সোহানকে হামিদ সাহেব কিশোর বলে ডাকেন। দিনরাত কিশোর কিশোর বলে চিৎকার করেন। সোহান মাঝে মাঝে রাগ করে বলে, আমার নাম সোহান। তুমি আর কিশোর বলবে না।
হামিদ সাহেব মুখে হাসি নিয়ে বললেন, আট-দশ বছরের ছেলেকে কেউ যুবক বলে না। কিশোর বলে।
– বেশ, আশি বছরের বুড়ো মানুষকে আমি আর দাদু বলবো না। বুড়ো বুড়ো করে ডাকবো।
হামিদ সাহেব গালভরা হাসি দেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এই সোহান ছেলেটা তার একাকিত্বের অভাব দূর করছে। করোনার দীর্ঘ ছুটিতে সে প্রায় সারাক্ষণ হামিদ সাহেবের পাশেই ছিল। দাদুর সাথে তার গল্পের যেন শেষ নেই। দীর্ঘ দেড় বছর পর স্কুল খুলেছে। পরীক্ষা হবে। দীর্ঘদিনের রেশ কাটিয়ে এ এক আনন্দ উৎসব। স্কুল খোলায় হামিদ সাহেবের আনন্দ যেমন আছে একটা লুকানো কষ্টও আছে। সোহানকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট। সোহান সারাদিন স্কুল নিয়ে ব্যস্ত, রাতে পড়াশোনা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নামার পরে সোহান হাজির হয়। কাল স্কুল বন্ধ দাদু আজ খুব মজা হবে।
হামিদ সাহেব হাসেন, আজ তোকে বিজয়ের গল্প শোনাবো।
– বেশ শুরু কর দাদু।
হামিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করেন, শোন আমি ছিলাম কমান্ডার। তেত্রিশ জনের একটা ছোট দল।
তখন তো আর মোবাইলের যুগ ছিল না। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি।
– হু।
– প্রায় সবাই বাড়িতে বলে এসেছিল, একটা দেশ নিয়ে ফিরবো অথবা ফিরবো না। একদিন গভীর রাত। তখন তো ঝোপঝাড় সবদিকে। রাস্তার অবস্থা এই খাল-বিল, এই রাস্তা।
সোহান হাসে। তারপর?
– সকালের আলো আসার আগেই বর্ডার পেরিয়ে পৌঁছে যাই ভারত। মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর পর মালদাহর গোরবাগানে তেরো-চৌদ্দ দিন চলে লেফট রাইট। সেখান থেকে শিলিগুড়ির পানিঘাটায় এক মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়। তরঙ্গপুরের কালিয়াগঞ্জে চলে ভারী অস্ত্রের ট্রেনিং, যুদ্ধের কলাকৌশল। এক নোঙরে হাজার হাজার মানুষের সমাগম, খাওয়া। ২টার খানা মিলত ৪টায়।
– তোমার তো অনেক কষ্ট হতো দাদু।
– আরে কিসের কষ্ট! মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, আমার দেশ ও মানুষের মুক্তি।
জীবনের মায়া ত্যাগ করেই চলে আমাদের গেরিলা কার্যক্রম। আমরা অপারেশন করি সাত নম্বর সেক্টরের লালপুর, ভেড়ামারা, সুজানগর, ঈশ্বরদী প্রভৃতি এলাকায়। সারাদিন ইনফরমেশন, রাতে চোরাগোপ্তা হামলা করাই ছিল আমাদের কাজ।
– যুদ্ধের ট্রেনিং কেমন হয়েছিল দাদু? মাঝখানে প্রশ্ন করে সোহান।
– ট্রেনিং মানে একেবারে গেরিলা ট্রেনিং।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার সময় হামিদ সাহেবের চোখ দুটো চকচক করে। মুখে থাকে খুশির আভা।
একদিন একটা ছেলে ঠিক তোর বয়সী হবে।
– হু।
ক্যাম্পে এসে বলে, আমি যুদ্ধ করতে চাই।
ছোট ছেলে বলে ওকে আমার কাছে পাঠায়।
– কী নাম তোমার।
-আমার নাম কিশোর।
– তুমি তো বয়সেও কিশোর। তা কী বলতে চাও?
ছেলেটা কী আস্থা আর সাহসী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল জানিস?
– না।
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। বিজয়।
– তারপর?
কিশোর বলে, আমি যুদ্ধ করতে চাই।
আমি বলি, তুমি ছোট মানুষ। যুদ্ধ পারবে না।
কিশোর বলে, সে যদি নাই পারি আপনাদের পিছু পিছু ঘুরতে তো পারবো।
নাছোড়বান্দা। একটা গল্প বলা শুরু করে, এক রাতে তার মাকে তুলে নেয়ার গল্প।
– কিভাবে তুলে নিলো দাদু?
বলছি শোন। কিশোর তখন ঘুমিয়ে ছিল। মায়ের তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে বাড়ির বাইরে থেকে শব্দ আসছে। মেঝেতে পড়ে আছে পিতার রক্তাক্ত লাশ। শরীর কেঁপে ওঠে কিশোরের। ছোট মানুষ নিজেকে সামলে যতক্ষণে বাইরে যায় ততক্ষণে তার মাকে নিয়ে চলে গেছে। কিশোর জানতে পারেনি তার মায়ের অবস্থা।
– আজও জানে না?
হামিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, সেটা আমি বলতে পারবো না।
– তারপর?
– পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল রাজাপুরের মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল। সেখান থেকেই তারা অপারেশন চালাত।
নভেম্বরের প্রথম দিকে প্রধান প্রধান সড়ক পথগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
– কিভাবে!
– অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম বড় বড় ব্রিজগুলো।
– ওরা আসতো কিভাবে?
– ওই যে বললাম, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা সিদ্ধন্ত নিলাম, এবার ওদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটিতে আক্রমণ করবো।
– রাজাপুরের মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে?
– হু।
– আচ্ছা।
– সেদিন অমাবস্যার ঘন কালো অন্ধকার রাতে আমরা তিন দলে ভাগ হয়ে ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাই।
– সেই ছেলেটা…
– কিশোর?
– হু।
– ও তো সবসময় আমার সাথে সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতো।
– সেদিনও ছিল?
– ছিল, তবে আমরা আক্রমণ শুরু করার পর ওকে আর দেখিনি।
– আচ্ছা।
– আমরা আক্রমণ শুরু করতেই ওরা ভেতর থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। তিনতলা বড় বিল্ডিং। আমাদের ধারণা ছিল ওরা বেরিয়ে আসবে। সেটা না করে ওরা বিল্ডিংয়ের দোতলা, তিনতলা, ছাদ থেকে নিচে গুলি ছোড়ার উৎস চিহ্নিত করে হামলা করছিল। ওদের সুবিধাজনক অবস্থায় আমরা কিছুটা পিছনে সরে আসতে বাধ্য হই। পঁয়তাল্লিশ মিনিট গোলাগুলোর পর হঠাৎ অবাক করা ঘটনা ঘটে যায়।
কী!
নিচতলায় কয়েকটা গুলির শব্দ। আর্তনাদ। তারপর বিকট বিস্ফোরণ। একটা প্রথমে তারপর একটার পর একটা বিস্ফোরণ হতে থাকে। কয়েক মিনিটে পুরো বিল্ডিং ধসে পড়ে। ভেতর থেকে প্রথমে আর্তনাদ এরপর সুনসান নীরবতা।
সোহান বড় বড় চোখ করে দাদুর দিকে তাকিয়ে বলে, তারপর!
– ওদের সলিল সমাধি ঘটে যায়।
– এটা কিভাবে হলো দাদু?
– ওই যে কিশোর। ও গিয়েছিল চুপিচুপি। গোলাগুলির ভেতর চুপটি করে নিচতলায় ঢুকে প্রথমে হত্যা করেছিল গুলাবারুদ রক্ষার দায়িত্বে থাকা লোকদের। তারপর সেখানে মাইন বিস্ফোরণ ঘটায়। মাইনের সাথে ওদের অস্ত্রাগারে থাকা বিস্ফোরকগুলো একে একে বিস্ফোরিত হয়। মাটির সাথে মিশে যায় পুরো ভবন।
– এটা যে কিশোর করেছে কিভাবে বুঝলে দাদু?
দাদুর চোখটা অশ্রুসিক্ত হয়। ভারী গলায় বলেন, ক্যাম্পে ফিরে ক্লান্ত দেহে যখন ঘুমাতে যাব, দেখি বালিশের নিচে একটা কাগজ। খুলে দেখি কিশোরের কাঁচা হাতের লেখা, স্যার আমি যদি আজ হারিয়ে যাই কষ্ট পাবেন না। আমি আমার মাকে নিয়ে একদিন ঠিকই ফিরে আসবো।
– এসেছিল?
– না, আসেনি এখনো। আসেনি বলেই আমি তোর ভেতর কিশোরকে খুঁজি।
ফাহিমের চোখ দুটো চকচক করে। সাহসী গলায় বলে, আমি ভয় পাবো না। অনেক বড় হবো। দাদু তুমি দোয়া কর, আমি তোমার একাত্তরের সেই ছেলেটা। কিশোর।
কথা শেষ করেই ফাহিম কেন যেন চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। হামিদ সাহেব ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফাহিমের ভেতর খুঁজে পান কিশোরের প্রতিচ্ছবি।

Share.

মন্তব্য করুন