অমর একুশে বইমেলা ২০২২ শুরু হলো গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রায় প্রতি বছর পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরুর রেওয়াজ থাকলেও গত দু’বছর ধরে এই সিস্টেম ভাঙছে করোনার জন্য। একসময় কিন্তু ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতো বইমেলা। এর নামও পরিবর্তন হয়েছে, স্টল নিয়ে হয়েছে নানান ঝামেলাও। বইমেলার নানান হিসেব-নিকেশ নিয়েই আজকের আয়োজন।

করোনার ভয়াল থাবা, দিকে দিকে মৃত্যুর মিছিল, মেলা হবে তো? হবে কি হবে না তা নিয়ে দোদুল্যমান ছিল বাংলা একাডেমি। শেষ পর্যন্ত হচ্ছে, মাত্র ১৪ দিনের জন্য মেলা চলবে এমন ঘোষণা দিলেও বাড়তে পারে সময়। মেলার আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে প্রতিবছরের মতো এবারও আছে শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা কর্নার, যেখানে দেশ সেরা সব লেখকের কিশোর উপন্যাস-কমিকস ইত্যাদিতে ভরপুর। যদিও জ্ঞানরাজ্য স্টল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না এবার। লোকসানের ভয়ে এবার স্টল দেয়নি অনেক প্রকাশক। তবে মন্দা বইমেলায়ও বেশ কিছু দুর্দান্ত বই এসেছে, ‘আমার ডেঞ্জারাস মামী’, ‘অপারেশন জ্যাকপট’, ‘অগ্নিযোদ্ধা’সহ আরো অনেক বই। চলো আমরা বইয়ের খবরে ঢোকার আগে বইমেলার ইতিহাসটা একটু করে জেনে নিই।

তোমাদের জানিয়ে রাখি, বইমেলার শুরুটা হয়েছিল ‘শিশু গ্রন্থমেলা’ নামে। ১৯৬৫ সালে শিশুদের জন্য ছোট্ট যে মেলা হলো তা যে মহীরুহ হয়ে উঠবে তাই বা কে ভাবতো? ১৯৬৫ থেকে ৭২ পর্যন্ত সেভাবে বইমেলা নিয়ে আর ভাবেনি কেউ। জাতিসংঘ ১৯৭২ সালকে গ্রন্থবর্ষ ঘোষণা করে। তোমাদের এখন করোনাকালে অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয় না? তেমন এক অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে বাংলা একাডেমি একটি বইমেলার আয়োজন করে। ১৯৮৩ পর্যন্ত ঢিমেতালে চলে। ৮৩-তে প্রথম আনুষ্ঠানিক বইমেলা হয়।

তখনকার দৃশ্যপট দেখো, পরের বছর ১৯৮৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি ছোটখাটো মেলা হয়। মেলা চলে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। খুবই দৈন্যদশা। তারপর দিন যত গড়ালো বাড়তে থাকলো মেলার পরিধি, বাড়লো বিক্রি-বাট্টা। শিশু গ্রন্থমেলা হয়ে গেল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। নামটা কিন্তু চেঞ্জ হয়েছে বারবার। শুরুতে শিশু গ্রন্থমেলা, তারপর ১৯৮৩ পর্যন্ত বাংলা একাডেমি বইমেলা (অবশ্য তখন ‘একাডেমী’ লেখা হতো, এই বানানও পরিবর্তন হয়েছে সম্প্রতি), ১৯৮৪-তে ছাত্রবিক্ষোভের প্রেক্ষিতে বইমেলার নাম হয়ে যায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সেই থেকে বইমেলা যেমন নিয়মিতভাবে হয়ে আসছে, তেমনি এর পরিধিও বেড়েছে অনেক। লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের সংখ্যাও বেড়েছে উত্তরোত্তর। দিন যত গড়াচ্ছে এবারের বইমেলায়ও বাড়ছে পাঠকের ভীড়, আসছে নতুন নতুন বই। চলো কিশোরদের জন্য কী কী বই এসেছে একটু দেখে আসি।

ইতিহাসভিত্তিক ‘অপারেশন জ্যাকপট’ বের করেছে পাঞ্জেরি, অনন্যা বের করেছে ‘বুদ্ধিমতি তিতিয়া’, রয়েল পাবলিকেশন থেকে বের হয়েছে আলী ইমামের ‘সোনার কৌটা’, ‘নানা দেশের রংবেরঙের গল্প’। কবি নজরুলের উপর একটা চিত্রনাট্য বের হয়েছে, নাম ‘দুখুমিয়া’। স্টিফেন কিং এর ‘১৪০৮’ অনুবাদ করেছেন সালমান সাদ, ঈহা প্রকাশনী বের করেছে। আর এসেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র নতুন সংস্করণসহ নানা বই। আগেই বলেছি, মেলা যত বাড়ছে ততো বাড়ছে বই।
আমরা শিশু কর্নারে চোখ ফেরাই। এখানে নানা বয়সী বাচ্চাদের বই তো আছেই; আছে কমিকস, অনুবাদ, সায়েন্স ফিকশনসহ আরো নানা বই। এখানে বেশি বিক্রি হচ্ছে কমিকস। আশ্চর্য কমিকস ডাইজেস্ট, বেসিক আলী, অগ্নিযোদ্ধা, মুজিব এগুলো দু’হাতে কিনছে ছোটোরা। এছাড়া নানান ধরনের কমিকস এনেছে পাঞ্জেরি ও ঢাকা কমিকস।

আর সিসিমপুরের কথা তো বলাই হয়নি, সিসিমপুরের একরত্তি স্টল যেন ছোট্টদের স্বর্গরাজ্য! সারাক্ষণ ছুটোছুটি হৈ-হুল্লোড় করছে বাচ্চারা। এটা চাই ওটা চাই। এখানে খুব বিক্রি হচ্ছে ‘আগুন ও হালুমের পায়েশ’, ‘সালাদিয়ার সুষম খাবার’সহ আরো নানান বই। শিশুদের জন্য আরো এসেছে ‘রায়হানের রাজহাঁস’, ‘ভূতের যত ভয়’, ‘সুখের রাজ্যে তুলতুল’, ‘বিদ্যাসাগরে বুদ্ধির জয়’। এ সব তো মেলার শুরুর দিনের হিসাব, মেলা যত বাড়বে, বাড়বে বই।
প্রতি শুক্র ও শনিবার বইমেলা শুধুই শিশুদের থাকে, সকাল ৯টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত শিশু প্রহর। এ সময় বাচ্চারা নিজেদের মতো বই কিনতে পারে, বড়দের হুটোপুটি থাকে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বড়দের স্টলে শিশুদের বই কিনতে পাওয়া গেলেও শিশুদের স্টলে বড়দের বই সেভাবে থাকে না। কিশোরদের জন্যও কি এমন আলাদা কর্নার দরকার? চাইলে কিন্তু প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির ‘পরামর্শ বক্স’ এ ফেলতে পারো।
২০০৫ এ কিন্তু সেরা বইয়ের একদম প্রথম বইটা ছিল কিশোরদের। ভাবতে পারো? বড়দের বাঘা বাঘা সব বই টপকে সেবার কিশোরদের জন্য লেখা জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’ প্রথম হয়েছিল। বিক্রি হয়েছিল ত্রিশ হাজার কপি। তাহলে কিশোরদের একটা বিরাট অংশ তো বই পড়েই! কিশোরদের জন্য আলাদা কর্নার হলে দারুণ হতো না?
এই যে বইমেলা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হচ্ছে এটা কিন্তু পরামর্শ বক্স থেকেই আইডিয়া এসেছে। প্রথমে বলা হচ্ছিল পাশে থাকা পরমাণু শক্তি কমিশনের দেয়াল ভেঙে পুরো এলাকায় বইমেলা হোক, পরে প্রস্তাব আসলো টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বরগামী রাস্তাজুড়ে হোক বইমেলা। হয়েছিলও। কিন্তু নানান বিশৃঙ্খলায় তা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পৃথিবীর বিখ্যাত নানান বইমেলার সাথে আমাদের বইমেলার তুলনা দেওয়া হয়, দীর্ঘ সময় ধরে চলা একমাত্র বইমেলা আমাদের।

আরো যেসব বইমেলা আছে বিশ্বে

লন্ডন বইমেলা, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা, আবুধাবি বইমেলা, ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা সহ আরো নানা বইমেলা হয় বিশ্বজুড়ে সেসব বইমেলার চেয়ে আমাদের মেলা অনেক বেশি সময় ধরে চলে। এবার আমরা কিছু মেলা সম্পর্কে জেনে আসি।
ওয়ার্ল্ড বুক ফেয়ার, নয়াদিল্লি : এক সপ্তাহের এই বইমেলা শুরু হয় সেই ১৯৭২ সালে, জাতিসংঘের অ্যাসাইনমেন্ট এর মাধ্যমে। সাধারণত মার্চ থেকে শুরু হয়।
কলকাতা বইমেলা, পশ্চিমবাংলা : সাধারণত জানুয়ারির শেষে শুরু হওয়া এই বইমেলা ১০-১১ দিনের হয়ে থাকে। ১৯৭৬ থেকে এর শুরু।

কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা : ১৯৬৯ থেকে শুরু হওয়া এই বইমেলা দু সপ্তাহের হয়ে থাকে।
এবার সবচেয়ে বড় বইমেলা কোনটি? ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার সময় মাত্র ৫ দিন, প্রায় ৩ লাখ লোক এখানে আসে। এটাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা বলা হয়, ৫০০ বছর পূর্বে এই মেলার শুরু। যাবে নাকি একদিন? অবশ্যই যাবে একদিন। তার আগে ঢাকার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসো একদিন, সম্ভব না হলে তোমার এলাকার আশেপাশে কোথাও কিংবা বিভাগীয় শহরে যে বইমেলা হয়, সেগুলোতে ঢুঁ মেরে আসো। ছোট্টবন্ধুরা, খুব ভালো থেকো তোমরা। বইয়ের সাথে থাকো, পৃথিবীকে দেখো কোটি মানুষের চোখে।
‘বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।’
দেখতেই যদি চাও বই পড়ো।

Share.

মন্তব্য করুন