জন্ম তার ভারতের মুম্বাইয়ে। ৮ বছর বয়সের সময় পরিবারের সাথে জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলো নিউজিল্যান্ডে। ২৫ বছর পর আবার মাতৃভূমিতে আসে ছেলেটি। নিউজিল্যান্ডের হয়ে নিজ শহর মুম্বাইয়ে টেস্ট খেলতে নামে জন্মভূমির বিরুদ্ধে। একজন ক্রিকেটারের জন্য এর চেয়ে বিশেষ দিন আর কী হতে পারে! যে কারণে মা-বাবাসহ অনেক আত্মীয়-স্বজনকেও দাওয়াত করেছিলেন মুম্বাইয়ে টেস্ট ম্যাচ দেখতে; কিন্তু আজাজ প্যাটেলের জন্য মুম্বাইয়ে খেলতে নামার সময়টি এর চেয়েও অনেক বড় কিছুর মধ্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তা কেউ ভাবেনি। ¯্রষ্টা হয়তো তার জন্য সেটাই লিখেছিলেন। যে কারণে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নেমে তিনি নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসে। টেস্টের এক ইনিংসে একাই নিয়েছেন প্রতিপক্ষের সবগুলো উইকেট। টেস্টের এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব এর আগে মাত্র দু’জন দেখিয়েছেন। তৃতীয় হিসেবে আজাজ প্যাটেল সেই তালিকায় নাম লেখালেন।

ডিসেম্বরের ৩ তারিখে শুরু হওয়া টেস্ট ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিং করতে নেমেছিলো ভারত। উদ্বোধনী জুটিতে ৮০ রান তোলেন ভারতের মায়াঙ্ক আগারওয়াল ও শুভমান গিল। ভারতের ইনিংসের ২৮তম ওভারে দলীয় ৮০ রানের মাথায় প্রথম আঘাত হানেন ডানহাতি অফস্পিনার আজাজ প্যাটেল। ওই ওভারে শুভমান গিলকে স্লিপে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন রস টেলরের হাতে। ব্যক্তিগত পরের ওভারে তুলে নেন চেতেশ^র পুজারা ও বিরাট কোহলিকে। ভারতের রান তখনো ছিলো ৮০। এরপর ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা রান তুলেছেন, তবে এর পাশাপাশি উইকেট তুলে নিয়েছেন প্যাটেল। ৩২৫ রানে ভারত যখন অলআউট হয় তখন প্যাটেলের বোলিং বিশ্লেষণ দাড়ায় ৪৭.৫ ওভার, ১২ মেডেন, ১১৯ রান, ১০ উইকেট।

এর সাথে সাথে ইতিহাসে নাম ওঠে আজাজ প্যাটেলের। নিজ জন্মভূমিতে সেই দলের বিপক্ষে এমন কীর্তি নিশ্চয়ই এই অর্জনকে আরো বড় করে তুলবে ৩৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের কাছে। তবে দলের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় প্যাটেলকে ইতিহাস গড়ার এই ম্যাচে হার মেনেই মাঠ ছাড়তে হয়। নিউজিল্যান্ড ম্যাচটি হেরেছে ৩৭২ রানের বড় ব্যবধানে। (স্কোর : ভারত ৩২৫ ও ২৭৬/৭ ডিক্লে, নিউজিল্যান্ড ৬২ ও ১৬৭)। টেস্ট ক্রিকেটের এক ইনিংসে প্রতিপক্ষের সবগুলো উইকেট নেয়ার ঘটনার প্রথম জন্ম দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অফ স্পিনার জিম লেকার। ১৯৫৬ সালের জুলাইয়ে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের ১০টি উইকেটেই নিয়েছিলেন তিনি। ম্যাচটি ইংল্যান্ড জিতেছিলো ১৭০ রানে। ডান হাতি অফ স্পিনার জিম লেকার ওই ঘটনার পর ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে যান।

এটি এমন একটি রেকর্ড তাতো আর কারো পক্ষে টপকে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ ক্রিকেটের এক ইনিংসে তো উইকেট ১০টিই থাকে। তবে কেউ আবার ১০ উইকেট নিয়ে লেকারের রেকর্ডে ভাগ বসাবেন সেটিও অসম্ভব মনে হতো এক সময়। তবে দীর্ঘ ৪৩ বছর পর সেটি আবার করে দেখান ভারতীয় লেগস্পিনার অনিল কুম্বলে। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নয়া দিল্লিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে লেকারের পাশে বসেন কুম্বলে। চতুর্থ ইনিংসে ওয়াসিম আকরামের পাকিস্তান ৪২০ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ২০৭ রানে অলআউট হয়। কুম্বলে তার লেগস্পিনের জাদু দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের একে একে প্যাভিলিয়নে পাঠান। ভারত ম্যাচ জেতে ২১২ রানে। ওই ইনিংসে কুম্বলের বোলিং ফিগার ছিলো ২৬.৩-৯-৭৪-১০। তবে সেদিন কুম্বলেকে সহযোগিতা করেছিলেন সতীর্থ পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ। কুম্বলের আট উইকেট হয়ে যাওয়ার পর শ্রীনাথ প্রতিটি ডেলিভারি দিয়েছেন স্ট্যাম্পের বেশ বাইরে। পাশাপাশি ভারতীয় আম্পায়ার জয়প্রকাশেরও কিছুটা পক্ষপাতিত্ব ছিলো বলে মনে করা হয়। তাই বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে কিছুটা বিতর্ক আছে। তবে জিম লেকার আর আজাজ প্যাটেলের বেলায় তা নেই।

আরেকটি জায়গায় জিম লেকার সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন, তা হলো এক টেস্ট ম্যাচে সর্বোচ্চ উইকেট দখল করা। তিনি ১০ উইকেট নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে। ওই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসেও তার ঝুলিতে গিয়েছিলো ৯টি উইকেট। সব মিলে তাই ওই ম্যাচে তার শিকার প্রতিপক্ষের ১৯ উইকেট। একটু এদিক সেদিক হলেই সংখ্যাটা বিশে বিশ হতে পারতো! অনিল কুম্বলে তার রেকর্ড গড়া ম্যাচে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট (মোট ১৪)। আর আজাজ প্যাটেলও তার রেকর্ড গড়া ম্যাচে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছেন ৪ উইকেট। তবে আজাজের জন্য দুঃখের বিষয় হলো এত বড় কীর্তি গড়েও দল ম্যাচ হেরেছে এবং তিনিও হতে পারেননি ম্যান অব দ্য মাচ। লেকার আর কুম্বলে হাসি মুখেই মাঠ ছেড়েছিলেন।

আরো বেশ কয়েকজন বোলার টেস্টের এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেয়ার খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন। ২০০২ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যান্ডি টেস্টে জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংসের প্রথম ৯টি উইকেট নিয়েছিলেন লঙ্কান অফ স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন। তবে দশম উইকেটের জুটির সময় তার বলে একটি ক্যাচ মিস হয়। এছাড়া মনে করা হয় যে, শেষ ব্যাটসম্যান হেনরি ওলোঙ্গা অনেকটা ইচ্ছে করেই চামিন্দা ভাসকে উইকেট দিয়েছিলেন সেদিন। মুরালিধরন এর আগেও একবার ইনিংসে ৯ উইকেট নিয়েছেন। ১৯৯৮ সালে ওভালে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ উইকেট শিকার করেন তিনি। তবে ইংলিশ ব্যাটসম্যান অ্যালেক স্টুয়ার্ট রান আউট হওয়ায় তার কপাল পোড়ে। এ প্রসঙ্গে তোমাদের জানিয়ে রাখি- ওয়ানডেতে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ উইকেট নেয়ার রেকর্ড শ্রীলঙ্কার পেসার চামিন্দা ভাসের দখলে। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে তিনি ১৯ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

Share.

মন্তব্য করুন