৮৪ দিন হয়ে গেল। জালে কোন মাছ আটকা পড়ছে না। অন্য জেলেরা সান্তিয়াগোকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা শুরু করলো।
গ্রামবাসীদের কাছে অপয়া ও অলক্ষুণের প্রতীক হয়ে উঠল সে। লোকেরা এখন মাছ ধরতে যাওয়ার আগে তার মুখচ্ছবি দেখতেও ভয় পায়। মাছ ধরতে যাওয়ার সময় তার মুখের দিকে তাকালে তাদের জালেও মাছ উঠবে না যেন।
পিছন থেকে লোকেরা তাকে ‘সালাও’ ‘সালাও’ বলে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অলক্ষুণে ব্যক্তিদের বলা হয় সালাও।
অল্প বয়সের দুরন্ত কিশোর ম্যানোলিন। পাঁচ বছর বয়স থেকে সান্তিয়াগোর মাছ ধরার সঙ্গী। সেও তাকে ফেলে চলে গেছে। প্রথম চল্লিশ দিন সে সান্তিয়াগোর সাথেই ছিল। কিন্তু একটিও মাছ না পাওয়ায় পরিবার থেকে তাকে সান্তিয়াগোর সাথে মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।
সে এখন অন্য একটি জেলে নৌকায় কাজ নিয়েছে। সেখানে প্রথম সপ্তাহেই তারা বেশ বড় বড় তিনটি মাছ ধরেছে।
এদিকে সান্তিয়াগো রোজ শূন্য ডিঙি নিয়ে তীরে ফেরত আসে। তার এমন বেহাল দশা দেখে ম্যানোলিনের মন খুব খারাপ হয়। ম্যানোলিন কাছে এসে সান্তিয়াগোর সাথে কথা বলে। সে আবারও তার সাথে মাছ ধরতে যেতে চায়।
কিন্তু বৃদ্ধ তাকে বর্তমানে যে নৌকায় আছে সেখানেই থেকে যেতে বলে। পুনরায় তার নৌকায় আসতে বারণ করে। বৃদ্ধ ম্যানোলিনকে বোঝায়। সে ছোট মানুষ। তাকে তার বাবা-মায়ের কথা মেনে চলতে হবে।
মাছ না পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, মানুষজন সান্তিয়াগোর মাছ ধরার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। তারা ভাবছে সে হয়তো মাছ ধরাই ভুলে গেছে।
নাহ এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। সান্তিয়াগো মনে মনে ভাবল পুরো গ্রামবাসীকে দেখিয়ে দেয়া দরকার তার শক্তি ও ক্ষমতা। সে বুড়ো হতে পারে। তার শরীরের শক্তি কমে যেতে পারে। গায়ের চামড়া কুঁচকে যেতে পারে। কিন্তু তার মনোবল এখনও দমে যায়নি। সে তা প্রমাণ করে ছাড়বেই।
পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগে আগে সমুদ্রের প্রবাল পাথরের মধ্য দিয়ে হেঁটে মোড়কে মোড়ানো একটি সার্ডিন মাছ, দুটো মাছ ধরার টোপ এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি হাতে নিয়ে সান্তিয়াগো ছুটে চললো তার ডিঙ্গি নৌকার দিকে।
নৌকার দড়ি শক্ত করে বেঁধে দাঁড় টানতে টানতে ভোরের অন্ধকারে সে পাড়ি জমালো উন্মুক্ত সাগরের বুকে। সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে ম্যানোলিন তাকে বিদায় জানালো।
আজ সে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে। দীর্ঘদিনের মাছ না পাওয়ার ব্যর্থতাকে সে যেভাবেই হোক কাটিয়ে উঠতে চায়।
তাই ঠিক করলো মহাসাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থানে যাবে জেলেরা যেটার নাম দিয়েছে গভীর কুয়ো। সেখানে গেলে নিশ্চয়ই মাছ পাওয়া যাবে।
সমুদ্রের মাঝে নৌকা চলছে। ছুটে চলেছে গভীর থেকে গভীরে। মাঝে মাঝে বৃদ্ধের গায়ে ছিটকে পড়ছে উড়ুক্কু মাছের দল। মাছরাঙা পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে ওগুলোকে শিকার করে মুখে পোরার জন্য।
এক নাগাড়ে দাঁড় বাইছে সে। তাই খুব তাড়াতাড়ি সমুদ্রের গভীর কুয়ো খ্যাত জায়গাটির থেকেও অনেক দূরে চলে গেল। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
পুরোপুরি আলো ফোটার আগেই সে টোপগুলোকে পানিতে ফেলে দিলো। বেশ কয়েক জায়গায় বড়শির সাথে বেঁধে সমুদ্রের খানিকটা গভীরে টোপ ফেলল সে। জীবনের সবচেয়ে সেরা মাছটি ধরার স্বপ্নে বিভোর সে।
কিছুক্ষণ পর একটি টোপ নড়েচড়ে উঠল। সাবধানে টোপটি উঠাতেই একটি ১০ পাউন্ড ওজনের টুনা মাছ উপরে উঠে এলো। কিন্তু সে এরচেয়েও বড় কিছু না ধরে বাড়ি ফিরবে না।
সে টুনা মাছটিকে আরেকটি বড়শিতে গেঁথে টোপ হিসেবে ব্যবহার করল। এই টোপটিকে সাগরের অনেকটা গভীরে স্থাপন করলো সে। ছোট্ট ডিঙ্গি যথারীতি সমুদ্রে ভেসে চলেছে। চারপাশে তাকালে দূরের জেলেদের নৌকা ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
খানিকটা সময় কেটে গেল কোন নড়াচড়া নেই। কিছুক্ষণ পর একটি টোপ নড়ে উঠল। বৃদ্ধ বুঝতে পারল টোপটি কাজ করতে শুরু করেছে।
তার চোখে মুখে আনন্দ ফুটে উঠলো। টোপটি পুরোপুরিভাবে মাছের মুখে প্রবেশ করার জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পর মাছটি টোপটিকে পুরোপুরি গিলে ফেলল। মাছটি এত শক্তিশালী যে বৃদ্ধ তার হাতের সাহায্যে এটিকে শান্ত করতে পারছিল না। শুরু হলো মাছের সাথে বৃদ্ধের লড়াই।
মনে মনে সে ভয় পেল। এটি যদি সাগরের গভীরে যেতে শুরু করে তাহলে নৌকাসহ তাকে তলিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভাগ্য ভালো হওয়ায় এটি তা করলো না। তবে প্রচণ্ড শক্তির সাহায্যে নৌকাটিকে টেনে সামনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।
বৃদ্ধ কোনোভাবেই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ক্রমেই দূর থেকে দূরে নৌকাসহ বৃদ্ধকে ছুটিয়ে নিয়ে চলছে মাছটি। ছুটতে ছুটতে চার ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু এখনো মাছটিকে একবারের জন্যও দেখতে পেল না সে।
এভাবে চলতে থাকলে একসময় বৃদ্ধ নিজেই মারা পড়বে। ইতোমধ্যেই ম্যানোলিনের অভাব বুঝতে শুরু করেছে সে। ছেলেটা যদি এখন তার সাথে থাকত! তাহলে এত কষ্ট করতে হতো না।
বৃদ্ধ একাই দড়িটিকে শক্ত হাতে পেঁচিয়ে ধরে রইল। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। চারদিকে স্থলভাগের চিহ্নটুকুও দেখা যাচ্ছে না।
এভাবেই সারারাত পার হয়ে গেল। মাছটি কোন লাফালাফি করল না। সমুদ্রের গভীরেও ডুব দিলো না। বুড়ো ভাবলো, মাছটি কি জানে একজন জীর্ণশীর্ণ মানুষ তাকে ধরে আছে!
বৃদ্ধের সাথে যে খাবার ছিল তা ইতোমধ্যে শেষ হতে চলেছে। কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে এভাবে মাছটির সাথে তার লড়াই চলতে লাগল।
একদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও বৃদ্ধ হাল ছাড়ল না। তার হাতে ফোসকা পড়তে শুরু করেছে। হাত দুটো যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের শীতল আবহাওয়ায় ধীরে ধীরে তার শরীরও নিশ্চল হতে লাগল। সান্তিয়াগো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে দুঃখ-যন্ত্রণা মানুষের কাছে কোন ব্যাপারই নয়।
গভীর সমুদ্রের মাঝে লড়াই করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তাই সে মাছটির সাথে আমৃত্যু লড়ে যাওয়ার পণ করেছে। সে কোনোভাবেই মাছটিকে ছেড়ে যেতে চায় না। খালি হাতে তীরে ফিরলে কেউই বিশ্বাস করবে না সে এত বড় আকারের একটি মাছ ধরেছিল। সবাই ভাববে সে বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
কিন্তু সে এখনও দমে যায়নি। কারণ পরাজয়ের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তবুও সে পরাজয় মেনে নিতে পারে না।
মাছটিও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তবে কয়দিন বড়শিতে আটকে থাকায় সে খুব ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। তাতেও সে সান্তিয়াগোর কাছে ধরা দিচ্ছে না।
আর বুড়ো সান্তিয়াগো অপেক্ষায় আছে কখন মাছটি ভেসে উঠবে আর তার হাতের টেঁটা দিয়ে মাছটির হৃদপিণ্ড ফুটো করে দিবে।
কিছুক্ষণ পরে মাছটি পানির একটু উপরে উঠল। সমুদ্রের নীল জলরাশি ভেদ করে বুড়ো সান্তিয়াগো প্রথমবারের মতো মাছটিকে দেখল। এটি ছিল আকারে তার নৌকার থেকেও প্রায় ১২ ফুট লম্বা একটি মার্লিন মাছ।
বৃদ্ধ মাছটিকে দেখে অনেক খুশি হয়। এটি তার সৌভাগ্যের প্রতীক। লোকে তাকে আর কখনো অপয়া বলবে না।
এবার মাছটি উপরে উঠে এপাশ ওপাশ করে সাঁতার কাটতে থাকে। বৃদ্ধ হাতে বর্শা নিয়ে সুযোগ বুঝে মাছটির হৃদপিণ্ডে আঘাত করার অপেক্ষা করতে থাকে।
বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর সফলভাবে মাছটির হৃদপিণ্ডে আঘাত করতে সক্ষম হয় সে। সমুদ্রের নীলাভ পানি মাছটির রক্তে রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। বৃদ্ধের মুখে সফলতার হাসি ফুটে ওঠে।
একসময় মাছটি পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মাছটিকে নৌকার পাটাতনের সাথে বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে চলতে থাকে সে। অনেক দূরের পথ।
তিনদিন ধরে না খেয়ে দুর্বল হয়ে গেছে সে। সমুদ্র থেকে কিছু চিংড়ি ধরে কাঁচাই খেয়ে নেয় সে। সাথে বোতলের তলানিতে থাকা সামান্য পানি পান করে গলা ভিজিয়ে নেয়।
তাকে যে সফল হতেই হবে। কিন্তু দেখা দেয় নতুন এক বিপত্তি। ইতোমধ্যে রক্তের গন্ধ পেয়ে একটি হাঙর নৌকার সাথে বেঁধে রাখা মাছটির দিকে ছুটে আসতে শুরু করেছে।
বৃদ্ধ হাতে থাকা টেঁটাটি নিয়ে নতুন একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। ততক্ষণে হাঙরটি তার ধারালো দাঁত দিয়ে মাছের অনেকটা অংশ খেয়ে ফেলেছে। অনেক চেষ্টার পর বৃদ্ধ টেঁটা দিয়ে হাঙরটির মাথা ফুটো করে দিতে সক্ষম হয়। তবে টেঁটাটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়।
প্রায় ১৫০০ পাউন্ড ওজনের মাছটির দেহ থেকে ৪০ পাউন্ডের মতো মাংস খুবলে নিয়ে গেছে রাক্ষুসে হাঙরটা। এটাকে খতম করার পরও বৃদ্ধের ভয় কাটল না।
কেননা সাগরে মাছটির রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে। রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে হাঙরেরা দলবেঁধে আক্রমণ করলে মাছটির শরীরে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
কিছুক্ষণ পর তাই ঘটল। একদল হাঙর এসে মাছটিকে ঘিরে ধরল। বৃদ্ধ তার হাতে থাকা একটা ছোট্ট ছুরি নিয়ে হাঙরের সাথে লড়াই করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু হাঙরগুলো মাছটির পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ খুবলে খুবলে খেয়ে ফেলেছে।
বৃদ্ধ ভাবল ওগুলো যদি ওর মস্তিষ্কে এভাবে আঘাত করে ওকে মেরে ফেলত! তবে এমন দৃশ্য কখনো চোখে দেখতে হতো না।
বৃদ্ধের মন বিষণœ হয়ে উঠল। মাছটির অনেকাংশ খেয়ে ফেলায় নৌকাটি আগের থেকে অনেক হালকা হয়ে গেছে।
বাতাসের বেগও অনেক বেশি। স্রোতও অনুকূলে রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে তীরে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগার কথা নয়।
সন্ধ্যার দিকে আরো দুটো হাঙর হানা দিলো। মাছটির অবশিষ্ট অংশও খেয়ে নিলো ওরা। চোখ মেলে এমন নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না বৃদ্ধের।
তবুও হাতে থাকা ছোট্ট একটি মুগুর নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে সে। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না।
সে সিদ্ধান্ত নিলো মরার আগ পর্যন্ত ওদের সাথে লড়ে যাবে সে।
এত ধকল সইতে সইতে তার শরীরে আর কিছু কুলাচ্ছিল না। হাত দুটো যেন অসাড় হয়ে গেছে। শরীরের কার্যক্ষমতা তো কবেই লোপ পেয়েছে। মনের শক্তি দিয়ে লড়াই করে চলল সে।
দীর্ঘক্ষণ লড়াইয়ের পরে বৃদ্ধ সান্তিয়াগো তীরে পৌঁছাতে সক্ষম হলো। হাতে থাকা বড়শির দড়িটি সমুদ্রতীরে শক্ত করে বেঁধে নিজের ছোট খুপরিতে যেয়ে ঢলে পড়ে সে।
পরদিন সকালে ম্যানোলিন সেখানে আসে এবং বৃদ্ধের এই হাল দেখে কেঁদে ফেলে সে। বৃদ্ধের ক্ষতবিক্ষত হাতের দিকে তাকানোর পর ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রামবাসী নৌকার সাথে বেঁধে রাখা মাছের বিশাল কঙ্কালটির চারপাশে ভিড় করে। অন্যান্য জেলেরাও তীরে দাঁড়িয়ে এটিকে দেখতে থাকে।
তারা নিজেদের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাদের মধ্য থেকে একজন তো এটিকে পরিমাপ করতে শুরু করেছে। এটি ছিল নাক থেকে লেজ পর্যন্ত পুরো ১৮ ফুট লম্বা বিশাল একটি মার্লিন মাছ।

Share.

মন্তব্য করুন