ্য মেসেজ অব কুরআন’। ১৯৯২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এই মহান মনীষী ইন্তেকাল করেন।
২০০৮ সালে ভিয়েনার জাতিসঙ্ঘের প্রবেশদ্বারটিকে তার কাজের স্মরণে ‘মুহম্মদ আসাদ প্ল্যাটজ’ নামকরণ করা হয় এবং তাকে ‘ধর্মীয় সেতু নির্মাতা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। মুহম্মদ আসাদকে তাঁর জীবনী লেখকরা ‘ইসলামের প্রতি ইউরোপের উপহার এবং ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বন্ধুরা, মুহম্মদ আসাদের মতো আমরাও একদিন ইসলামের জন্য দূর-দূরান্ত পথ পাড়ি দেয়ার কথা ভাবতে পারি।
কী বলো, পারি না?

Share.

মন্তব্য করুন