উল্কাবৃষ্টি

মহাশূন্য কিংবা মহাকাশ- একে আমরা যে নামেই ডাকি না কেন, মহাকাশ নিয়ে সবারই রয়েছে বিস্ময়। এই অসীম মহাকাশে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে বিচিত্র সব ঘটনা। ফলে মহাকাশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতুহল ও গবেষণারও শেষ নেই। তাই অপার বিস্ময়ের আধার হচ্ছে আমাদের এই মহাকাশ। পৃথিবীর উপগ্রহ, চাঁদ, অসংখ্য তারকারাজি, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির পাশাপাশি আরো একটি বস্তু মাঝে মাঝে খালি চোখে আমাদের কাছে ধরা দেয়। আকাশের দিকে তাকালে হঠাৎ করে কোনো এক আলোকবিন্দুকে টুপ করে নিচের দিকে খসে পড়তে দেখা যায়। এটি হল উল্কা (Meteor)। যে সব বস্তু মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদের বলে মহাজাগতিক বস্তু। এ রকম কোনো মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীর যথেষ্ট কাছে এসে পড়লে, পৃথিবীর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে বস্তুটি ভূপৃষ্ঠের দিকে তীব্র বেগে এগোতে থাকে। তখন এর সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের কণাগুলোর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ-ঘর্ষণের ফলে বস্তুটি জ্বলে ওঠে। তখন যে ক্ষণস্থায়ী সরু আলোর রেখা দেখা যায়, সেটা-ই উল্কা। বেশিরভাগ সময় উল্কার আকার এত ছোট হয় যে, এটি ভূ-পৃষ্ঠে আসতে আসতেই জ্বলে ছাই হয়ে যায়। তবে যদি বস্তুটি মোটামুটি বড় আকারের হয়, তখন সেটি পুরোপুরি পুড়ে ছাই হয়ে যায় না। বস্তুটির অবশিষ্টাংশ ভূ-পৃষ্ঠে ভীষণ জোরে আছড়ে পড়ে। এই অবশিষ্টাংশকে বলে উল্কাপিণ্ড। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই উল্কাপিণ্ডটিই একসময় উল্কাবৃষ্টির আকার ধারণ করে। অধিকাংশ উল্কাই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের অব্যবহিত পরেই খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে যায়। গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে ১০ গ্রাম-এর চেয়ে বড় ১৮০০০-৮৪০০০ উল্কা পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছায়, যার মধ্যে শুধুমাত্র বছরে পৌঁছায় মাত্র ৫ থেকে ৬ টুকরো। উল্লেখ্য, পৃথিবীপৃষ্ঠের কোন জায়গায় উল্কা পড়ল আর আবিষ্কৃত হলো- সেই অনুযায়ী হয় নামকরণ। আর যদি একাধিক উল্কা একই স্থানে পাওয়া যায়, তাহলে তাদের নামকরণ করা হয় ক্রমানুসারে। উল্কার আকার হতে পারে নানান রকম। এর ব্যাস কয়েক মিলিমিটার থেকে বেশ কয়েক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। একটি বড় আকারের উল্কা পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর যখন পড়ে, তখন একটি বেশ বড়সড় জ্বালামুখ পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর তৈরি হয়। আজ যদি আমরা পিছন ফিরে তাকাই, তখন দেখতে পাই যে, অতীতে উল্কাপাতের সময় পৃথিবীপৃষ্ঠের সঙ্গে সঙ্ঘাতে অনেক জ্বালামুখ সৃষ্টি হয়েছে, যার সঙ্গে পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনাকেও কোন কোন ভাবে দায়ী বলে ভাবা হয়। প্রতি বছরই কিছু নির্দিষ্ট দিনে আকাশে উল্কার পরিমাণ বেশ বেড়ে যায়। ঘণ্টায় ৩০-৪০টা উল্কাও দেখা যায়। একেই বলে উল্কাবৃষ্টি। এই অসংখ্য উল্কা আকাশের একেকটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই আসে। এই জায়গাগুলিকে বলে বিকিরণ বিন্দু। এ থেকে মনে হতেই পারে, এগুলো নিশ্চয়ই একই মাতৃবস্তু থেকে আসছে, আসলেও তাই। এর জন্য প্রায়ই দায়ি থাকে ধূমকেতু। ধূমকেতুর শেষে যে লেজ থাকে, সেটা মূলত বরফকণাপূর্ণ গ্যাসীয় পদার্থে তৈরি। ধূমকেতু যখন সূর্যের খুব কাছে চলে যায়, এই লেজের কিছু অংশ বলা যেতে পারে খসে যায়। এই অবশিষ্টাংশ এদের কক্ষপথের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকে। চলার পথে পৃথিবীর কাছে চলে আসলে, কাছাকাছি অঞ্চলের টুকরোগুলো উল্কা হয়ে পৃথিবীর দিকে ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসে।

এভাবেই উল্কাবৃষ্টির সৃষ্টি হয়। যে নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে উল্কাবৃষ্টি হয়, সেগুলো থাকে একেকটি তারামণ্ডলের মধ্যে। তাই অবস্থান শনাক্তকরণ সহজ করতে একেকটি উল্কাবৃষ্টি যে তারামণ্ডলের পটভূমিতে হয়, সেই তারামণ্ডলের নামানুসারে উল্কাবৃষ্টির নামকরণ করা হয়। অনেক সময় তারামণ্ডলের নামের শেষের দু-একটা বর্ণও বাদ দেয়া হয়। যেমন, আগস্টের ১২ তারিখে যে উল্কাবৃষ্টি দেখা যায়, তার নাম ‘পারসেইডস’ (perseids)। এই উল্কাবৃষ্টির নামকরণ করা হয়েছে পারসিয়াস তারামণ্ডল থেকে। উল্কাবৃষ্টিটি হয়েছিল ‘সুইফট টাটল’ নামক ধূমকেতুর অবশিষ্টাংশ থেকে। আবার অক্টোবর মাসের ২০তারিখে দেখা যায় ‘ওরায়নিডস’ (orionids) নামক উল্কাবৃষ্টি। এটির নামকরণ করা হয়েছিল কালপুরুষ তারামণ্ডল (orion) থেকে। উল্কাবৃষ্টিটি হয়েছিল হ্যালির ধূমকেতুর অবশিষ্টাংশ থেকে। এই দিনগুলিতে, বা তার একদিন আগে-পরের দিনগুলোতে রাতের আকাশে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৩০-৪০টা উল্কা চোখে পড়ে। যদি কমও দেখা যায়, তবু অন্তত ৫-১০টা উল্কা চোখে পড়বেই। ভাগ্য ভালো হলে একসঙ্গে কয়েকটাও দেখা যেতে পারে। তবে ঢাকার মতো আলো-দূষণময় শহরগুলিতে অবশ্য এ নিয়ম খাটে না। এই ধরনের শহরে এত উল্কা দেখা যায় না। উল্কাপাতের মৌসুমে গড়ে উত্তর গোলার্ধের লোকজন প্রতি ঘন্টায় ১০টি উল্কাপাত আর দক্ষিন গোলার্ধের লোকজন প্রতি ঘন্টায় ৩০টি উল্কাপাত দেখতে পারে। বিষুবরেখার নিকট এলাকার লোকজন গোধুলীর সময় দেখতে পারে। বিষুবরেখার নিকটবর্তী এলাকার লোকজন সূর্যোদয়ের ৩ঘন্টা আগেই উল্কাবৃষ্টি দেখতে পারে। উল্কাবৃষ্টি দেখার সবচেয়ে ভাল সময় হলো সন্ধ্যা ও ভোররাত। পৃথিবীর মতো অন্যান্য স্বচ্ছ বায়ুমন্ডলেও উল্কা বৃষ্টি হতে পারে। যেহেতু চাঁদ পৃথিবীর প্রতিবেশী, তাই চাঁদ ও উল্কা বৃষ্টির সম্মুখীন হতে পারে। বর্তমানে নাসা চাঁদের উল্কা বৃষ্টি নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে, যার রক্ষনাবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টার। অনেক গ্রহতেই বিভিন্নরকম সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট বিভিন্নরকম গর্ত দেখা যায় যা অনেক দিন ধরে অবস্থান করে। কিন্তু নতুন গর্ত অনেক সময় উল্কা বৃষ্টির ফলে হতে পারে। যদিও মঙ্গল গ্রহ এবং এর উপগ্রহে উল্কা বৃষ্টি পর্যবেক্ষন করা গিয়েছে। এই বিষয় অন্যান্য গ্রহে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি তবে তা হতে পারে। মঙ্গল গ্রহে বিশেষ করে, যদিও তা পৃথিবীতে উল্কা বৃষ্টির মতো নয় তা আলাদা দেখায়। কারণ পৃথিবীর কক্ষপথ এবং মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথ এক নয়। আর পৃথিবী ও মঙ্গলের মাঝে ধুমকেতুর কক্ষপথ এক নয়। পৃথিবীর ভুপৃষ্ঠ থেকে ১% এরও কম ঘনত্ব মঙ্গল গ্রহের ভুপৃষ্ঠ,এর উপরের অংশ যেখানে উল্কা বৃষ্টি এসে আঘাত করে, এই বিষয় খুবই সামঞ্জস্যপুর্ণ। কারণ বায়ুচাপের ফলে উভয় ঘটনাই একই রকম দেখায়। পৃথিবীর দেশে দেশে বিজ্ঞানীরা উল্কা বৃষ্টির রহস্যময়তা নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। ফলে উল্কাবৃষ্টির রহস্যময়তার নতুন নতুন তথ্য ভবিষ্যতে উন্মোচিত হবে।

টাইম ক্যাপসুল

সেই প্রাচীনকাল থেকেই সৌরজগত নিয়ে সাধারণ মানুষের কল্পনা ও আকাশছোঁয়া ভাবনার শেষ নেই। তাইতো যুগে যুগে দেশে দেশে সৌরজগত নিয়ে লেখা হয়েছে নানা বিজ্ঞান ভিত্তিক কল্প কাহিনি, তৈরি হয়েছে বিশ^বিখ্যাত চলচ্চিত্রও। সৌরজগতের গবেষণায় তাই বিশে^র উন্নত দেশগুলো তাদের মেধা শ্রম ও অর্থ দিয়ে এগিয়ে চলেছে সময়ের সাথে সাথে। উল্লেখ্য, সেই বহুবছর আগ থেকেই মহাকাশ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের নাসা একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে মহাকাশের নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি বিশে^র নানা দেশের বিজ্ঞান অনুসন্ধিচ্ছু মানুষেরা। আর তাই তো সম্প্রতি গ্রহাণুদের সন্ধানে শুরু হয়েছে নাসার নতুন মহাকাশ অভিযান। মহাশুন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক কোটি গ্রহাণু এদের কিছু পৃথিবীর খুব কাছে অবস্থান করছে। ট্রোজান গ্রহাণুরা সৌরপরিবারের সূচনা থেকে রয়েছে। বিজ্ঞানীদের কথায়, গ্রহাণুগুলো হল ‘টাইম ক্যাপসুল’। দু’টি স্রোতে এরা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। একটি স্রোত বৃহস্পতির আগে বেল্টের মতো রয়েছে। দ্বিতীয় স্রোতটি তার পিছনে। বলা হয়, সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির সঙ্গে একই পথে ঘুরছে ট্রোজান। লুসিই প্রথম মহাকাশযান, যে পা ফেলবে ট্রোজানদের সংসারে। গত ১৬ অক্টোবর পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের পথে রওনা দিয়েছে মহাকাশযান ‘লুসি’। গ্রহাণুদের পাশাপাশি সৌর পরিবারের প্রথম দিকের দিনগুলো কেমন ছিল, তার-ও খোঁজখবর নেবে লুসি। জানবে কোন গ্রহাণুটি কখন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে আর কখন আছড়ে পড়তে পারে পৃথিবীতে। মহাকাশযান লুসির অভিযান চলবে প্রায় ১২ বছর। সৌর পরিবারের বিভিন্ন প্রান্তে ‘তদন্ত’ চালাবে লুসি। সূর্যকে কেন্দ্র করে পরিক্রমণ করছে বেশ কিছু প্রাচীন গ্রহাণু। গ্রিক পুরাণ থেকে এদের নাম ট্রোজান। এই ট্রোজানদের খুঁটিনাটি সন্ধান করবে লুসি। নাসার বিজ্ঞানী টম স্টেটলার বলেন, ‘লুসির সঙ্গে ১২ বছরে আমরা বিশ্ব সংসারের এমন জায়গায় যাব, যা আগে কেউ কখনও দেখেনি। আমাদের সৌরপরিবারের অতীত, ইতিহাস হয়তো এবার জানা যাবে। মিলবে নতুনের সন্ধান।
সৌরজগৎ সৃষ্টির শুরু থেকেই অপরিবর্তিত এসব গ্রহাণু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সৌরজগৎ সৃষ্টির রহস্যের জট খুলতে চান গবেষকরা। লুসি এই দীর্ঘ পথে মোট আটটি বিশেষ গ্রহাণু পর্যবেক্ষণ করবে। বিজ্ঞানীরা জানান, লুসি নামটি পৃথিবীর একটি তাৎপর্যপূর্ণ মানব জীবাশ্মের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। মহাকাশযান লুসি আগামী দিনে সৌরজগতের নতুন নতুন চমকপ্রদ কি কি তথ্য পরিবেশন করে, সেটার জন্য বেশ কিছুটা সময় হয়তো অপেক্ষায় থাকতে হবে পৃথিবীবাসীকে।

Share.

মন্তব্য করুন