ভাষা প্রতিটি মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। জন্মগতভাবেই এই অধিকার মানুষের। এটি মানুষকে স্বয়ং স্রষ্টা দিয়েছেন। এই বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। বা অন্য মতও নেই। অর্থাৎ মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে যতগুলো অধিকার নিয়ে ভাষা সেই অধিকারের একটি উল্লেখয়োগ্য অধিকার। আরও অধিকার আছে। যেমন বেঁচে থাকার অধিকার! স্বাধীনতার অধিকার। দেশের নাগরিকত্বের অধিকার। শ্বাস প্রশ্বাসের অধিকার। বসবাসের অধিকার। ভাত-কাপড়ের অধিকার। ঠাণ্ডা গরমের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার অধিকার। লেখাপড়ার অধিকার! এইরকম আরও আটও অধিকার আছে! যা মানুষ জন্মগতভাবে পেয়ে যায়। কিন্তু কখনও কখনও মানুষেরা মানুষের অধিকার কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। কেড়ে নেয়ও অনেকেই। সারা পৃথিবীর বহু দেশে এরকম আছে যেখানে মানুষ অন্য মানুষের জন্মগত অধিকার কেড়ে নিয়ে শাসক সেজে বসে আছে। আবার এসব অধিকারের কথা বলতে গেলে তাদেরকে নির্যাতন করে নানানভাবে।

আমরা যারা এ বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি, আমাদের জন্মগত ভাষা যাকে আমরা মাতৃভাষা বলি, তা হলো বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষায় আমাদের মায়েরা কথা বলেন। আমাদের দাদা-দাদী, নানা-নানী এবং তাদের পূর্বপুরুষও এই ভাষায় কথা বলতেন। যে কারণে আমাদের মাতৃভাষা হলো বাংলা ভাষা। মাতৃভাষার প্রতি একধরণের গভীর ভালোবাসা থাকে সকলের। দুনিয়ার সকল জাতির লোকদের কাছেই তার মাতৃভাষা ভীষণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মাতৃভাষা ছাড়া মানুষ কেমন করে কথা বলবে! কেমন করে স্বপ্ন দেখবে! কেমন করে মনের ভাব প্রকাশ করবে! এমন কি কল্পনা করা যায় যে পৃথিবীতে কোনো ভাষা থাকবে না! যদি সত্যি সত্যি ভাষা না থাকে কী হবে? যদি না থাকতো তবে কি হতো একবার ভাবলে ভয় লাগে খুব। কেমন যে লাগে পরিস্থিতিটা। মানুষও তখন প্রাণীদের মতো কুঁইকাঁই কাঁইমাই কুকু অ্যাঁ আঁ করতো শুধু। ভাষা না থাকলে মানুষের এতো মর্যাদা এতো সম্মান এতো পদ-পদবী কি করে হতো! ভাষার জন্যই এই মানুষ অন্য সব প্রাণীর ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছে।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে তখনকার শাসকগোষ্ঠী অকারণ কাহিনি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফেলেছে। কী কারণে উর্দু ভাষাটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে তার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। কী লাভ হলো এটা করে? বরং বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে সেসব শাসকদের।

১৯৪৮ সালের দিকের কথা। সেই সময়কার শাসক গোষ্ঠী ঘোষণা করলো- শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা। পূর্ব পাকিস্তান যেটি এখন আমাদের বাংলাদেশ, এখানকার বেশির ভাগ মানুষই বাংলা ভাষায় কথা বলতো। উর্দু যদি রাষ্ট্র ভাষা হয় তো বাংলা ভাষার মানুষ কি করবে! এমন চিন্তা থেকেই একসময় তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে বাংলা ভাষার পক্ষে। এই আন্দোলনের অগ্রপথিক সংগঠন হলো তমুদ্দুন মজলিশ। আন্দোলন হতে হতে একসময় ভীষণ জোরালো হয়ে গেলো। ১৯৫২ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলা ভাষাভাষিরা প্রতিবাদী মিছিল বের করে। পাকিস্তানি শাসকদের ইশারায় এই মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণ করে পুলিশ। এতে বরকত-সালাম-রফিকসহ প্রাণ দেন অনেকে। অনেকে চোখ-কান, হাত-পা হারান। চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় অনেকেই। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা ছিনিয়ে নিতে পারেনি তারা। আমাদের বাংলা ভাষা আমাদের থাকলো। আমরা মাতৃভাষা পেলাম আমাদের করে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো জাতি এমন আর নেই যারা ভাষার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছে। যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। না কই- নেই কোথাও, কোনোখানে। আমরা সংগ্রাম করেছি, জীবন দিয়েছি অর্থাৎ আমার ভাই শহীদ হয়েছে এ ভাষার জন্য। সেদিক থেকে কত না গুরুত্বপূর্ণ আমাদের এই মাতৃভাষা বাংলা।
এখন প্রশ্ন হলো- আমরা কি আমাদের ভাষার মান রক্ষা করতে পেরেছি তেমন করে? পারিনি তো ঠিক মান রক্ষা করতে। আমরা স্লোগান দেই অনেক জোর গলায়। কিন্তু স্লোগানের আলোকে কখনও কাজ করার চিন্তা এবং চেষ্টা করিনি। আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যুগোপযোগী কোনো পদক্ষেপ নেইনি আমরা। আমাদের শিশুরা সহজে বাংলা শিখতে পারে কি? এই বাংলা বলতে বাংলা ভাষার জাতীয় রূপের কথা বলছি। আমরা কি সবাই আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারি? পারি না তো! তাহলে কি হলো ব্যাপারটি!

আমরা যে সংগ্রাম করলাম, জীবন দিলাম, পঙ্গু হলাম! তার কি ফল পেলাম! কিন্তু আরও দুঃখের বিষয় উল্লেখ করতে হয়, আমাদের যারা উচ্চ শিক্ষিত লোক তারা বাংলা ভাষায় কথা বলতে মনে হয় লজ্জাবোধ করেন। তাদের ধারণা, বাংলা হলো ছোটলোকদের বুলি বা কম শিক্ষিত লোকদের মুখের ভাষা। তারা যেহেতু বড় শিক্ষিত, অতএব তাদের ভিনদেশী ভাষায়- বিশেষ করে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে তাদের সম্মান মর্যাদা এবং গৌরব! নইলে সব মিশে যাবে ধুলিকণায়!

এর জন্য কি একুশে ফেব্রুয়ারির এতো বিশাল আন্দোলন হলো? এর জন্যই কি হলো এতো শহীদ! আমরা প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে কি চমকপ্রদ আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে যাই। কালো পোশাক পরিধান করে মিছিল করি। মধ্যরাতে শহীদ মিনারে ফুলের ডালা বিছিয়ে দিয়ে ফুলের স্তূপ করি। আর একুশে ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই সব ভুলে থাকি। কিন্তু আমাদের উচিৎ সারা বছর বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করা। ভাষার শুদ্ধতা শেখার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। যারা এখন শিশুকিশোর তোমাদের এখন থেকে সচেতন হতে হবে। এখন থেকে শিখতে হবে ভাষার জাতীয় রূপ। শুদ্ধ করে বলা এবং লেখার কোনো বিকল্প নেই। যদি আমরা সঠিকভাবে ভাষার সম্মান রক্ষা করতে পারি, তবেই মর্যাদাবান হবে একুশে ফেব্রুয়ারি।

Share.

মন্তব্য করুন