ফাতেমা তুজ জোহরা আমাদের দেশের একজন প্রখ্যাত শিল্পী। বিশেষ করে নজরুল সঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে তিনি সবার কাছে পরিচিত। গান তার হৃদয়ের সাথে জড়িয়ে আছে। হৃদয় দিয়েই তিনি গানের গভীরে প্রবেশ করেন। তেমনি হৃদয় থেকে অনুভব করেন আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে। নজরুলের গান নিয়ে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বইও রচনা করেছেন। পাশাপাশি ইসলামী গানের প্রতিও রয়েছে তার গভীর ভালোবাসা। দেশের বিভিন্ন চ্যানেল ও ইসলামী গানের বড় আয়োজনের সাথে থাকেন তিনি। থাকেন গুরুত্বপূর্ণ বিচারক হিসেবে। তিনি তার শিশুকাল থেকে জীবনের নানান বিষয়ে এবং গান নিয়ে খুব সরল-সহজ করে কথা বলেছেন কিশোর পাতার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার হোসেন

আপনার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই।
ছোটবেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম! সাধারণ মেয়েরা যেমন হয় আমি কেনো যেনো সেরকম ছিলাম না। সবাই খেলাধুলা করে ছোটকালে, আমিও করতাম। কিন্তু আমার গতি ছিলো ওদের চেয়ে অনেক বেশি। ওরা একহাত চললে, আমি তিন হাত এগিয়ে থাকতাম। মাছ ধরতাম। সাঁতার কাটতাম। সাইকেল চালাতাম। সেলাই করতাম সেই ছোটবেলা থেকেই। কাটিং করার কাজও শিখে গেছিলাম। এর ভেতর স্কুল, লেখাপড়া চলতো। আমার স্কুলটি ছিলো বেশ কিছু দূরে। কিন্তু যেতাম স্কুলে।

বেশ মজার ছিলো আপনার শৈশব এবং কৈশোরকাল।
খুব সত্যি কথা। অনেক মজারই ছিলো। এত দুরন্তপনায় কেটে গেলো সেই ছোটবেলা! এখন খুব মনে পড়ে। কিন্তু মজার বিষয় হলো- দুরন্তপনা করতাম ঠিক! কিন্তু অকারণ আড্ডা দিতাম না। আমার বাবা আড্ডা পছন্দ করতেন না।
আড্ডা করতেন না মানে বান্ধবীদের সাথে খেলতেন না!
বান্ধবীদের সাথে খেলতাম না ঠিক কথা নয়। খেলতাম। কিন্তু সারাক্ষণ বান্ধবীদের সাথে কাটিয়ে দেয়ার যে বিষয় সেটি ছিলো না আমার। বলতে পারো একাই ঘুরে বেড়াতাম।

গানের জগতে ঢুকলেন কী করে?
জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোনো কিছু না বোঝার আগেই গানের জগতে ঢুকে পড়েছি!
একটু বুঝিয়ে বলবেন?
বলবো না কেন! বিষয়টি হলো, আমি একেবারে ছোট যখন, অর্থাৎ শিশু যখন ঠিক তখন থেকেই গান করি। গান শিখি। মনের ভেতর গান কেমন জানি আকুপাকু করতো! মনের কোণে সুর খেলা করতো। সেই অনুভূতিটাই আমাকে গানের দিকে টেনে এনেছে।

এর পেছনে কারো অনুপ্রেরণা ছিলো?
নিশ্চয় ছিলো। অনেকের ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিলো যার তিনি আমার বাবা। আমার বাবা শিল্পী ছিলেন। আমার দাদাও শিল্পী ছিলেন। আমার খালা শিল্পী। আমার মামা শিল্পী। আমার চাচাও শিল্পী। আমি আসলে সঙ্গীত পরিবারে বড় হয়েছি।

কিভাবে গান শিখলেন?
সত্যি কথা হলো, ছোটবেলা থেকেই আমাকে গান শিখতে একরকম বাধ্য করা হয়েছে। স্কুলে যেতাম। ফিরে এসে দিনে দিনে স্কুলের পড়া শেষ করতে হতো। সন্ধ্যায় শুরু হতো গানের অনুশীলন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গান শেখা, গান করার কাজ চলতো। আমার উস্তাদজী, তাকে আমি কাকা ডাকতাম। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। আমাকে সন্তানের মতো আদর করতেন। শাসনও করতেন খুব। তিনি একেকটি ক্লাস নিতেন তিন থেকে চার ঘণ্টার।

গান নিয়ে কী স্বপ্ন ছিলো আপনার? সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কি?
আসলে যখন আমি গান শুরু করি তখন অতো স্বপ্নটপ্ন বোঝার বয়সই হয়নি। আব্বাও আমাকে কোনো স্বপ্ন দেখাননি। তিনি ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু গান ছিলো তার রক্তের সাথে মেশানো। তিনিও নজরুল সঙ্গীতের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। তো তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন- মা গান করো। গান করলে তোমার মন ভালো থাকবে। আর মন ভালো থাকলে শরীর ভালো থাকবে। আর যদি মন-শরীর দুটোই ভালো থাকে তো তোমার সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে। আমি অনুমতি ছাড়া কোনো গান করিনি। আবার গান করলেও কোন গানটি গাইবো সেটাও আব্বাই ঠিক করে দিতেন। কলেজে উঠেও তাই করতাম। সে অভ্যাসটিই আমার সারাজীবন থেকে গেলো। এখনও গান গাইতে গেলে কোন গানটি গাইবো সহজে ঠিক করতে পারি না। মনে হয় আহা বাবা যদি বলে দিতেন!

আনুষ্ঠানিকভাবে গান করা শুরু হলো কিভাবে?
তখন আমার বয়স ৭-৮ বছর হবে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। এসময় বগুড়া জেলা আর্ট কাউন্সিল একটি গানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলো। আমি এতে অংশগ্রহণ করলাম। আমার জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতা এটি। মজার বিষয় হলো আমি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম! আরও মজার বিষয় হলো এই প্রতিযোগিতাটিতে ছোট-বড় ভাগ ছিলো না। সবাই একসাথে।

যে গানটি গেয়ে পুরস্কার পেলেন, সেই গানটি মনে আছে কি?
মনে আছে। এমন একটি ঘটনা মনে থাকবে না! সেই গানটিও নজরুলেরই লেখা গান। এবং গানটি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে লেখা। গানটি হলো- মোহাম্মদ মোর নয়ন মণি / মোহাম্মদ নাম জপো মালা। এ গান গেয়েই প্রথম হয়েছিলাম! আহা খুব মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। সেই দিনটা ছিলো আমার একটি স্মরণীয় দিন।
আপনি সেই থেকে ইসলামী গানও করেন? ইসলামী গানের প্রতি আগ্রহ কিভাবে জাগলো?
আসলে আমার ছোটবেলা থেকেই ইসলামী গানের প্রতি আগ্রহ। ইসলামী গানে সুন্দর জীবনের কথা থাকে। আল্লাহ-রাসূলের কথা খুব সুন্দর করে বর্ণনা থাকে। মনের ভেতর অন্যরকম একটা ভালোলাগা সৃষ্টি হয়। যে অনুভূতিটার মাধ্যমে মানুষ সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে পারে।

ইসলামী গানের প্রচার ও প্রসারের পথ কী?
শুধু রমজান মাসেই ইসলামী গান বাজবে বা শিল্পীরা করবে এমন নয়। এর চর্চা সারা বছর থাকা উচিত। এর জন্য শিল্পীদের উদ্যোগী হতে হবে। আবার যাদের অর্থসম্পদ আছে তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে এর পৃষ্ঠপোষকতায়।

যারা ইসলামী গানের শিল্পী তাদের বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
তাদেরকে গান সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। গান এমন কোনো বিষয় নয় যে, ইচ্ছে করলো আর গেয়ে দিলাম। না গানের অ আ ক খ জানতে হবে। ব্যাকরণগত বিষয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে। নইলে এ গানের কোনো প্রভাব সমাজের সাধারণ লোকদের ওপর যেমন পড়বে না, তেমনই শিক্ষিত লোকদেরকে একেবারেই টানবে না। গানের জন্য সময় দিতে হবে। ধ্যান-মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে গান করার চেষ্টা করতে হবে। আমার ছোটবেলায় এমন কোনো সন্ধ্যা ছিলো না যে সন্ধ্যায় আমি গান প্র্যাক্টিস করিনি। আসলে পরিশ্রম করতে হবে। শুধু খ্যাতির পেছনে দৌড়ালে হবে না।
শিশু-কিশোর যারা গান গাইতে এবং শিখতে চায় তাদের জন্য কিছু বলুন।
সত্যি কথা হলো, শিশু-কিশোরদের আগে তাদের অভিভাবকদেরই উপযুক্ত হতে হবে। অভিভাবক যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে তো শিশু-কিশোরেরা নিশ্চয় ভালো শিখবে, ভালো গাইবে। তবে যারা গাইবে তাদেরকে অনুশীলন করতে হবে। মন দিয়ে কাজ করতে হবে। এখনকার বাচ্চারা তো অস্থির! কখন পড়বে, কখন খেলবে, কখন গাইবে- তবুও তাদের শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। ঘর থেকেই বাচ্চারা শেখে। ও হ্যাঁ, সবকিছুর ওপর কিন্তু একটি শিশু বা কিশোরকে ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হবে!
কিশোর পাতাকে সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ!
কিশোর পাতাকেও অনেক ধন্যবাদ!

Share.

মন্তব্য করুন