আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ নামটি সবার পরিচিত একটি নাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বই পড়িয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি একজন আশাবাদী মানুষ। কোনো কিছুতেই হতাশা নয়- এমন করেই তিনি ভাবেন এবং বলেন। মন ভালো রাখতে এবং মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে বারবার বলেন তিনি। একসময় শিক্ষকতা করতেন। হাজারো গুণীজনের শিক্ষক তিনি। কিন্তু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বড় স্বপ্ন তাকে শিক্ষকতা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। শিশু-কিশোরদের বড় এবং ভালো মানুষ হওয়ার আয়োজন নিয়ে এগিয়ে যান।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোকতাদির হোসেন

শৈশবকালকে কেমন করে দেখেন?
শৈশব হলো মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়! বৃদ্ধ হলেও শৈশবকালটি মানুষকে সঙ্গে রাখতে হয়। কেননা মানুষ ততদিন জীবন্ত থাকে যতদিন তার শৈশব তার সঙ্গে থাকে। জীবন আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- চুপেচুপে, খুব গোপনে! কখন যে শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে এবং প্রৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্যে নিয়ে যাচ্ছে আমরা টেরই পাই না। দুঃখের মধ্য দিয়ে জীবন শেষ হয়। আনন্দের ভেতর দিয়েও শেষ হয়ে যায়। তবে দুঃখে শেষ হলে কিছুটা বোঝা যায়, কিন্তু আনন্দে শেষ হলে বোঝাও যায় না। এভাবে তিল তিল করে, পায়ে পায়ে, অগোচরে আমাদের জীবন শেষ হয়ে যায়। মরার আগেও শেষ হয়- যদি না জীবনের সঙ্গে শৈশবের সৌন্দর্য না থাকে।
শৈশব এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন আপনার কাছে?
শৈশবে মানুষ নিষ্পাপ থাকে। খুব সরল এবং সুন্দর থাকে। কারো প্রতি হিংসা রাখে না। বিদ্বেষ পোষণ করে না। সবাইকে বিশ্বাস করে সরলতার মধ্য দিয়ে। বিশ্বাস করে বোকার মতো। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- শৈশবে খুব অবাক হয় মানুষ, বিস্মিত হয়! বিস্ময় হলো মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবাক বা বিস্মিত না হলে মানুষের কৌতূহল থাকে না। আর কৌতূহল না থাকলে কোনো বিষয়ের প্রতি আগ্রহ থাকে না মানুষের!
কেমন ছিলো আপনার ছোটবেলা?
সত্যি বলতে কি, আমি ছোটবেলায় কিছুটা বোকাসোকা কিসিমের ছিলাম। খুব সহজে কিছু বুঝতে পারতাম না। সরল ছিলাম খুব। যেমন একটি ঘটনার কথা বলি- আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে অঙ্ক শেখানোর চেষ্টা করছেন আমার বাবা। তো আমরা কিছুতেই শিখছিলাম না। তো তিনি একটি পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। বেশ কিছু মিষ্টি ছিলো সেখানে। তিনি একটি একটি করে তিনটি মিষ্টি খাওয়ালেন আমাকে। খাইয়ে বললেন- বলো তো কয়টি মিষ্টি খেয়েছো?
আমার ছোট ভাই হঠাৎ বললো- ভাইয়া বলিস না বলিস না! মিষ্টির ভেতর দিয়ে তোকে অঙ্ক শিখিয়ে ফেলবে! হা হা হা। এমনই বোকাসোকা ছিলাম আমি।
কী হতে চেয়েছিলেন জীবনে?
কী যে হতে চেয়েছি সেটিই কথা। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। হয়েছিও তাই। কিন্তু ছেড়েও দিয়েছি একসময়। তার আগের কথা বলি। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম ইন্টারমেডিয়েটে। তো এসময় আমি একজন শিক্ষককে পেয়েছিলাম। তিনি আমাদের অর্থনীতি পড়াতেন। এতই আনন্দের সাথে পড়াতেন যে অর্থনীতির ভেতর দিয়ে গোটা বিশ্ব আমাদের সামনে ছোট হয়ে উঠতো। কী যে প্রচণ্ডরকম ভালো লাগতো তা আর ভাষায় প্রকাশ করার নয়! তখন আমার মনে হলো যদি একটিমাত্র বিষয় আমি পড়ি তো অর্থনীতিই হবে আমার পাঠের বিষয়। কিন্তু কিছু দিন পরে ওই টিচার চলে গেলেন কলকাতা বা অন্য কোথাও। তার পরিবর্তে এলেন আরেকজন শিক্ষক। আসলেন তো কিন্তু আগের শিক্ষক যতটা বিষয় সম্পর্কে উন্নত ছিলেন পরের জন ততটাই অনুন্নত। এই শিক্ষকের ক্লাস শুনে শুনে এবার মনে হতে লাগলো- যদি আমি একটি বিষয় পাঠ থেকে বাদ দেই তো সেটিই হবে অর্থনীতি!
আপনি প্রায়ই বলেন- স্বপ্ন দেখলে বড় করে দেখতে হবে।
হ্যাঁ বলি, এখনও সে কথাই বলবো। স্বপ্ন বড় করে দেখতে হয়। কেননা মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। সুতরাং স্বপ্ন বড় হলে মানুষও বড় হবে। স্বপ্ন না থাকলে হবে কি করে! এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তো চাই!
শিশুদের বড় মানুষ এবং আলোকিত মানুষ করে গড়ে তোলার কথাও বলেন আপনি।
তাও বলি। শিশু-কিশোরদের শেখাতে হবে। শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু শেখাতে হবে আনন্দের ভেতর দিয়ে। হাসি-খুশির মাধ্যমে। বিশাল বিশাল কথা বলে নয়। অনেক ভারি ভারি কথা বলে নয়। জ্ঞানতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভূগোলতত্ত্ব দিয়ে শিশুদের শেখানো যায় না। রসগোল্লায় দুটো জিনিস আছে। একটি গোল্লা আরেকটি রস। গোল্লা বড় হলে বুঝবে, কিন্তু শিশুদের দিতে হয় রস। মূলত সাহিত্যের বইয়ের ভেতর দিয়ে শিশুদের শেখানো সহজ। সাহিত্যে জ্ঞান থাকে, হাসি আনন্দ থাকে। দুঃখ-বেদনার কথা থাকে। এককথায় সাহিত্যে জীবন থাকে। জীবনের সৌন্দর্য থাকে।
আজকের শিশু-কিশোর আর আপনাদের সময়ের শিশু-কিশোরদের মধ্যে তফাৎ কি দেখেন?
আমি বলবো আজকের শিশুরা পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাচারিত শিশু। আজকের শিশুদের ওপর অনেক প্রেসার। অনেক চাপ। বাবা-মার অনেক চাহিদা তাদের ওপর। ফলে আজকের শিশুরা নানা ভয় এবং আতঙ্কের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকে! আমাদের সময় ছিলো অবারিত সব। সে সময় ছেলে-মেয়ে প্রতিটি পরিবারে সংখ্যায় ছিলো অনেক। আমরাই তো ১১ ভাই-বোন ছিলাম। আমার দাদার পরিবারে ছিলো ১৮ ভাই ও ১৪ বোন। মা-বাবার আদর-ভালোবাসা সবার ভেতর ভাগ হয়ে যেতো। ফলে কঠিন এবং কঠোর শাসন যেমন ছিলো না, আবার অতিরিক্ত স্নেহ-মমতাও ছিলো না। যে যার মতো স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতো। এখন একটি বা দুটি সন্তান। যার কারণে আদর সোহাগ যেমন বেশি, চাহিদাও বেশি।
কিভাবে বেড়ে উঠবে আমাদের শিশু কিশোরেরা?
আমাদের সবাইকে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করতে হবে। কাজ করে যেতে হবে নিয়মিত। তাহলে দশ বছর, বিশ বছর, পঞ্চাশ বা একশ বছর পরে হলেও সমাজে আলোকিত মানুষের সংখ্যা থাকবে বেশি। আজকের শিশু- কিশোর যারা তাদেরও এই আলোকিত মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে হবে। তবে বড় হতে হলে আগে মনের দিক দিয়ে বড় হতে হবে। মনে বড় না হলে বড় মানুষ হওয়া যায় না। বড় কাজও করা যায় না। যদি কেউ এভারেস্ট জয় করার স্বপ্ন দেখে তবে আগে মনে মনে জয় করতে হবে এভারেস্টের চূড়া। তারপর বাস্তবে জয় করা সম্ভব হবে। কেউ যদি সাহারা মরুভূমি হেঁটে পার হতে চায়- তো আগে মনে মনে হেঁটে পার হয়ে যেতে হবে। এরপর বাস্তবের দিকে যেতে হবে। তাই বলি, যদি বড় হতে চাও আগে মনের দিকে বড় হও এবং যদি মানুষ হও তবে আলোকিত মানুষ হও।
আপনাকে ধন্যবাদ।
তোমরাও ভালো থেকো।

Share.

মন্তব্য করুন