গ্রামের শেষ মাথায় নদীর ধার ঘেঁষে হাঁটছিল ওরা। ওরা মানে ছোট্ট দু’টি মেয়ে। বেলী আর জুঁই। এটা ওদের ভোর বেলায় রোজকার কাজ। নদীর ধার দিয়ে আর ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়গুলোর কোল ঘেঁষে। নদীর ধার আর পাহাড়ের কোল ঘন কুয়াশার হয়ে যায়। একেক সময় মেঘের দেশ বলে মনে হয় ওদের। এরই মধ্যে জুঁই বেলী দেখলো কুয়াশাঢাকা পাহাড়গুলোর পেছন থেকে কারা যেন বেরিয়ে এলো। আজ ক’দিন ধরেই হচ্ছে এরকম।
পেঁজাতুলো মেঘের মতো ধবধবে সাদা ওদের পোশাক…আর চাঁদের আলো মাখা ওদের রঙ।
জুঁই বেলীকে বলল-
: এরা কারা বল তো?
বেলী বলল-
: বারে তুই যা দেখছিস আমিও তা দেখেছি। আমি কি করে বলব এরা কারা।
জুঁই মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল-
: তাও তো বটে-

এক সময় এরা দেখলো তুলোট মেঘের মানুষগুলো নদীর ধারে একটা বুড়ো গাছের শিকড়ের ওপর বসলো। ওরা ছিল তিনজন। ধীরে ধীরে ওদের কাছে এসে দাঁড়ালো জুঁই বেলী। চারদিক দিয়ে ঘুরে ঘুরে খুব ভালো করে দেখলো ওদেরকে।
তারপর একসময় জিজ্ঞেস করলো-
: কে তোমরা? কোথা থেকে এলে? তোমরা কি মেঘের দেশের কেউ-
একটু হাসলো আগন্তুকরা।
ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন বলল-
: আমি মেঘের দেশের শাহজাদা। আর ওরা আমার বন্ধু, কিন্তু তোমরা?
অবাক হলো জুঁই-বেলী।
গালে হাত দিয়ে দু’চোখ বড় বড় করলো জুঁই।
বলল-
: অমা-সে কি? সত্যি তুমি মেঘের দেশের শাহজাদা। স্বপ্ন নয়তো…
: আরে না না।
হাসলো শাহজাদা। বলল-
: মেঘের দেশের নাম তোমরা শুনছো কিনা জানি না। কিন্তু আমরা আছি। আছি তোমাদের খুব কাছাকাছি।
দুই পা এগিয়ে এলো বেলী ঝট করে।
বলল-
: খুবই কী কাছাকাছি?
: একেবারে কাছাকাছি। একটু ছুঁয়ে দেখব কি?
বেলীর উচ্চকিত প্রশ্ন শুনে অমায়িক হাসলো কিন্তু কিছু বললো না।
চোখের পলকে হাওয়ায় মিশে গেল ওরা।
বিস্মিত হলো জুঁই, বেলী। সত্যি তো?
: গেল কোথায় মেঘের দেশের শাহজাদা আর ওর বন্ধুরা…? কিছু বলেও গেল না।

চারদিকে কুয়াশা কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে।
মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলো দুই বোন জুঁই, বেলী। কাউকে কিছু বললো না ওরা। আর বললেই বা কি? বিশ্বাস করবে কি কেউ ওদের কথা।
জুঁই, বেলী অনেক কষ্টে অপেক্ষা করতে লাগলো পরদিন সকালের…।

পরদিন নিয়ম মতো ঠিকই সকাল হলো।
পাহাড়ের পাদদেশে আর নদীর পাড় ঘেঁষে তুলোট কুয়াশায় হালকা ঢেউ বয়ে গেল…।
তারপর…?
কালচে মেঘের আঁধার কেটে ফিকে হয়ে গেল পুবের আকাশটা। তারপর সূর্যোদয়।
গোলাপি আর হালকা কমলা রঙ এর ছটায় চারদিক উদ্ভাসিত করে দিয়ে উঁকি মারলো সূর্য মামা।
এতো রোজকার ঘটনা।
কিন্তু কালকের ঘটনার মতো আজ আর কিছু ঘটলো না তো।
: স্বপ্ন নয়তো।
: নানা স্বপ্ন হবে কেন? দু’জন কি একসাথে স্বপ্ন দেখতে পারে?
শিশুসুলভ ভাবনার কোন কূল-কিনারা নেই। কাজেই জুঁই, বেলীর বেলায়ও তাই হলো।
স্বপ্নের রাজপুত্তুর মেঘালয়ের শাহজাদার কথা ওদের মনে গেঁথে রইলো।

ওদিকে আকাশ পাড়ে মেঘের অনেক ঘনঘটা থাকলেও পৃথিবীতে তখন দারুণ খরা। মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির। কৃষকের ঘরে ফসল নেই। নদী নালা সব শুকিয়ে গেছে। কি নিদারুণ আকাশ চলছে পৃথিবী মাটিতে। ঘরে খাবার নেই। চারদিকে কেবলি হাহাকার। গ্রামবাসীরা দল বেঁধে করছে প্রার্থনা। শুধু একটু বৃষ্টি চাই। বৃষ্টি। ঘরে ঘরে কষ্টের যেন শেষ নেই। শুধু একটু বৃষ্টি হলেই যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

আজ ক’দিন ধরে আকাশের দিকে তাকালে মেঘালয়ের শাহজাদার কথা মনে পড়ে যায় জুঁই, বেলীর।
সারাক্ষণ মেঘের সমুদ্রের ডুবে থাকছে ওরা। কি এমন ক্ষতি? পৃথিবীতে একটু বৃষ্টি ঢেলে দিলে? এক অব্যক্ত অভিমানে থমথম করে উঠে জুঁই, বেলীর মন।
: কি হয় আর একবার দেখা দিলে?
: এতো কষ্ট আমাদের? এসব কিছুই কি দেখতে পায় না শাহজাদা…?

অনেক কথা ভাবতে ভাবতে শুকনো নদীটার পাশ দিয়ে হাঁটছিল জুঁই বেলী। তারপর এক সময় বুড়ো গাছটার নিচে বসলো ওরা।

কারো মুখেই কোন কথা নেই। দু’জনেরই মন খারাপ।
চারদিকে তখন বিকেল সন্ধ্যা নেমেছে। রোদের রঙটা একেবারেই হলদেটে আর নরম। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো দুই বোন। জুঁই আর বেলী।
: নাহ্ আর দেরি করা ঠিক হবে না। চলে আসছিল ওরা। হঠাৎ দেখলো গাছের ওপাশটা স্তূপীকৃত মেঘে ঢাকা।

বিস্মিত হলো জুঁই বেলী-আশ্চর্য! আজ একেবারে ঝোপঝাড়ে নেমে এসেছে মেঘের দল, এগুচ্ছিল ওরা। হঠাৎ যেন মেঘ সরে গেল একটু। আর আবছা করে দেখতে পেল সেই কাক্সিক্ষত হাসিমুখ- মেঘের দেশের শাহজাদা। সাথে সঙ্গীরা ছুটে কাছে গেল জুঁই বেলী। হাত ধরলো শাহজাদার।
বলল-
: আজ তোমাকে একদমই ছাড়ছি না। বল কোথায় ছিলে এতোদিন।
জ্ুঁই বেলীর কথায় হাসলো শাহজাদা। বলল-
: আরে থামো থামো ব্যাপার কি? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
: জুঁই চেঁচিয়ে উঠলো। হয়েছে না? তুমি তো কিছুই জানো না।
বেলী বলল-
: জানলে এতো দেরি করে আসতে না।
শাহজাদা বলল-
: আচ্ছা! অনেক সমস্যা হয়েছে তাহলে তোমাদের। এবার বল কি বলতে চাও।
জুই চেঁচিয়ে বলল-
: মেঘের সমুদ্রে বাস কর। একটু বৃষ্টিতো দিতে পারো।
এবার হো হো করে হেসে ফেললো শাহজাদার সঙ্গীরা।

একজন বলল-
: এর মানেটা কি-
অপরজন বলল-
: একটু বুঝিয়ে বল-
বেলী বিশদ বর্ণনা করলো।
বলল-
: দেশে এখন খরা। বৃষ্টির অভাবে ফসল হচ্ছে না ক্ষেতে। চারিদিকে এখন আকাল। আমরা সবাই দেশের মানুষ শেষ হয়ে যাচ্ছি। তুমি মেঘালয়ের শাহজাদা। একটা কিছু কর।

শাহজাদা চুপ করে কি যেন ভাবলো।
বেলী আবার বলল কম্পিত কণ্ঠে-
: আমরা ছোট্ট বলে আমাদের কথা কেউ শোনে না। তুমিও না।
বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে আদর করলো শাহজাদা।
বলল-
: আহা, রাগ করছো কেন? শোন ছোট্টদেরকে সবাই ভালোবাসে। সবাই ওদের কথা শোনে। এমন কি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও।
: সত্যি?

এক সাথে চিৎকার করে উঠলো দুজনেই, জ্ুঁই বেলী।
বলল-
: তুমি একদম ঠিক বলছো তো শাহজাদা?
শাহজাদা আবার বলল-
: দেশে বৃষ্টির অভাবে আকাল দেখা দিয়েছে। ঘরে ঘরে হাহাকার। তোমরা প্রাণ-ভরে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা কর বৃষ্টির জন্য। তিনি সব কিছু দেবার মালিক। অন্যের দুঃখে আমি শুধু পরামর্শ দিতে পারি। ছোটরা তোমরা হচ্ছো সৃষ্টিকর্তার বন্ধু। তোমাদের প্রার্থনা তিনি নিশ্চয় শুনবেন।
: সত্যি?

আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো জুঁই বেলী।
বলল-
: কি মজা কি মজা। আর আমাদের কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না? তাই না শাহজাদা?
শাহজাদা হেসে বলল-
: হ্যাঁ তাই। এখন তোমরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা কর সৃষ্টিকর্তার কাছে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
কথা শেষ হতেই চারদিকেই মেঘের পালক ছড়িয়ে হাওয়ায় মিশে গেল মেঘালয়ের শাহজাদা ও বন্ধুরা। যতোদূর চোখ যায় তাকালো জুঁই বেলী। কিন্তু কোথাও আর দেখা গেলো না ওদের।

পরদিন ভোর থেকেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে জড়ো হলো সবাই। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল চারিদিক। মাথায় ওপরে সূর্যটা ভোরের কোমলতা হারিয়ে তেজোদীপ্ত হয়ে উঠলো রোজকার মতো।
চিড় চিড় করে ফাটতে লাগলো মাটি…। শীর্ণ হয়ে আসতে লাগলো নদীর ধারা। স্তব্ধ বাতাস। গাছের একটি পাতা পর্যন্ত নড়লো না।

সবাই মিলে দু’হাত তুলে আকুল হয়ে একফোঁটা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা জানালো। সকাল থেকে সন্ধ্যো পর্যন্ত। এই প্রার্থনার যেন কোন বিরতি নেই কোন ক্লান্তি নেই…।

জুঁই বেলীর বারবার মনে পড়তে লাগলো মেঘালয়ের শাহজাদার কথাগুলো।
শাহজাদা বলেছিল, “ছোটরা ঈশ্বরের বন্ধু। তিনি ছোটদেরকে ভীষণ ভালোবাসেন। ছোটদের প্রার্থনা তিনি সব সময় শোনেন।”
আসলেও তাই-
আর তা না হলে এতো সাহস আর মনোবল আসবে কোত্থেকে?

এইভাবে প্রার্থনা রত অবস্থায় সারাটা দিন আর রাতও শেষ হলো এক সময়। গ্রামের বড়রা অনেক ডাকাডাকি করেও দমাতে পারলোনা এতোগুলো বাচ্চাকে। কেউ কেউ বলতে লাগলো-গরিবের কান্না কেউ শুনতে পায় না। এমন কি ঈশ্বরও না।

পরদিন ভোর বেলা সূর্য মামা তখন উঠি উঠি করছে…।
কিন্তু ঠিক বেরিয়ে আসতে পারছে না। কোথায় যেন…কি যেন একটা অসুবিধা হয়েছে।

তাইতো…। তাইতো…।
গত রাতের ঝকঝকে তারাজ্বলা আকাশে এতো মেঘ জমলো কখন…?
বেলা বাড়ার সাথে বেড়ে গেল মেঘের ঘনঘটা।
দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে…।

কখনো বুনো হাতির মতো শুঁড় উঁচিয়ে কখনো সিংহের মতো কেশর ফুলিয়ে আবার কখনো শেয়ালের মতো ঘাড় উঁচিয়ে।
কিন্তু আসলে কি…? এতো বিচিত্র রূপ ঐ মেঘালয়ের বাসীন্দাদের…?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলো না ওরা। পারলো না ওরা এতোগুলো বাচ্চার আকাক্সক্ষাকে উপেক্ষা করতে।
সৃষ্টিকর্তা ছোটদের সত্যি ভালোবাসেন আর সেই জন্যই ঘটলো এমন ঘটনা।

একসময় চারিদিক অন্ধকার করে ঝড়ো করে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো এধার থেকে ওধার পর্যন্ত। উড়তে লাগলো খড়কুটো আর শুকনো পাতা। চঞ্চল হয়ে উঠলো শীর্ণ নদীর পানি।
ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে এলো গ্রামের মানুষ।
আর ওদিক…?
পাহাড়ের পাদদেশে জটলা পাকিয়ে দু’হাত তুলে তখনো বৃষ্টিকে ডেকে চলেছে বাচ্চাগুলো।

বৃষ্টি আয় আয় রে
মেঘের পাহাড় গড়ে নিয়ে
আছিস আকাশ ঢেকে
সব বাধাকে সরিয়ে তুই
আয় বৃষ্টি ঝেপে
বৃষ্টি আয় আয়রে॥

তারপর…?
তারপর আর কি?
ইলশেগুঁড়ি নয়, টিপটিপও নয়, একেবারে বর্ষণ শুরু হলো অঝোর ধারায়। মাঠ ঘাট কৃষাণের ক্ষেত সব-সবকিছুকে ছাপিয়ে চললো শান্তির বর্ষণ।

সবাই জানলো অসম্ভব শক্তিধর এই শিশুরা।
শিশুরা সত্যি সৃষ্টিকর্তার বন্ধু। ওরাই পারে পৃথিবীটাকে বদলে দিতে।

ওদিকে জুঁই আর বেলী ভাবলো…
আর একবার যদি দেখা পেতো মেঘের দেশের শাহজাদার
… খুব ভালো লাগতো।

Share.

মন্তব্য করুন