মাত্র আধঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা এসে পৌঁছাই মারোপেং ভিজিটরস্ সেন্টারে। দক্ষিণ আফ্রিকার এ অঞ্চলে গাছপালা কম। তবে প্রান্তরে প্রচুর বাদামি ঘাস। তাতে লুকোচুরি করে কান-খাড়া খরগোশ। এখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় শহর জোহানেসবার্গ মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। ভিজিটরস্ সেন্টারের দালানটি খুবই আধুনিক। আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি দোতালায়। মাইক্রোফোনে বাজছে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সঙ্গীত ‘নকোসি সিকেলেলি আফ্রিকা’ বা ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ ঝরে পড়–ক আফ্রিকায়।’ এখানে আসতেই ডিলেনির মন ভালো হয়ে ওঠে। সে উৎসাহের সাথে ভিজিটরস্ সেন্টারের দেয়ালে স্টারফরটেইন কেইভ নামে একটি গুহার ছবিগুলো দেখতে শুরু করে। আমাদের মেয়ে কাজরি আগেও এ ভিজিটরস্ সেন্টারে এসেছে। সে ডিলেনিকে ছবিগুলোর অর্থ বুঝিয়ে বলছে।
কাজরির বন্ধু ডিলেনি কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বেড়াতে এসেছে। আমরা জোহানেসবার্গ থেকে একটু দূরে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী প্রিটোরিয়া নগরীতে বাস করি। ডিলেনির বাবা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান। তার পূর্বপুরুষকে কয়েক শত বছর আগে ক্রীতদাস হিসেবে আমেরিকাতে নিয়ে আসা হয়। এরা তুলা চাষের খামারে কাজ করতেন। তারপর থেকে তারা আমেরিকাতেই বসবাস করছেন। আফ্রিকাতে কখনো ফিরে যাননি। তাই আফ্রিকা সম্পর্কে ডিলেনির খুব কৌতূহল।
ডিলেনি মাত্র দু’ সপ্তাহের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় বেড়াতে এসেছে। সে এখানকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজন কিভাবে বসবাস করে তা খুব কাছ থেকে দেখতে চায়। জোহানেসবার্গের শহরতলিতে আছে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজনদের বড় বড় বস্তি। এ বস্তিগুলোকে বলা হয় টাউনশিপ। টাউনশিপের একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা মিসেস মানডিসা ডেংগানা তার ঘর ভাড়া দেন পর্যটকদের কাছে। তো আমরা গতকাল তার ঘরের দু’টি কামরা ভাড়া করে রাত কাটিয়েছি। রাতে মিসেস মানডিসার ঘরে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে তিনি লণ্ঠন জ্বালিয়ে দেন। বেশ গরম পড়েছিলো, ফ্যান চালানো যায়নি বলে ডিলেনি বিরক্ত হয়। উঠানের চাপকল থেকে বাথরুমে এক বালতি পানি নিয়ে আসাও ডিলেনিকে অবাক করে। রাতে মিসেস মানডিসা আমাদের খেতে দেন উমপোখোকে। উমপোখোকে হচ্ছে যবের পেষা মন্ড দিয়ে তৈরি জাউ। তা ঝাল পিরিপিরি মরিচ ও কদুপাতার চাটনি দিয়ে খাওয়াটা সে পছন্দ করেনি। আজ সকালে আমরা টাউনশিপের চারদিকে একটু হাঁটাচলা করি। টিনের ছোট ছোট চালাঘরে গরিব শ্রমিকদের পরিবারগুলো বাস করছে। বস্তির পরিবেশ খুব নোংরা। আমেরিকার মেয়ে ডিলেনির এসব ভালো লাগেনি। আরো সমস্যা হয় সকালবেলার নাস্তা নিয়ে। মিসেস মানডিসা খুব যত্ন করে আমাদের খেতে দেন ইসোপো। ইসোপো হচ্ছে যবের দানা সিদ্ধ করে তৈরি স্যুপ। তা খেতে হয় আমাসি বলে টক দই মিশিয়ে। দই এর উৎকট গন্ধে তার গা গুলিয়ে আসে। সে মুখে কিছু দিতে পারেনি।
বিদেশে বেড়াতে গেলে খাওয়া ও বাসস্থান নিয়ে এ রকমের সমস্যা অনেকেরই হয়। ডিলেনি যে রকমের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত, যে রকমের ঘরে সে সব সময় বাস করে, তা পায়নি বলে তার মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে। তো মারোপেং ভিজিটরস্ সেন্টারের উপরের তলায় আছে একটি রেস্তোরাঁ। কাজরির মা হলেন ওখান থেকে চিজবার্গার ও ফ্রেঞ্চফ্রাই কিনে দিলে মেয়ে দুটি তা খুব খুশি হয়ে খেতে শুরু করে। আমি ও হলেন হেঁটে হেঁটে চলে আসি বেলকনিতে। ওখান থেকে খানিক দূরে স্টারফনটেইন কেইভ নামক গুহাটির সবুজ ঘাসে ছাওয়া টিলা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গুম্বুজের মতো গুহার গোলাকার টিলার দিকে হেঁটে যাচ্ছে বেশ কিছু পর্যটক। ডলামাইট লাইমস্টোনে তৈরি এ গুহাতে পাওয়া গেছে তিন কিংবা চার মিলিয়ন বছর আগের আদিম মানুষের জীবাশ্ম। জীবাশ্ম হচ্ছে কোন মানুষ, পশু বা অন্য কোন বস্তুর পাথর হয়ে যাওয়া কঙ্কাল। জীবাশ্মকে ইংরেজিতে বলা হয় ফসিল। হলেন ফসিল দেখা খুব পছন্দ করে। কারণ ফসিল থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে মানুষ বা জন্তু দেখতে কী রকম ছিলো তার একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
কাজরি ও ডিলেনির খাওয়া শেষ হলে পর আমরা হেঁটে চলে আসি স্টারফনটেইন কেইভের গুহামুখে। আরো কয়েক জন পর্যটক ও গাইডের সাথে আমরা গুহাতে ঢুকি। আমাদের কৃষ্ণাঙ্গ গাইড মিস্টার ফুনডানি বয়সে তরুণ। তিনি মজার মজার কথা বলতে ভালোবাসেন। মিস্টার ফুনডানি আফ্রিকান কায়দায় সকলের সাথে হ্যান্ডশেইক করেন। আফ্রিকান হ্যান্ডশেইক এর নিয়ম হচ্ছে প্রথমে কব্জির দু’দিকে মৃদু চাপ দেয়া, তারপর বুড়ো আঙুল মুঠো করে চেপে ধরা। মিস্টার ফুনডানি ডিলেনির সাথে এভাবে হ্যান্ডশেইক করতে গেলে সে অবাক হয়ে ছিটকে সরে যায়। তাতে মিস্টার ফুনডানি মনোক্ষুণœ হন না। তিনি মুখ বাঁকাচোরা করে বিচিত্র একটি গানের কলি গেয়ে হাততালি দিয়ে ওঠেন। আমরা পাথরের সিঁড়ি ধরে নামতে থাকি। আলো কমে আসে। তাপমাত্রাও নেমে যাচ্ছে। তাই শীত শীত লাগে। কোন কোন জায়গায় বেশ অন্ধকার বলে আমাদের সাবধানে হাঁটতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতেই হঠাৎ করে আলোকিত হয়ে ওঠে গুহার ভেতর। আমরা চলে এসেছি টিলার অনেক নিচের স্তরে। এখানে পাথরের ফাটল দিয়ে আসছে প্রচুর আলো। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। মিস্টার ফুনডানি যেন গান গাইছেন এ রকম সুরেলা গলায় বলেন, ‘আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে এখানে বাস করতেন আমাদের পূর্বপুরুষরা।’ তিনি কাজরি ও ডিলেনির দিকে চেয়ে বলেন, ‘লিটিল গার্লস্, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড.. তোমরা চলে এসেছো মানব সভ্যতার একদম শুরুর দিকে। এখানে মানুষ প্রথমে ব্যবহার করতে শিখে পাথরের হাতিয়ার। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষজন কিন্তু এ গুহা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। ১৯৪৮ সালে রবার্ট ব্লুম নামে একজন শ্বেতাঙ্গ এ গুহায় আবিষ্কার করেন আদিম মানুষের কিছু কঙ্কাল। একটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কালকে তিনি নামকরণ করেন ‘লিটিল ফুট’ বলে। লিটিল ফুট ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় একজন আদিম নারীর মাথার খুলি। তাকে তিনি মিসেস প্লেজ নাম দেন। মিস্টার ফুনডানি আমাদের নিয়ে আসেন গুহা-বিজ্ঞানী রবার্ট ব্লুমের মূর্তির কাছে। ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তির হাতে ধরা মিসেস প্লেজ এর করোটি। কিছু কিছু পর্যটক মূর্তি জড়িয়ে ধরে ছবি উঠাচ্ছে। মিস্টার ফুনডানি সত্যিই একটু আজব রকমের মানুষ। তিনি মনে হয় হাঁটাচলার চেয়ে নৃত্য করা বেশি পছন্দ করেন। কথাও বলেন তিনি সুরেলা গলায় ছড়া কেটে কেটে। তো হাতের আঙুলে চুটকি বাজিয়ে এক পাক নেচে গান গাওয়ার মতো তিনি বলেন, ‘লিটিল গার্লস্, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও রবার্ট ব্লুমের মূর্তি ছুঁয়ে অন্তত একটি ছবি উঠাও। মূর্তির হাতে ধরা করোটি ছুঁলে তোমরাও একদিন তার মতো আবিষ্কার করতে পারবে জীবাশ্ম।’ তার কথায় উৎসাহিত হয়ে কাজরি ছবি উঠাতে যায়। কিন্তু ডিলেনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে মূর্তির কাছে ভিড়তে অস্বীকার করে। সে খুলি, কঙ্কাল বা হাড়গোড় এসব পছন্দ করে না। তাই মুখ কালো করে একপাশে সরে দাঁড়ায়।
ছবি তোলা শেষ হলে পর আমরা আবার সিঁড়ি ভাঙি। নেমে আসি গুহার একদম নিচের ধাপে। এদিকে পাথরের খাঁজে খাঁজে খুব অল্প ভলটেজের বিজলি বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। মাটির অনেক নিচে নেমে এসেছি, তাপমাত্রাও কমে গেছে। শরীরে শীত শীত লাগে। আধো অন্ধকারে পরিবেশ কেমন যেন ছমছমে হয়ে আছে। কাজরিই প্রথমে খেয়াল করে- সিঁড়ির নিচে বেশ বড়সড় একটি চাতাল। তার ওপারে হালকা আলোয় ছলছল করছে জল। বুঝতে পারি আমরা দাঁড়িয়ে আছি মাটির নিচের একটি সরোবরে। এ ধরনের সরোবরকে বলা হয় ‘আন্ডার ওয়াটার লেইক’ বা ‘ভূগর্ভস্থ হ্রদ’। আমি এর আগে কোন ভূগর্ভস্থ হ্রদ দেখিনি, তাই ভালো করে দেখার জন্য তার পাড়ে এসে দাঁড়াই। খুব রঙচঙে পোশাক পরা কয়েকটি মেয়ে খিলখিলিয়ে হেসে চলে যায় পাথর খুদে তৈরি একটি গর্তের ভেতর। তখনই ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল আলো জ্বলে ওঠে। আশি বা বিরাশি বছর আগে কিছু মানুষ এ গুহায় ঢুকে সংগ্রহ করে খনিজদ্রব্য। পাথর খুদে তৈরি গর্তটি তারা তৈরি করে ডিনামাইট ফাটিয়ে। কিন্তু রঙচঙে কাপড় পরা মেয়েগুলো গেলো কোথায়?
রাশভারী একজন মহিলা এসে আমাদের ‘গুড আফটারনুন বলেন। তার মুখখানা চাঁদের মতো গোলাকার। তাতে লাল রঙে আঁকা চারটি গোলক। গোলকের চারপাশে সারি দিয়ে আরো আঁকা সাদা সাদা ফুটকি। আমরা কথাবার্তা বলি। তার নাম মিসেস বাবালওয়া বাংগানা। তিনি ক্বোসা গোত্রের মানুষ। টাউনশিপ বা বস্তির একটি স্কুলে ক্বোসা গোত্রের ছেলেমেয়েদের নাচ শেখান। আজ তিনি কয়েকটি ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন গুহায়। তারা এখনই হ্রদের পাড়ে নৃত্য পরিবেশন করবে। স্পিকারে নৃত্যের মিউজিক বেজে ওঠে। মিসেস বাবালওয়া ডিলেনির কাছে গিয়ে তার চিবুকে হাত রেখে বলেন, ‘তুমি দেখতে আমাদের ক্বোসা গোত্রের মেয়েদের মতো তবে তোমার গায়ের রঙ একটু ফরসা।’ ডিলেনি জবাব দেয়,‘আমার বাবার পূর্বপুরুষরা ছিলেন আফ্রিকার মানুষ। তাই আমি দেখতে আফ্রিকানদের মতো। তবে আমার মা ছিলেন আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মহিলা। সে কারণে আমার গায়ের রঙ ফরসা।’ এবার মিসেস বাবালওয়া তাকে মেয়ে সম্বোধন করে বলেন, ‘ডটার, টেল মি হোয়াই ইউ আর সো স্যাড টু-ডে? তুমি তো আমার মেয়ের মতো, এত মন খারাপ করে আছো কেন?’ ডিলেনি তাতে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘মিসেস বাবালওয়া, মন খারাপের বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত। এ ব্যাপারে আমি আপনার সাথে কোন কথা বলতে চাই না।’ মিসেস বাবালওয়া এতে মনোক্ষুণœ হয়ে সরে এসে আমাদের বলেন,‘ঠিক আছে, তাহলে আপনারা এবার ক্বোসা গোত্রের ছেলেমেয়েদের নৃত্য উপভোগ করুন।’
হ্রদের পাড়ে নেচে ওঠে চারটি মেয়ে। তাদের গায়ে পুঁতির মতো ঝকমকে রঙিন বিড দিয়ে তৈরি জামাকাপড় ও অলঙ্কার। নাচের সাথে তাল রেখে স্পিকারে বাজে ক্বোসা ভাষায় বিচিত্র একটি গান, ‘ক্বোসা লাবা আবা ডাকিউয়ে/উকুজে লাবা আবা বেমিলে…।’ মেয়েগুলো খুব খুশি মনে হেসে হেসে নৃত্য করছে। তাদের পাশে ঢাল ও বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছেলে। আমি মিসেস বাবালওয়ার কাছে জানতে চাই, ‘আপনি এদের দিয়ে গুহার ভেতরে নৃত্য করাচ্ছেন কেন?’ তিনি জবাব দেন, ‘এ গুহাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সেতসোওয়ানা ভাষায় বলা হয় মারোপেং। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের আদি শিকড়ে ফিরে যাওয়া। এখানে তো অনেক বছর আগে বাস করতেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। তাদের আত্মা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে এ গুহায়। আমাদের মেয়েগুলো হাসিমুখে নৃত্য করে দেখাতে চাইছে-তাদের সন্তান হিসাবে আমরা খুশি মনে পৃথিবীতে বাস করছি।’
নাচ শেষ হলে পর কাজরি গিয়ে ক্বোসা মেয়েদের সাথে কথা বলে। খুব উৎসাহিত হয়ে সে ফিরে এসে বলে, ‘বাপি, আমি একটি ক্বোসা শব্দ শিখে নিয়েছি। কাউকে ক্বোসা ভাষায় ধন্যবাদ বলতে চাইলে বলবে এনকসি।’ একটু আগে নাচ করা একটি ক্বোসা মেয়ে এগিয়ে এসে ডিলেনিকে জিজ্ঞস করে, ‘উনগাথানডা উকুডানসা?’ মিসেস বাবালওয়া অনুবাদ করে বুঝিয়ে বলেন- ক্বোসা মেয়েটি জানতে চাইছে ডিলেনি তাদের সাথে নাচতে চায় কি না? ডিলেনি নাচতে কোন আগ্রহ দেখায় না। কাজরি ক্বোসা মেয়েটিকে ‘এনকসি’ বা ধন্যবাদ বলে আফ্রিকান কায়দায় হাত মেলায়।
ডিলেনির মন ভারী হয়ে আছে, তাই আমরা আর দেরি না করে গুহা থেকে বেরিয়ে আসি। ফেরার জন্য গাড়িতে উঠতে যাবো, দেখি ডিলেনি একটু দূরে সরে গাছের তলায় একা দাঁড়িয়ে চোখ মোছছে। কী ব্যাপার? হলেন জবাব দেয়,‘বুঝতে পারছি না। মেয়েটা কেন জানি মন খারাপ করে কাঁদছে।’ কাজরি তার সাথে কথা বলতে এগিয়ে যায়। কাজরি ও ডিলেনি পাশাপাশি বাড়িতে এক সাথে বড় হয়েছে। তাদের বন্ধুত্ব অনেক দিনের। আগে কিন্তু ডিলেনি এ রকম মন খারাপ করতো না। মেয়েটা ছিলো খুবই হাসিখুশি স্বভাবের। বছর দেড়েক আগে ক্যান্সারে তার মায়ের মৃত্যু হয়। তারপর থেকে ডিলেনি বাস করছে তার খালা-খালুর সাথে। মৃত্যুর পর থেকে মেয়েটি খুব মনমরা হয়ে গেছে। সামান্য কিছুতে বিরক্ত হয়, রেগে যায়, কান্নাকাটি করে। মৃত্যু সব সময়ই দুঃখজনক। যদি কারো মা-বাবা বা নিকটজনের মৃত্যু হয়, তাহলে আমাদের উচিত তাদের সাহায্য করা। তাই আমি ও হলেন চিন্তা করি-কী করলে ডিলেনির মন ভালো হয়ে উঠবে। কাজরি ফিরে এসে বলে যে- ডিলেনি ভেবেছিলো গুহাতে সে হরিণ, জেব্রা বা সিংহ দেখতে পাবে। আদিম মানুষের মাথার খুলি, কঙ্কাল এসব দেখতে তার কোন আগ্রহ নেই। সে চেয়েছিলো গুহাতে বসে থাকা একটি জেব্রা বা সিংহের ছবি তুলতে। গুহাতে গিয়ে এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে তার সারাটা দিন মাটি হলো। সমস্যা বুঝতে পেরে হলেন গিয়ে তাকে হাত ধরে গাড়িতে নিয়ে আসে। আমিও তাকে আশ্বস্ত করে বলি,‘লিসেন ডিলেনি, আমরা এখন দক্ষিণ আফ্রিকাতে আছি। এখানে হরিণ, জেব্রা বা বুনো মহিষ খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু না।’
হলেন জোরে গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে আসে ক্রুগারস্ড্রপ গেইম রিজার্ভে। এখানে চরে বেড়ানোর কথা বুনো জন্তুদের। তো আমরা আস্তে ধীরে গাড়ি চালাই। বেশ কিছু উটপাখিকে আমরা ঘাস মাড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখি। কিন্তু এসব পাখিতে ডিলেনির তেমন কোনো আগ্রহ নেই। সে প্রত্যাশা করেছিলো সিংহ। এখানে সিংহ অবশ্যই আছে। কিন্তু প্রচণ্ড রোদে তারা হয়তো এখন গুহাতে বসে ঝিমাচ্ছে। সিংহের গুহাতে চাইলে তো আর ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঢুকে পড়ে বলা যায় না,‘হ্যালো মিস্টার লায়ন। একটু পোজ দিন তো দেখি, আই লাইক টু টেক ইয়োর পিকচার।’ তো আমরা ঘাসের বিশাল মাঠ পাড়ি দিয়ে এসে পড়ি জঙ্গলের কাছে। এখানে দেখা পাওয়া যায় শক্তপোক্ত দুটি শিংগাল হরিণের। এদের একটি দাঁড়িয়ে, অন্যটি ঘাসে বসে আরামসে জাবর কাটছে। ডিলেনি গাড়ির জানালা খুলে ক্যামেরায় ক্লিক করে।
আমরা আরো কিছুক্ষণ গাড়ি চালাই। তিনটি জেব্রা গাড়ির আওয়াজ শুনে যেন লজ্জা পেয়েছে এরকম ঝোপের আড়ালে মুখ লুকায়। ক্রুগারর্সড্রপ রিজার্ভে কাজরি তার স্কুলের বন্ধুদের সাথে আগেও একবার এসেছে। সে একটি বাচ্চা জিরাফের কথা বলে। বেবি জিরাফটি নাকি গাড়ির জানালার কাছে এসে মানুষে হাত জিবে ছুঁয়ে দেয়। ডিলেনি এ জিরাফটিকে দেখতে চায়। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমরা বাচ্চা জিরাফের দেখা পাই না। অবশেষে গাড়ি থামিয়ে হলেন রিজার্ভের রেঞ্জার এর কাছে জানতে চায়- বাচ্চা জিরাফটি কোথায়? জবাবে তিনি বলেন- বেবি জিরাফের সর্দিকাশির সাথে খুব জ্বর এসেছে। পশু-ডাক্তার তাকে কম্বল দিয়ে প্যাঁচিয়ে হাসপাতালে শুইয়ে রেখেছেন। তবে চাইলে আমরা উত্তর দিকের বড় মাঠে যেতে পারি। ওখানে মা জিরাফ ঘাস খাচ্ছে।
উত্তর দিকের বড় মাঠে এসেও আমাদের আশা পূরণ হয় না। এখানে কোথাও আমরা জিরাফ-টিরাফ কিছু দেখতে পাই না। তবে মাঠে বিশাল দুটি বেলুন দেখতে পেয়ে ডিলেনি খুশি হয়। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখি- কিভাবে বেলুনে গরম বাতাস পোরা হচ্ছে। একটু পর পর্যটক নিয়ে বেলুন দুটি উড়ে আকাশে। একজন রেঞ্জার আমাদের বেলুন উড়ানোর কলাকৌশল বুঝিয়ে বলেন।
বাড়ি ফেরার পথে আমরা একটি রেস্তোরাঁয় থামি। এখানে পাওয়া যায় ডিলেনির প্রিয় খাবার মেক্রোনি অ্যান্ড চিজ। হলেন ও ডিলেনি মেক্রোনি অ্যান্ড চিজের অর্ডার করলে আমি ও কাজরি মাশরুম পিৎসা আনতে বলি। মুখরোচক খাবার খুঁজে পাওয়াতে আমাদের সকলের মন ভালো হয়ে যায়। ডিলেনির মুখেও ফুটে মৃদু হাসি।

Share.

মন্তব্য করুন