ভাড়া বাসা ছেড়ে আজ আমরা নিজেদের বাড়িতে উঠলাম। এ কারণে সবাই খুব খুশি। এক সপ্তাহ যাবৎ ভাড়া বাসার জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করে ভ্যানে তুলে নতুন বাড়িতে রেখে হাতে সময় থাকলে যে যার মতো নিজেদের ঘর গুছিয়েছি। বাড়ির ছাদে উঠে আমার বোন কেমি মহা খুশি! তার পরিকল্পনা- নানা রকম গাছে ছাদটাকে এমনভাবে সাজাবে, সবাই এটাকে ছাদ না বলে বাগান বলবে। এসব কারণে আমাদের খুশির সীমা নেই। তাছাড়া নিজেদের বাড়িতে থাকার মজাই আলাদা। ভাড়া বাড়িতে বাড়িওয়ালার নিজের তৈরি কত না আইন-কানুন! সেসব আইন-কানুন অন্যের ওপর প্রয়োগ করা সহজ, কিন্তু নিজের বেলায় নয়! এই যেমন- রাত দশটার আগে বাসায় ফিরতে হবে, বাসায় ঘন ঘন মেহমান আসা চলবে না, জুতায় শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করা যাবে না ইত্যাদি।
এ বাড়িতে ওঠার তিন মাসের মাথায় আমার বড় ভাই বাড়ির ছাদে ছোট্ট একটা খোঁপে দুই জোড়া কবুতর পুষতে শুরু করেছিল। সাত দিনের মাথায় বাড়িওয়ালা তাতে ভেটো দিয়ে বসলেন! ভাইয়া আর কী করবে; কবুতরগুলো উড়িয়ে দিল!
একদিন স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির গেটে একটা কুকুর বসে থাকতে দেখলাম। কুকুরটাকে দেখেই মনে পড়ে গেল- আজ বাসা থেকে নেয়া টিফিন খাওয়া হয়নি। স্কুল ব্যাগ থেকে টিফিনবক্সটা বের করে খাবারগুলো কুকুরটার সামনে দিলাম। যেই না কুকুরটা খেতে শুরু করেছে অমনি কোত্থেকে বাড়িওয়ালা এসে হাজির! গেটের সামনে কুকুরটাকে খেতে দেখে হুম করে এক লাথি কষাল কুকুরটার পাছায়। লাথি তো নয়, যেন ফুটবলে কিক মেরেছে! লাথি খেয়ে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল কুকুরটা।
বাড়িওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গেটের সামনে কুকুরটাকে খাবার দেবে না আর! তাহলে কিন্তু তোমার বাবার কাছে নালিশ দেব!’
তাহলে কিন্তু আর কী? সেদিন রাতেই বাবা আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমরা তো এ বাড়িতে ভাড়া থাকি। তাই ইচ্ছে করলেই কোনো কিছু করা ঠিক না বাবা। কুকুরটাকে আর খেতে দিস না।’
বাড়িওয়ালার মতো আমার বাবা তো আর রগচটা নন; তাই নরম গলায় কথাগুলো বললেন।
বাবা অমন করে বলায় আমিও ভাবলাম- কুকুরটাকে আর খাবার দেবো না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে রোজ টিফিন খেতে গেলেই কুকুরটার কথা মনে পড়ে যায়! যেন নিজের অজান্তেই কুকুরটার জন্য সামান্য খাবার রেখে দেই। আর বাড়ির গেটে এসে কুকুরটাকে খুঁজি।
গেট থেকে কিছু দূরে বসে থাকে কুকুরটা। যেন ও-ও বাড়িওয়ালার নিষেধাজ্ঞা বুঝতে পেরেছে! আমি কুকুরটাকে ডেকে আরো কিছু দূরে নিয়ে খেতে দেই। এ খবরও বাবার কানে পৌঁছে গেল। বাবা আগের মতোই নরম গলায় বললেন, ‘তোকে বারণ করলাম। তারপরেও কুকুরটাকে…।’ একটু থেমে বাবা বললেন, ‘মৃদুল, আমরা ভাড়া বাসায় থাকি রে বাবা। ভাড়া বাসায় থাকলে বাড়িওয়ালার কথা মেনে চলতে হয়। নিজের বাড়িতে থাকলে না হয় কথা ছিল।’
বাবার কথা শুনে ভাবলাম- নাহ্, কুকুরটাকে আর খাবার দেবো না। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে গেটের কাছে এলে কুকুরটার দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যায়। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও।
কুকুরটার অমন দৃষ্টি ভালো লাগে না বলেই আগের মতোই বাবার নিষেধ অমান্য করে কুকুরটাকে খাবার দিই। তারপর এ নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে বাবার ঝগড়া বেধে গেল। বাড়িওয়ালার অভিযোগ- আমার প্রশ্রয় পেয়েই কুকুরটা তার বাড়ির গেটের কাছে আস্তানা গেড়েছে। এসব নোংরা জন্তু রোগ ছড়ায়। তার ছোট ছেলেমেয়ের অসুখ বাধতে পারে!
সে যেন-তেন ঝগড়া নয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, এবার বাবা আমাকে কিছুই বললেন না!
এর মাস ছয়েক পরে বাবা একদিন আমাদের সবাইকে বসার ঘরে ডাকলেন। আমরা ভাবলাম না জানি কী ঘটেছে আবার! কারণ জরুরি কোনো বিষয়ে বাবা আমাদের সবাইকে এভাবে এক জায়গায় হাজির করেন।
আমরা উৎসুক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে।
বাবা বললেন, ‘তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দেবো।’
‘কী সারপ্রাইজ বাবা?’ আমাদের ত্বর সইছে না।
‘আমাদের নিজেদের বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে। আপাতত এক তলা। সারপ্রাইজ দেবো বলে এতদিন তোমাদের বলিনি। এবার নিজেদের মতো করে থাকা যাবে। টিপুকে কেউ কবুতর পুষতে বারণ করবে না। কুকুরকে খেতে দিলে মৃদুলকে কেউ বকবে না।’ বলে প্রাণ খুলে হাসলেন বাবা।
বাবার সঙ্গে আমরাও হাসতে শুরু করলাম।
মাসের শেষ ভাগে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলাম আমরা।
মা আর কেমিকে রিকশায় তুলে দিয়ে একটা ভ্যানে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ভাইয়া, অন্যটাতে বাকি জিনিসপত্র নিয়ে আমি আর বাবা চলেছি। হঠাৎ দেখি গেটের সেই কুকুরটা আমাদের ভ্যানের পেছনে পেছনে ছুটেছে। বাবাকে দেখালাম। বাবা বললেন, ‘ও তো আমাদের ফলো করছে রে!’
‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি বাবা।’
‘করুক গে। এখন তো আর বাড়িওয়ালার ভয় নেই! ওটাকে এখন থেকে আমরা পুষব। আসলে হয়েছে কী, তুই ওকে আদর করে খেতে দিস তো, তাই তোর পিছু ছাড়ছে না। পশুরাও মানুষের মতো আদর-ভালোবাসা বোঝে!’
এরপর থেকে কুকুরটা আমাদের বাড়ির আঙিনায় জায়গা করে নিলো। এখন আর ওর জন্য আমার টিফিন থেকে খাবার রাখতে হয় না। মা ওকে আলাদা করে খাবার দেন।
রাত হলেই আমাদের বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে পাহারায় বসে কুকুরটা।
এক রাতে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল।
কুকুরটা ঘেউ ঘেউ ডাকতে শুরু করল। অনবরত ঘেউ ঘেউতে অতিষ্ঠ হয়ে ঘুম থেকে জেগে বারান্দায় গেলেন বাবা। গিয়েই এক চিৎকার। বাবার চিৎকারে আমাদের ঘুম কেটে গেল। যদিও কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে আগেই ঘুম হালকা হয়ে গিয়েছে।
বারান্দায় ছুটে এলাম সবাই। এসে ভয়ে থ। আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে।
ভাইয়া হঠাৎ এক সাহসী কাজ করে বসল। হঠাৎ ‘ডাকাত’ ‘ডাকাত’ বলে চিৎকার জুড়ে দিল।
মা থামাতে চেষ্টা করলেন- ‘থাম টিপু! থাম!!’
ভাইয়া থামে না। দুই ডাকাত ছুটে এলো। অমনি আরো জোর গলায় ডাকতে ডাকতে কুকুরটা ছুটে এলো ওদের পিছু পিছু। বারান্দায় উঠেই এক ডাকাতের পায়ে কামড় বসিয়ে দিল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ডাকাতটা। কিছু বুঝে ওঠার আগে অন্য ডাকাতটার পায়েও কামড় বসিয়ে দিল।
ততক্ষণে আমাদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এলো। তা দেখে ডাকাতরা খেপে গিয়ে মারামারি বাধিয়ে বসল। বাবাকে কিল-ঘুষি মারতে লাগল। প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই ডাকাতরা গেটের দিকে ছুট দিল। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করতে করতে ডাকাতদের পেছনে ছুটল। তারপর হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠলেও সবাই বলল- ডাকাতরা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ফাঁকা গুলি ছুড়ছে, যেন ভয়ে কেউ ওদের পিছু না নেয়।
আমরা বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত হলাম। প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন ডাক্তার ছিলেন। বাসা থেকে তার ডাক্তারি যন্ত্রপাতি আনিয়ে বাবার চিকিৎসা করলেন। তারপর বাবাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে চলে গেলেন। অন্য প্রতিবেশীরা একে একে আগেই চলে গিয়েছে।
মা বললেন, ‘তোরা শুয়ে পড় গে।’
সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে কুকুরটার জন্য খাবার নিয়ে বারান্দায় এলাম। কাল রাতের কথা মনে পড়ল। কাল ডাকাতদের সঙ্গে যা ফাইট করল ও! কিন্তু কুকুরটাকে দেখছি না কোথাও। গেটে এসে এদিক-ওদিক তাকালাম, কোথাও দেখছি না ওকে।
আমাদের বাসার সামনের করিম দোকানদার বলল, ‘তোমার কুত্তাডা খুঁজতেছ তো? ওইডা তো সামনের রাস্তার মোড়ে মইরা পইড়া আছে।
করিম চাচার কথা শুনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। তার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। দৌড়ে ঘরে এসে ভাইয়াকে ডেকে রাস্তার মোড়ে ছুটলাম। এসে দেখি করিম চাচার কথাই ঠিক। আমাদের কুকুরটা মরে পড়ে আছে। ওর পেটে একটা ফুটো। ফুটো বেয়ে রক্ত ঝরার শুকনো দাগ।
ভাইয়া বলল, ‘এটা তো গুলির চিহ্ন মনে হচ্ছে! তার মানে কাল রাতে যে গুলির শব্দ হয়েছিল তা আমাদের কুকুরের গায়ে লেগেছে! এ নিশ্চয়ই ডাকাতদের কাজ! কুকুরটার কারণেই আমাদের বাসায় আর ডাকাতি করতে পারেনি ওরা। চল, কুকুরটাকে বাসায় নিয়ে যাই। নয়তো সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যাবে।’
দু’ভাই কুকুরটাকে তুলে গেটের ভেতরে এনে রাখলাম। তারপর মাকে ডেকে আনলাম।
মা এসে কুকুরটার অবস্থা দেখে হা হা করে উঠলেন। ম্লান গলায় বললেন, ‘আহা রে, এই ছিল কুকুরটার ভাগ্যে!’
ব্যথার শরীর নিয়ে বাবাও উঠে এলেন। কুকুরটার অবস্থা দেখে তারও মন খারাপ হয়ে গেল।
মা বললেন, ‘মৃদুল, ভাড়া বাসায় থাকতে তুই যে কুকুরটাকে আদর করতি, কুকুরটা জীবন দিয়ে তার প্রতিদান দিয়ে গেছে। কাল রাতে ও ডাকাতদের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে কী যে হতো, ভাবতে পারিস!’
‘কিন্তু কুকুরটাকে এখন কী করবি?’ বাবা জানতে চাইলেন।
ভাইয়া বলল, ‘কী আর করব? রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসব। সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে।’
‘না। তা হবে না।’ আমি বললাম।
সবাই আমার মুখের দিকে তাকাল। সবার চোখে কৌতূহল।
আঙুল তুলে আমাদের ছোট্ট আঙিনার দক্ষিণ কোণটা দেখিয়ে বললাম, ‘ওইখানে একটা গর্ত করে ওকে পুঁতে রাখব। আর পাশে একটা জবা ফুলের গাছ লাগিয়ে দেব। তবু বুঝব আমার কুকুরটা ওখানে শুয়ে আছে।’
বাবা বোধ হয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন! বললেন, ‘আমাদের দবির মিয়াকে ডেকে আন। ও সব ব্যবস্থা করে দেবে।’
দবির মিয়া আমাদের বাঁধা রিকশাওয়ালা। প্রতিদিন আমাদের দু’ভাইকে স্কুলে আনা-নেয়া করে।
তাকে পাওয়া গেল। দবির মিয়া আর আমরা দু’ভাই মিলে মাটি খুঁড়ে কুকুরটাকে রেখে মাটি চাপা দিতে দিতে বললাম- ‘বন্ধু বিদায়!’
অমনি মন দুলে উঠল। চোখের কোণ ভিজে উঠল।

Share.

মন্তব্য করুন