(গত সংখ্যার পর)

সেতু পেরিয়ে আমরা নদীর পাড় ধরে উত্তর দিকে এগুচ্ছি। বাঁ দিকে পাহাড়ের টিকিতে একটি প্রাচীন ক্যাথিড্রাল। বুদা ক্যাসেলের কাছেই সেইন্ট ম্যাথিয়াস চার্চ এটি, যা প্রথম নির্মিত হয়েছে একাদশ শতকে, যার আর্কিওলজিক্যাল অস্তিত্ব অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতকে চার্চটি গোথিক স্টাইলে পুনঃনির্মাণ করা হয়। ধর্মশালাটি সমতল থেকে বেশ অনেক উঁচুতে। মনে মনে ঠিক করে ফেলি, মেঘের কাছে যাবো, শান্তির মেঘ ছুঁয়ে দেখে আসবো হাজার বছরের প্রাচীন দেবালয়কে।
রাস্তাঘাটে তেমন ট্রাফিক নেই। শনিবার বলেই হয়ত। তবে দানিয়ুবের পাড়ে, বিশেষ করে ক্যাথিড্রালের কাছে এবং বুদা ক্যাসেলের কাছে পর্যটক গিজগিজ করছে। নদীর পাড় ঘেঁষে ছুটে যাওয়া রাস্তায়, যে পথ দিয়ে এই মুহূর্তে আমরা হোটেলে যাচ্ছি, একটার পর একটা হপ-অন-হপ-অফ ট্যুরিস্ট বাস ধাঁ ধাঁ করে ছুটছে। কোনোটা লাল, কোনোটা হলুদ।

ভাড়া মিটিয়ে হোটেলের সামনে দাঁড়াতেই কাচের দরোজা দু’ভাগ হয়ে গেল। সুদর্শন যুবা রিসেপশনিস্ট আমাদের ঢুকতে দেখেই সচকিত হলো। এক দুই কথার পরেই বুঝে ফেলেছি যুবকের বাড়ি উত্তর আফ্রিকার আরব অধ্যুষিত কোনো ভূ-খণ্ডে, মরক্কো হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। বেশ দক্ষ, আমার নাম বলতেই কম্পিউটার থেকে রিজার্ভেশন বের করে ঝটপট আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঘরের চাবি দিয়ে দিলো। নামটি আমাকে দুবারও বলতে হয়নি এবং নামের বানানও বলে দিতে হয়নি।
হোটেলের লোকেশন একটি বড় ব্যাপার। আর্ট হোটেল আদর্শ লোকেশনে অবস্থিত। একেবারে দানিয়ুবের পাড়ে। রিসেপশন এরিয়াটি বেশ বড়সড়, সিপ্লট লেভেল। নিচের অংশে রিসেপশন অফিস, ওপরের অংশে খুব শৈল্পিকভাবে চেয়ার-টেবিল পাতা। দুই লেভেলেই সোফা এবং কফি টেবিল আছে। কোনায় কোনায় ফুলদানি, টবে লাগানো সবুজ প্ল্যান্ট। দেয়ালে বেশ কয়েকটা বিশাল ফ্রেমে বাঁধানো বুদাপেস্টের ছবি, আর তিনটি বড় বড় পেইন্টিংস। এমনভাবে সোফা এবং চেয়ার-টেবিল পাতা, যেখানেই বসি না কেন দৃষ্টি দানিয়ুবের দিকেই ফেরানো, হয় সোজাসুজি, না হয় কোনাকুনি, বাঁকা করে দানিয়ুব দেখা। বুঝতে পারছি এই শহরের আত্মা হচ্ছে দানিয়ুব, বুদাপেস্টের মানুষের জীবনাচার, জীবনযাত্রা, আনন্দ-আড্ডা, বিনোদন, সব কিছুই দানিয়ুবকে ঘিরে। দানিয়ুবের সাথে ওদের কোনো কষ্টের গল্প আছে কিনা তা-ই এখন আমাকে খুঁজে বের করতে হবে।

অনেক উঁচু সিলিং, উঁচু দেয়ালে ঝোলানো বড় বড় পেইন্টিংসগুলো আর্ট হোটেলের নামের মাহাত্ম্যকে নিশ্চিত করেছে। প্রথম দর্শনেই আর্ট হোটেল ভালো লেগে গেল। অবস্থান যেন আনন্দময় হয়। রুমের দরোজা খুলে আমরা বিস্মিত হয়েছি দুটি কারণে। প্রথমত দানিয়ুবের দিকে পুরো দেয়াল জুড়ে বিশাল জানালা, পর্দা সরাতেই আকর্ষণীয় প্রবহমান দানিয়ুব, আর ওপারে অনিন্দ্য সুন্দর পার্লামেন্ট ভবন। অন্য যে কারণে বিস্মিত হয়েছি, ঘরে দুটি কুইন বেডের বদলে একটি কিং বেড। দেগেমু আমাকে আগেই বলে রেখেছিল, আমার যদি আপত্তি না থাকে ও রুম শেয়ার করতে চায়, এতে বড় রকমের অর্থ সাশ্রয় হবে। আমিও আপত্তি করিনি, সারাদিন তো বাইরে বাইরেই থাকবো, শুধু ঘুমুবার সময় ঘর দরকার, অবশ্য একটি ভয় মনের মধ্যে কাজ করেছিল, ও যদি নাক ডাকে তাহলে বিপদ হবে। অতীতে রুম মেটের নাকডাকা-বিড়ম্বনায় বেশ কয়েকবার পড়েছি।
আমি দেগেমুকে বলি,
বের হও।
ওর একটু বুঝতে সময় লাগে। বলে, হোয়াট?
আমি বলি, রুম থেকে বের হও। আমরা এই রুম নেব না।
ও বেশ বিরক্ত হয়, এর বড় কারণ ক্লান্তি। বলে, রুম তো সুন্দর, অনেক বড় আর এই অসাধারণ দৃশ্য অন্য রুমে কি পাওয়া যাবে? যদি উল্টো দিকে দেয়? আমি ওকে বিছানা দেখিয়ে বলি, তোমার সাথে রুম শেয়ার করতে রাজি হয়েছি, বিছানা শেয়ার করতে তো রাজি হইনি।
এতক্ষণে ও ঘটনাটি বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেই ধাঁ করে এবাউট টার্ন। ওকে দাঁড় করিয়ে আমি নিচে, রিসেপশনে গিয়ে কিছুটা হম্বি-তম্বি করি। বলি, রিজার্ভেশনে লিখে দিয়েছি দুটি কুইন বেড চাই, পড়োনি নিশ্চয়ই। তখন ভেতর থেকে একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে আসে, সম্ভবত ম্যানেজার। যুবককে হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় উত্তেজিত কণ্ঠে শাসাল। তারপর নতুন রুমের চাবি দিয়ে বলে, রিভার সাইড, হ্যাভ অ্যা নাইস স্টে।
আমি একটি হাসি দিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে চাইলে বুড়ো অর্ধচন্দ্রাকৃতির উঁচু রিসেপশন টেবিলের ওপাশ থেকে বেরিয়ে মুক্তাঞ্চলে, আমার কাছে এগিয়ে আসে। বেশ আগ্রহ নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, জার্মানি খুব সহজেই হাঙ্গেরি দখল করে নিয়েছিল, কেন জানেন?
আমি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ি। বুড়ো বলে, জার্মান সোলজাররা পেছন দিকে মার্চ করতে করতে এসেছিল, হাঙ্গেরিয়ানরা ভেবেছিল ওরা ফিরে যাচ্ছে।
বলেই বুড়ো হো হো করে হাসতে থাকে। আমিও ওর হাসিকে সঙ্গ দেই, হো হো করি।
বুঝলেন, হাঙ্গেরিয়ানদের মাথা হাতির মত বড় কিন্তু বুদ্ধি নেই।
লোকটি তার রুমে ফিরে যায়, আমি লিফটের জন্য অপেক্ষা করি। নাদুশ-নুদুশ যুবক রিসেপশন থেকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়, স্যার, আমি মোহামেদ, মরক্কান, হাঙ্গেরিয়ান না।
আমার কাছ থেকে কোনো কিছু শোনার অপেক্ষা না করেই সাঁই করে সে আবার তার কর্মস্থলে, অর্ধ চন্দ্রাকৃতির টেবিলটির পেছনে চলে যায়।
নতুন রুম আরো ভালো, আরো বড়। বিশাল জানালার পাশে পড়ার টেবিল, সুদৃশ্য ল্যাম্প, টেবিলের ওপর লেখার প্যাড।

আমি তন্ময় হয়ে দানিয়ুবের রূপ দেখছি। দু’পাশে সুপ্রাচীন শহর, মাঝখানে রূপালি জলধারা বিকেলের আলোয় ঝকমক করছে। সেই আলোর উচ্ছ্বাসে হেসে উঠছে পূর্ব তীরের পেস্ট শহর। আর্ট হোটেল পাহাড়ের পাদদেশে। সামনে দানিয়ুব, পেছন দিক উঠে গেছে পর্বত চূড়ায়, বুদা ক্যাসেলে। আমি যখন জলমগ্ন, হঠাৎ দেগেমু আমার পেছন থেকে বেরসিকের মতো চিৎকার করে ডেকে ওঠে। ঘুরে তাকাতেই দেয়ালের ছবিটি দেখায়। পরিপাটি করে কামানো মুখ, মোটা গোঁফ এবং দীর্ঘ কপালের এক মধ্যবয়স্ক লোকের প্রতিকৃতি।
ডু ইউ নো হিম?
আমি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ি।
আর্ট হোটেলের মালিক হতে পারে।
দেগেমু খিক খিক করে হাসে।
উইলিয়াম ফক্স। আমেরিকান ফিল্ম জায়েন্ট। ইনিই ফক্স ফিল্ম কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা।
কিন্তু তার ছবি এখানে কেন?
আমিও তাই ভাবছি। হাঙ্গেরিয়ানরা বোধ হয় আমেরিকানদের খুব ভালোবাসে।
আই ডোন্ট থিঙ্ক সো। অন্য কানেকশন আছে। মে বি হি ওয়াজ অ্যা হাঙ্গেরিয়ান।
অ্যাবসার্ট। হি ওয়াজ অ্যান আমেরিকান।
হেই দেগেমু। নো ওয়ান ইজ পিওর আমেরিকান। আর ইউ? নো ওয়ান। সবাই ইমিগ্র্যান্ট। মি. ফক্সও হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান হতে পারে।

দেগেমু আর কোনো কথা বলে না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অনেকক্ষণ পরে বলে, ‘উঁমমমম, মে বি’।
মনে মনে ঠিক করে ফেলি এটিই আমার আজ রাতের হোমওয়ার্ক। ফক্স সাহেবের আদ্যোপান্ত জানতে হবে। সূর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ভালো রেস্টুরেন্ট খুঁজতে হবে, হাঙ্গেরিয়ান গুইয়াশ খেতে হবে, খেয়ে-দেয়ে হাঁটতে হবে দানিয়ুবের পাড়ে। এম্রেস কের্তেসের শহরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অদম্য আগ্রহ নিয়ে লিফটে উঠি। ট্যাক্সি থেকে ছবি তোলার আগ্রহ কম থাকলেও এখন দেগেমুর আগ্রহ উপচে পড়ছে, সে আমার আগেই নেমে গেছে নদীর পাড়ে। রিসেপশনে এসে আমার চক্ষু ছানাবড়া। আমি ভুল দেখছি না তো? ইজ ইট সোফিয়া? হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে সোফিয়া।
বললাম, তুমি এখানে কী করছো?
আপনাকে খুঁজতেই এসেছি।
আমি বেশ একটু ধাক্কা খাই। সত্যিই কি তাই? তাই যদি হয়, ঘটনা বেশ খারাপ।
রুম নাম্বার, ফোন নাম্বার কিছুই তো জানো না। আমি যে এখন বেরুবো তার-ই বা কী নিশ্চয়তা ছিল?
একটা চান্স নিলাম। আগে বলিনি, আমার হাজব্যান্ডের বাড়ি হোটেলের পেছনেই। ওদের বাড়িতেই উঠেছি।
আমরা দু’জনই বাজার করতে বেরিয়েছি। কিছু গ্রোসারি লাগবে। ইস্তভান আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল, ফিরে আসবে ৪০-৪৫ মিনিটের মধ্যেই।
ততক্ষণ কি রিসেপশনেই দাঁড়িয়ে থাকবো?
না, নদীর পাড়ে হাঁটবো। চলুন। ও ভালো কথা, আমার ফোন নাম্বারটা লিখে নিন। কোনো দরকার হলে ফোন দেবেন। ইস্তভান আমার সাথে বাজি ধরেছে। লম্বা জার্নি করে আপনি ক্লান্ত, এখন হোটেলে ঘুমুবেন। আমি বলেছি দানিয়ুবের রূপ যে দেখেছে সে এই বিকেলে ঘুমিয়ে থাকতে পারে না।

আমি সোফিয়ার নাম্বার আমার সেলফোনে সেইভ করে নিই।
কাচের দরোজা পেরুতেই একরাশ ফুরফুরে হাওয়া এসে গায়ে লাগে। আজকের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঝকঝকে নীল আকাশ। ওয়েদার ফোরকাস্টে দেখেছি গতকালও বেশ ঠাণ্ডা ছিল।
সামনে এক চিলতে রাস্তা, হুঁশ-হাশ করে ডানে বাঁয়ে গাড়ি ছুটছে। রাস্তা পেরুলেই প্রশস্ত ফুটপাথ এবং বাইক লেইন। এর পরেই দানিয়ুব, উচ্ছল জলধারা। বাঁ দিকে ৫০০ গজ দূরে নদীর পাড়ে ছোটো দুটি যাত্রীবাহী জাহাজ।
আমরা বাঁ দিকেই হাঁটতে শুরু করি।
তুমি নিশ্চয়ই ফিল্ম প্রডিউসার উইলিয়াম ফক্সের কথা জানো?
কে না জানে? হাঙ্গেরির হাতে গোনা কয়জন কৃতী সন্তানের একজন তিনি।
হাঙ্গেরিয়ান? আমেরিকান নয়?
মাইগ্রেট করেছে, আমেরিকায়। মেধাবীরা কেউ তো আর থাকে না এখানে। এম্রেস কের্তেসের কথা আপনি তো ভালো করেই জানেন। লেখক, ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার পেল। এরপরও আসেনি, জার্মানিতেই ছিল। কিন্তু মরল এসে জন্মভূমিতেই।
হাঙ্গেরি তাকে মূল্যায়নও করেনি। ‘ফেইটলেসনেস’ তো কেউ প্রকাশই করতে চায়নি।
এটাও ঠিক। হাঙ্গেরিয়ানরা কি আর শিল্পের কদর বোঝে? না মেধার মূল্য বোঝে।
তাই বুঝি তুমিও পাড়ি জমিয়েছ? জুরিখে, ত্রিস্তান জারার শহরে?
সোফিয়া কিছুটা আনমনা হয়ে যায়। কিছুটা বিষণœ।
একটি জোক শুনেছি হাঙ্গেরিয়ানদের নিয়ে।
কোনটা?
মনে হচ্ছে হাঙ্গেরিয়ানদের নিয়ে বানানো সব জোকসই তুমি জানো।
অলমোস্ট
জার্মান সোলজাররা এতো সহজে হাঙ্গেরি দখল করে নিলো কিভাবে?
হ্যাঁ জানি, ব্যাকমার্চ, রাইট?
হ্যাঁ।

জানা জোক, তবুও সোফিয়া হাসে। তখন নদী থেকে উঠে আসা আউলা বাতাসে সোফিয়া আরাম গ্রহণ করার জন্য নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে। ডানদিকে, একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আমিও ওকে অনুসরণ করি।
বেশ অনেকক্ষণ পর ও চোখ খোলে। আর তখন ওকে ঘোরাচ্ছন্ন লাগে। এটি মানুষের জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। এই মুহূর্তেই সে জগতের সবচেয়ে বড় ভুলটি করে। আবার এটিই মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত, এই মুহূর্তেই সে সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোর রেখাটি দেখতে পায়। সোফিয়া তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। পেছনে দানিয়ুবের ঢেউয়ে সাঁতার কাটছে পার্লামেন্ট ভবন, শেষ বিলেকের আলো এসে পড়েছে এর কারুকার্যখচিত অঙ্গপ্রবাহে।
আমি কি ভুল দেখছি? একটি এইডেল্ভাইজ ফুল ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে, গোটানো পাপড়িগুলো খুলে দিয়েছে। মেলে ধরেছে তার সকল ঐশ্বর্য। দানিয়ুবের জলে আত্মাহুতি দেবার জন্য আজ সে প্রস্তুত। হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে সোফিয়া।
জোক শুনবেন? হাঙ্গেরিয়ানদের জোক।

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার বেশ খানিকটা সময় লাগে। যেন আমি অনেক দূর থেকে ফিরে এসেছি মেয়েটির গল্প শুনতে।
বলো।
সিলিংয়ে যে স্পট লাইট থাকে, তার বাল্ব বদলাতে ক’জন হাঙ্গেরিয়ান লোক লাগে বলুন তো?
আমি প্রশ্নটিই বুঝিনি। না বুঝেই এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ি, বেশ দ্রুতই নাড়ি এবং লক্ষ্য করি, আমি অহেতুকই বেশ কয়েকবার মাথা নেড়েছি। কোনো কারণে আমি কি কিছুটা নার্ভাস? নিজেই টের পাচ্ছি আমার আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। দানিয়ুব? নাকি এইডেল্ভাইজ? একটি জীবন্ত এইডেল্ভাইজ ফুল!
সোফিয়া আবার বলতে শুরু করে,
তিনজন লোক আর একটি চেয়ার লাগে। একজন বাল্বটি হোল্ডারে ধরে রাখে আর দু’জন চেয়ারটি তুলে ক্লকওয়াজ ঘোরাতে থাকে।
এতো সুন্দর করে ও জোকটি বললো যে না হেসে কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি সোফিয়া আনন্দ পায়নি। কারণ আমার হাসিতে কোনো প্রাণ ছিল না।
আমরা হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে মার্গারেট সেতুর গোড়ায় চলে আসি।
আমি বলি, হাঙ্গেরির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নাকি বেশ হিস্ট্রি আছে।
হ্যাঁ, আপনি বুঝি জানেন না? হাঙ্গেরিকে একেবারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেন না। সারা পৃথিবী লিখছে যে বল পয়েন্ট পেন দিয়ে, এটা হাঙ্গেরির আবিষ্কার। পৃথিবীকে আমরাও কিছু দিয়েছি।
তাই নাকি? জানতাম না তো?
লাসলো বিরো, এই বুদাপেস্টের ছেলে, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯৯ তারিখে জন্ম।
কি করতেন তিনি?

ভালো প্রশ্ন করেছেন? তার পেশার কারণেই বলপয়েন্ট পেন আবিষ্কার করতে হয়েছে তাকে। তিনি ছিলেন কাগজের সম্পাদক। প্রচুর লিখতে হতো। ঝর্নাকলমে বারবার কালি ভরা, সাফ করা, নিউজপ্রিন্টে কালি ছড়িয়ে যাওয়া, এসব ঝামেলা এড়ানোর জন্য তিনি এমন একটি কলম আবিষ্কার করতে চাইলেন যেটি দিয়ে অনবরত লিখে যেতে পারবেন।
ওয়াও।
তার ভাই ছিল কেমিস্ট। তাকে বললেন এই কলমের উপযোগী কালি বানিয়ে দাও।
ব্যাস হয়ে গেল?
আরো একজন যোগ দেন, জুয়ান জর্জ মেইনে। ভাই গিয়র্গি বিরো আর মেইনেকে নিয়ে তিনজন মিলে প্রথমে জার্মানি পরে আর্জেন্টিনায় গিয়ে ১৯৪৩ সালে বল পয়েন্ট পেন আবিষ্কার করেন, যার নাম দেন ‘বিরোমে’। হাঙ্গেরিয়ানরা এখনো বলপয়েন্ট পেনকে বিরোমে বলে।

ইন্টারেস্টিং। তবে উনিশ শতকে কাঠ বা লোহার ওপর লেখার জন্য ঝর্না কলমের বিকল্প কলম, হয়ত বলপয়েন্ট কলমই, বানাবার চেষ্টা করেছিলেন একজন আমেরিকান। এই গল্পও জানো নিশ্চয়ই।
অবশ্যই জানি। আমাদের স্কুলে বলপয়েন্ট পেনের ইতিহাস পড়ানো হয়। ১৮৮৮ সালে আমেরিকান নাগরিক জন জে লাউড বল পয়েন্ট পেনের পেটেন্ট করেন। তিনি হার্ভার্ডের ছাত্র ছিলেন।
তখন ওর সেলফোন বেজে ওঠে। সোফিয়া ইংরেজিতে কথা বলে। ওর স্বামী ইস্তভানের ফোন। সোফিয়া ওকে আর্ট হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে মার্গারেট সেতুর গোড়ায় আসার কথা বলে।
সোফিয়া চলে যায়। যাবার সময় ইস্তভান আমার নিউ ইয়র্কের ফোন নাম্বার চেয়ে নেয় এবং শিগগিরই আমার সাথে নিউ ইয়র্কে দেখা হচ্ছে জানায়। আমি ওকে মাস্তুরি রান্না করে খাওয়াবো বলে জানিয়ে দিয়ে হাত নাড়ি।

Share.

মন্তব্য করুন