কুয়াশা মুড়িয়েই ওঠে সূর্য! সহজে রোদ পৌঁছে না পৃথিবীর বুকে। রোদের পক্ষে কুয়াশা ভেদ করা কঠিনই বটে। বৃক্ষরাজি চুপসে ঝিমায়। প্রায় গোটা শূন্যতা ভরে তোলে কুয়াশার বপু! ঘাস এবং ফসলের চেহারা যেনো ছড়িয়ে পড়া তুষারের বুক। এভাবেই শীত আনে প্রতিদিনের ভোর! আনবেই তো। শীতঋতু বলে কথা!
কুয়াশা তো থাকবেই! কুয়াশাহীন শীতরাত ভাবা যায়! শীতের কোনো ভোর! অথবা কোনো সন্ধ্যা! নাহ্ একদম ভাবা যায় না। কি করে যাবে! শীত আর কুয়াশায় ভীষণ জড়াজড়ি। গড়াগড়ি! কোলাকুলি! সরে না কেউ কারো থেকে। কেউ কাউকে ছাড়ে না! শীত আছে তো কুয়াশাও আছে! কুয়াশা আছে তো শীত থাকবেই। শুধু কম বেশির পর্বটি জেগে থাকে। অর্থাৎ কখনও কম শীত! কম কুয়াশা! কুয়াশার রকমফেরও বেশ! ঘন কুয়াশা! হালকা কুয়াশা! মাঝারি অথবা অল্প কুয়াশা! শীতেরও তেমনই ধরন! হাড় কাঁপানো শীত! শরীর কাঁপানো শীত! ভারী শীত! হালকা মেজাজের শীত! কম্বলি শীত! কাঁথা-শীত! কিন্তু শীত আর কুয়াশার বন্ধন বড় বিস্ময়ের! বড় মজার! এ যে শীত আর কুয়াশার লীলা! যেনো শীত-কুয়াশার হাট! কিংবা কুয়াশামেলা!
কুয়াশারা দলবেঁধে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁক থাকে। এক ঝাঁক গেলো তো আরেক ঝাঁক এলো। এ দল ও ঝাঁক কখনও গোলগাল। কখনও লম্বাটে। কখনও নদী চেহারার। আবার কখনও পাহাড়ি আকৃতির। এভাবে কখনও রোদে দেয়া সাদা শাড়ির মতো দীঘল।
কুয়াশায় হাঁটতে গেলে মুখ ভিজে যায়। পা ভিজে যবুথবু। জামা বা পোশাকের ওপর তুষার মতো জমে ওঠে কুয়াশাকুচি! মাথা খোলা হলে চুলের শরীরে কুয়াশা জমে মাকড়সার জালের মতো। কিন্তু
বৃষ্টিভেজার মতো কুশায় ভেজা যায় কি? না। তা কেন হবে! কুয়াশা তো বৃষ্টির মতো প্রবল জলের ধারা নয়! বৃষ্টিও নয় কুয়াশার ধুমে আচ্ছন্ন ধোঁয়ার মতো! বৃষ্টি ভেজায় মানুষকে! কুয়াশাও ভেজায়। দু’ ভেজা এক হতে পারে কি! না পারে না! পারে না, কারণ কুয়াশায় থাকে জলের কুচি! বৃষ্টিতে থাকে জলধারা! জলকুচি হয় না জলধারার মতো! জলধারাও নয় জলকুচির মতো। ফলে বৃষ্টিধারা আর কুয়াশাচ্ছন্নতা একাকার হবে কী করে!
বৃষ্টিতে রহস্য আছে। কুয়াশার রহস্য আরও গভীর। আরও রহস্যময়! কুয়াশায় ভেজার আনন্দও অন্যরকম! যে ভেজে সে-ই শুধু জানে। সে জানে কুয়াশার আঁচল কি করে জড়িয়ে রাখে হিম আয়োজনে। কী করে ভিজিয়ে তোলে মানুষের মন। হয়তো জিজ্ঞাসা হতে পারে- মনও ভেজায় কুয়াশা! নিশ্চয় ভেজায়। খুব করে ভেজায়। বরং বৃষ্টি শরীর ভেজায়। কুয়াশা ভেজায় মন! যে কুয়াশায় দাঁড়িয়ে যায় সে জানে। যে কুয়াশা ছাড়িয়ে যায়, জানে সেও। জানে শীত সকালের কুয়াশা কেমন করে ধুয়ে দেয় মনের পাপড়ি!
শীতের বাতাস মানে উত্তরীয় হাওয়া। এ হাওয়া বড় শুষ্ক! শুকনো। গা টানে। শরীর শুকিয়ে তোলে। অতি শুষ্ক হয়ে ওঠে ঠোঁট। সারা মুখে শীত- বাতাসের কামড়! ক্রিম, লোশন অথবা জলপাই তেলের ঘষাঘষি করার ধুম পড়ে! শরীরে উঠে আসে মোটা কাপড়। শীতের আক্রমণ থেকে রক্ষার উপায় গ্রহণ করে সবাই। সকলেই জানে শীত এলো তো বাড়তি কাপড় জরুরি। এমন বাড়তি পোশাক দেখে হাসে কি শীত! হয় তো হাসে! হয় তো বলে- আমার ভয়ে তোমাদের এ হাল। সবাই কেমন মোটাসোটা হয়ে ওঠো! ও হ্যাঁ, চিকনেরা মোটা! আর মোটারা আরও মটু! অবশ্য পোশাকের হেরফেরেই মনে হয় এটি। শীত মানুষের শরীরে সেঁধে যাওয়ার পথ খোঁজে! সামান্য সুযোগেই খলবল ঢুকে পড়ে। এটুকু ফাঁকেও শীতের প্রবেশ অহরহ! শীত ঢুকলেই কেঁপে কেঁপে ওঠে মানুষ। দাঁতে দাঁত বাড়ি দেয়! ঠোঁটে ঠোঁট আছড়ে পড়ে! জিহবা কম্পিত হয়! কম্পন ছড়িয়ে পড়ে শরীরেও।
শীতে কাতর হয় অনেকেই। অনেকেই অতি ঠাণ্ডার কবলে পড়ে। একটু শীতও অনেক শীতের মতো লাগে। অনেক শীত হলে তো কথাই নেই। মাথা থেকে পা তক মুড়িয়ে নেয়ার কি দারুণ আয়োজন! ঠোঁট কাঁপা-কাঁপি! ই ই উ উ হি হা কত ঢঙের শব্দ জেগে ওঠে মুখে! ফুঁ করে মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়ার কাহিনি তো থাকেই! মানুষের নিঃশ্বাসগুলোও কুয়াশার মতো দলা পাকিয়ে উড়ে যায়। মিশে যায় ঘন কুয়াশার শরীরে! হাঁ… করে ছেড়ে চেয়ে থাকে খুব। দেখে তার শ্বাস কি করে ধোঁয়া হয়ে উড়ছে! কখনও কখনও সাদা রিঙ হয়ে মিলে যায় অন্য কুয়াশায়!
মানুষের নিঃশ্বাসে কুয়াশায় দারুণ বরকত!
শীত সকালে এমন করে ধোঁয়া ওড়ানোর প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আছে! ক’জন মিলে তো বটে! একাকীও কম যায়! নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা যেনো আরও আনন্দের! হু হু হা হা এই তো নিঃশ্বাসে ধোঁয়া তোলার কুশলিক শব্দ! এসব শব্দ সহসা বেরিয়ে আসে মনের গহিন থেকে। আনমনেও। এতেও শীতের আনন্দ আছে। সুখ আছে। আছে উদযাপনের আয়োজন!
চিতৈ পিঠার ঘ্রাণ মুখর করে চারিদিক। গরম গরম পিঠার আয়োজন। সর্ষে ভর্তা, ধনে পাতা আর শুঁটকি ভর্তায় জড়িয়ে মুখে পুরার আনন্দটা উপভোগ করার সুযোগ হাত ছাড়া করে কে! মাঠের কোণে, রাস্তার বাঁকে অথবা কোনো বৃক্ষের তলায় জ্বলতে থাকে উনুন। মাটির চুলা। গাছের লাকড়ি। ধোঁয়া আর আগুনের মিশেলে এক প্রকার উত্তাপ। মাটির খোলায় চিতৈ পিঠার লোয়াজিমা। চুলার চারপাশে অপেক্ষায় থাকা চোখ। আহা এই তো বাংলাদেশের শীতগাঁয়ের সকালছবি!
শীত আনে নানারঙ সবজির পসরা! কী যে তরতাজা! কী যে রাঙা! কত পদ। কত ধরন! কত রকম! দেখতে নান্দনিক! খেতেও সুস্বাদু!
খেজুর রসের মর্তবা কী বলি! রস তো বড় রসালো! মিষ্টি! চিনির মিষ্টি কিন্তু নয়! মধুরও নয়! রসের মিষ্টি রসের মতোই। রঙ চোখের পানির মতো। কখনও কিছুটা ঘোলাও হয়! কাঁচারস খাওয়ার মুহূর্তটি মনে করা যাক! কী তীব্র এক অনুভূতি। স্বাদ আলাদা। পানির মতো ঢকঢক গেলা। খাওয়া শেষ তো তৃপ্তির একটি ঢেকুর হঠাৎ শব্দ ছেড়ে মিলিয়ে যায় বাতাসে।
আগুনের তাপে রস জাল দিলে রাব হয়! রাবের রঙ কালো, মেরুণ এবং কিঞ্চিৎ সফেদও হয়। গাঢ় রঙের রাবের স্বাদ কিন্তু রস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
শীতে গাছগাছালি নির্জীব হয়ে ওঠে। ঝরতে থাকে গাছের পাতা। এক সময় পল্লবহীন শীর্ণ বৃক্ষ দাঁড়িয়ে থাকে বসন্তের অপেক্ষায়। শীতে কেনো পাতা ঝরে! কেনো খালি হয় বৃক্ষের ডালগুলো! পুরনো সব নিয়ে নতুন কিছুর জন্য প্রস্তুত করে কি শীত! হয় তো তাই। শীত না ডাকলে কি করে বসন্ত আসবে। কি করে ডেকে উঠবে কোকিল-কণ্ঠ!
শীত পালিয়ে গেলেই বসন্ত নামে। ডালে ডালে নতুন পাতা। নতুন ফুলের ঘ্রাণ! নতুন কোকিলের গান। বনান্তরে পাখির নতুন কাকলি। সুতরাং শীত পেরিয়ে গেলেই বসন্তের বাগান।
শীত বসন্ত আনে এ কথা ঠিক। কিন্তু কষ্টও কি কম আনে? গরিব দুঃখী অসহায় মানুষ ভীষণ কষ্টে পড়ে। কঠিন হয়ে ওঠে জীবন যাপন! অভাবের তোড়ে শীতকাপড় জোগাড় করা কী যে কঠিন কেবল টানাটানির সংসারই জানে।
তবুও বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুর আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্য আছে। নিজেকে চিনিয়ে দেয়ার আয়োজন আছে। ছয় ঋতুর ছয় পাখির উড়াল ভঙ্গি একদম আলাদা। ঋতুবৈচিত্র্যে জীবনেও ঘটে পরিবর্তনের রূপ!
শীত এলো! কুয়াশা এলো। শীত কুয়াশায় এলো জীবনের নতুন ধানুকি! উত্তরীয় বাতাসের আঁচে আসে শীত- কুয়াশার ময়ূরী। এ বাতাস যত গতি পায় শীতও ততোটাই জেঁকে বসে। এভাবেই কুয়াশায় মুড়িয়ে কনকনে হয়ে ওঠে শীতের শরীর!

Share.

মন্তব্য করুন