ঈদ মানেই আনন্দ। খুশির ঈদ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঈদের গান গেয়েছেন, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।’ আমরা ছোটবেলায় কখন ঈদ আসবে সেই সাথে পাবো নতুন জামা-জুতা সে অপেক্ষাতে থাকতাম। ঈদের ছুটিতে নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা। ঈদ মানে খুশি এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার আসমানি তাগিদ সম্বন্ধে কিছু জানতাম না, যা জানতে সময় লেগেছে অনেক। এখন বুঝি অন্যের আনন্দের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই আনন্দ বেশি। অন্যের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারার মধ্যে, অপরের বেদনাকে নিজের বেদনা মনে করে তা দূর করতে পারলেই আসল আনন্দ পাওয়া যাবে।
আমাদের ছোটবেলায় রোজা ও ঈদ আসত শীতকালে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাটাও হতো সে সময়ে। নতুন ক্লাস, নতুন বই, ক্লাসে নতুন সাথী, সহপাঠী সবই ছিল ঈদের বাড়তি পাওনা। ঈদের সময়টা তাই থাকত হরেক রকম আমেজ-আনন্দে ভরা। আজ ঈদ আসলে সেই মজা বা আনন্দ সচরাচর পাই না। অন্যের দুঃখ ও বেদনাবোধ থেকে যত দূরে সরে যাব, ব্যথাতুরের প্রতি, মহামারী রোগ-শোকে সকলকে সহানুভূতি জানানো থেকে যতদূরে থাকব, তত আনন্দ হারাবো, হারাচ্ছিও।
ঈদ আসার আগে আসত রোজা রাখার মাস। রোজা রাখা মানে সারাদিন কিছু না খেয়ে থাকা, বেলা ওঠার আগে সাহরি খেলেই হতো বাচ্চাদের, আমাদের বয়সীদের। দশটা-এগারোটার দিকে বাচ্চারা রোজা ভাঙতে পারত, দিনে দুই তিনটা রোজা রাখলেও কিছু বলা হতো না। কুলগাছে উঠে লুকিয়ে ২-১টা কুল খাওয়া যেত, এমনকি পুকুরে ডুব দিয়ে, কেউ দেখত না বলে দু’-এক ঢোক পানি খেলে যেন কিছু হতো না! কেউ আবার বারবার থুতু ফেলে প্রমাণ করতে চাইত সে রোজা। রাতে তারাবিতে সিজদা দিতে যেয়ে রীতিমত ঘুমিয়ে পড়া, দু’রাকাতের শেষ রাকাতে রুকুতে যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে উঠে হাত বাঁধার কথা মনে হলে আজো হাসি পায়। তিন-চার জন বাচ্চারা একসাথে নামাজ পড়তে যেয়ে কারো দুষ্টামিতে হাসির রোল পড়ে যেত। পরে আমাদের সহজে জামাতে নিতে চাইতেন না মুরব্বিরা।
রোজা যা বা যেটুকু হতো ইফতারি খাওয়ার সময় পাক্কা রোজাদারের ভান করায় কমতি ছিল না কখনো। আমাদের সময়ে গ্রামে ইফতারির আয়োজন উপাদান ছিল যৎসামান্যই। সামান্য চাল ভিজিয়ে রাখা হতো, তা মুখে দিয়ে খোলা হতো রোজা, ছোলা মিলত কালেভদ্রে, তবে ডাবের পানি, বেলের শরবত, বিচিকলা (ডয়রা কলা) এসব ছিল। পায়েস রাঁধতেন মা মাঝে মাঝে। হায়, এখনকার বাহারি ইফতার আইটেমের সাথে সেসবের কত ছিল অমিল। বাড়িতে, মহল্লায় সবাই রোজা রাখত না। ইফতারিতে সকলে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়া খুব একটা চোখে পড়ত না। তবে নানাবাড়িতে খুলনা থেকে হাফেজ সাহেবরা সারামাস খতম তারাবি পড়াতে আসতেন, থাকতেন। সে সুবাদে তাদের সম্মানে ও সাথে দলবেঁধে ইফতারির আঞ্জাম-আয়োজনের কথা মনে পড়ে। শবে কদর কিংবা খতম তারাবি উপলক্ষে দলবেঁধে রোজাদারদের খাওয়ানোর উৎসব হতো, সেসব মনে পড়ে।
রোজা শুরুর চাঁদ দেখার চাইতে ঈদের চাঁদ দেখার মধ্যে আগ্রহ আনন্দই ছিল আলাদা। ঈদ মানে বড় ছুটি, নতুন বই, নতুন জামা-জুতাসহ বেড়ানোর হাতছানিতে এক ধরনের আনন্দ শিহরণ জাগত। পুলকিত হওয়ার মতো সেসব মুহূর্ত এখন আর পাই না। ঈদের দুই-তিনদিন আগে বাজার থেকে নতুন জামা নতুন জুতা কেনা হতো। নতুন জামা জুতোর সেই গন্ধ এখন আর পাই না। ঈদের আগে থেকে নতুন জামা পরলে পুরনো হয়ে যাবে এই ভয়ে খুব যতেœ রাখা হতো, এমনকি রাতে ঘুমানোর সময় সেসব নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ শিয়রে রাখতাম। রাতে ঘুম ভাঙলে চেক করে দেখতাম সেগুলো ঠিকমত আছে কিনা। আগে থেকে কাউকে দেখানোরও নিয়ম ছিল না, পাছে যদি কেউ সেটা নিয়ে নেয়। ভাইবোনের মধ্যে এসব ভাগাভাগি ও চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ঠা-া যুদ্ধ তো ছিলই। শীতকাল বলে হাতে বোনা সোয়েটারও ঈদের পোশাকের তালিকায় যোগ হতো। ঈদের পর বড়জোর এক সপ্তাহ সেই সব রঙিন পোশাক পরে লোক দেখানো বন্ধু-বান্ধবদের দৃষ্টি আকর্ষণ মহড়া চলত। কিছুদিন যেতে না যেতে সে পোশাক পুরনো এবং অপাঙক্তেয় হয়ে যেত যেন। আবার নতুন ঈদ আসার অপেক্ষায় থাকা।
দু’মাসের মাথায় নতুন আর একটা ঈদ আসত, তবে সেটা নতুন পোশাকের না, গরু কোরবানির। সে আর এক আনন্দ। দলবেঁধে দূরের হাট থেকে গরু কিনে আনা হতো। তবে তখনকার গরুরা এত সাজগোজের, এত মোটাতাজা ছিল না। হালকা-পাতলা, কিছুটা বয়স্ক গরু, অর্থাৎ চাষবাসে যাদের দরকার ফুরিয়ে আসত, তাদেরই কোরবানির জন্য ঠিক করা হতো। কেউ গরুর দাম তেমন জানতে চাইত না। গরুরাও যেন নিজেদের প্রচার চাইত না। টিভি ক্যামেরা তো দূরের কথা, সাধারণ ক্যামেরায়ও কেউ তাদের ছবি তুলত না। এখনকার মতো মোবাইলে ছবি তুলে ওয়াটসআপ-ফেসবুকে পোস্ট করার কথা তখন ছিল স্বপ্নেরও অতীত। সে তুলনায় এখনকার গরু-ছাগল বেশ ভাগ্যবান। তাদের কেনা-বেচা টিভিতে দেখানো হয়।
প্রায়ই গ্রামে ঈদগা ছিল না, দুই গ্রাম দূরে বড় এক উঁচু মাঠে হতো ঈদের জামাত। সব লোক একত্র হতে লাগত বেশ সময়। দশটার দিকে নামাজ পড়ে আরেক পথ দিয়ে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যেত। যে পথ দিয়ে ঈদের জামাতে যাওয়া হতো ফেরার সময় নাকি অন্য পথে ফেরার বিধান। কেউ বলতেন খেয়ে ঈদ না খেয়ে বকরি ঈদ- অর্থাৎ রোজার ঈদে সকালে কিছু খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাও আর বকরা ঈদের নামাজ পড়ে এসে কিছু খাবে। এটি এখন এই শহরের জীবনযাপনে প্রযোজ্য হতে পারে। এখানে কোরবানির ঈদের নামাজ যত তাড়াতাড়ি পড়া যাবে তত ভালো এ জন্য যে সকালেই কোরবানি করা যায় দুপুরের আগেই মাংস বিলি বিতরণ ও পাক করে খাওয়া সম্ভব, গ্রামে তখন এটা ভাবাই যেত না। ছিল অকল্পনীয়। ঈদেও নামাজ পড়ে কোলাকুলি করা, মুরব্বিদের সালাম করার নিয়ম ছিল, তবে সালামি দেয়া-নেয়ার নিয়ম তেমন ছিল না।
আমাদের সময়ে গ্রামে গরু কোরবানি দেয়া হতো বিকেলে। সেই গরু বানাতে বানাতে রাত ৯টা ১০টা বেজে যেত। রাতে রান্না হলেও আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। পরের দিন সকালে ঈদের মাংস খেতাম আমরা। এখন অবশ্য গ্রামেও ঈদের সকালেই কোরবানি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, এখন শহরের মত গ্রামের মসজিদেও ঈদের জামাত হয়, ঈদগাহ হয়েছে কাছাকাছি।
গরিবদের মধ্যে কোরবানির মাংস গ্রামের সবার কাছে সমান হারে বিলি বণ্টন ব্যবস্থা আগেও যেমন ছিল এখনো আছে। এই ব্যবস্থাটা অত্যন্ত চমৎকার। আমরা রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত চাঁদের আলোতে (১১ জিলহজ) মসজিদে ও মাঠে মাংস বিলি-বণ্টনের কাজ উপভোগ করতাম।
সময় পাল্টেছে। ছোটবেলার ঈদ-উৎসবের মধ্যে আনন্দ ছিল, তবে এখনকার মত এত জমজমাট ছিল না। তখনকার ঈদ আনন্দ নিজেদের পরিবারে ও বড়জোর গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন গ্রাম ও শহরের মধ্যে যোগাযোগ যাতায়াত এত বেড়েছে যে ঈদের ছুটিতে মানুষ এখন এক জায়গায় থাকে না। পরস্পরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে নিয়ম-কানুনের উপায় উপকরণের কমতি নেই।

Share.

মন্তব্য করুন