একটি ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত বা জমিদার পরিবারে জন্ম হয়েছিল আমার। ফেনীর একটি নিভৃত গ্রামে। আমার বাবা ছিলেন একজন নামকরা উকিল। বেশ সুনাম সুখ্যাতি ছিলো আমার বাবার। তিনি ফেনী গার্লস কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। খুব অতিথিপরায়ণ ছিলেন তিনি। ধর্মকর্মেও ছিলেন সামনের দিকের। ফেনী জহিরিয়া মসজিদ, পাঁচগাছিয়া মসজিদ ও ফেনী আলিয়া মাদরাসার সেক্রেটারি ছিলেন। ফলে নানান কিসিমের মানুষজনের সাথে তার ছিলো খাতির। ছিলো পরিচয়। আর ছিলো বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দিকে পরামর্শ দেয়ার বিষয়। এ কারণে ঈদের দিন, ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার পর থেকে মানুষজনের আসা-যাওয়া শুরু হতো আমাদের বাসায়। সকালে যারা আসতেন তারা শিরনি, সেমাই, পায়েস এবং ঈদের মিষ্টান্ন মুখে দিতেন। যারা দুপুরে আসতেন, তারা দুপুরের খাবার খেয়ে যেতেন। বিকেলেও আসতেন অনেকে। বিকেলে আবার ঈদের সেমাই-শিরনি-ফিরনি পিঠা খেতেন। এরপর সন্ধ্যা এবং অনেক রাত পর্যন্ত মানুষের আসা-যাওয়া লেগে থাকতো। বাবা এদের সবার সাথে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কথা বলতেন। মেহমানদারি করতেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় থাকতেন কিভাবে অবাক হতাম আমরা। আমার আম্মাও একটানা কাজ করে যেতেন। এতো মানুষের আনাগোনা আর মেহমানদারি করতে গিয়ে কখনও মুখ কালো করতেন না।
এসব দেখতাম আমার ছোটবেলার ঈদের দিনে। অবাকও হতাম। আবার বেশ আনন্দও লাগতো। মুরব্বিরা বাড়িতে এলে আমরা যারা ছোট তাদেরকে অনেকেই আদর করতেন। খোঁজখবর নিতেন।
যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার বন্ধু ছিলো অনেক। আবার সহপাঠী ও সমবয়সীরাও ছিলো। ঈদের দিন এদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম। ঈদের নামাজ শেষ করে শুরু হতো একেকজনের বাড়ি যাওয়া। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি যেতাম। আর গেলেই তো কিছু না কিছু খাওয়ার আয়োজন থাকতোই। আহা সেদিনগুলো মনে পড়ে খুব।
আমাদের দুটো বাড়ি ছিলো। একটি গ্রামে। আরেকটি ফেনী শহরে। স্কুলে পড়ার সময় থেকে আমরা ফেনী শহরেই ঈদ করতাম। ঈদের নামাজ পড়তাম ফেনী মিজান ময়দানে। এটি ঈদগাহ ময়দান হিসেবেও পরিচিত। নামাজ পড়ে মুরব্বিদের সালাম করতাম। আমাদের ছোটবেলায় সালাম করে কোনো সালামি পেতাম না আমরা। তখন এর চল ছিলো না। আরও একটি কাজ আমরা করতাম। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকও এই ঈদগাহ ময়দানে নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষ হলে আমরা লাইন ধরে স্যারকে সালাম করতাম। খুব খুশি হতেন স্যার!
নামাজ শেষ করে আমরা বাসায় আসতাম। ভালো-মন্দ যা রান্না হতো আমরা খুব আগ্রহ সহকারে খেতাম। আমার প্রিয় খাবার ছিলো বিরিয়ানি। আম্মা আমার জন্য বিরিয়ানি রান্না করে রাখতেন।
কোনো কোনো ঈদে ফেনী ক্লাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকতো। আমরা অংশ নিতাম আগ্রহের সাথে। সবাই একসাথে কোরাস গাইতাম নজরুলের বিখ্যাত ঈদের গানটি-
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ॥
আবার আমাকে কবিতা আবৃত্তি করতে হতো। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ‘শাহজাহান’ কবিতা আবৃত্তি করার কথা বলতেন ফেনী মহকুমা প্রশাসক। বলতেন- তুমি শাহজাহান কবিতাটিই আবৃত্তি করো। আমিও দরদ মাখিয়ে আবৃত্তি করতাম।
ঈদের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনতাম। কিন্তু সব ঈদে কেনা হতো না। যে ঈদে নতুন জামাকাপড় কেনা হতো না সে ঈদে আগের বছরের ঈদের পোশাক দিয়ে ঈদ করতাম। আমার অবশ্য নতুন জামাকাপড় নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না।
ঈদের দিন আব্বা আমাকে ফেতরার টাকা হাতে দিয়ে বলতেন- এগুলো গরিব এবং ফকিরদের দিয়ে দিও। আমি ঈদগাহে যেতে যেতে ফেনী মিজান রোডের দু’পাশে ফকির-মিসকিন এবং অসহায়দের দিয়ে দিতাম।
আমার বাবা ফেনী আলিয়া মাদরাসা এবং আরও দু’টি মসজিদের- যা আগে উল্লেখ করলাম, এগুলোর সেক্রেটারি ছিলেন আমৃত্যু। অর্থাৎ একেবারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এসব স্মৃতি এখন মাঝে মাঝে মনে হয়। ছোটবেলার ঈদের আনন্দ সত্যি ছিলো অন্যরকম!

Share.

মন্তব্য করুন