সম্প্রতি বিশ্বের সেরা ধনী ব্যক্তি অ্যামাজনের প্রধান জেফ বেজোস মহাশূন্যে বেড়িয়ে এলেন। করোনাকালে তার এই ব্যয়বহুল পর্যটন নিয়ে সারা বিশ্বে প্রশংসা ও সমালোচনা দুটোই হয়েছে। অবশ্য তিনিই বিশে^র প্রথম মহাশূন্য পর্যটক নন। তার আগে বহু ব্যক্তি অর্থ ব্যয় করে মহাকাশে বেড়াতে গেছেন। তবে তিনি যেহেতু এ মুহূর্তে বিশে^র সেরা ধনী তাই তাকে নিয়ে আলোচনাটা একটু বেশি। তিনি মাত্র ১০ মিনিট ১৪ সেকেন্ড মহাশূন্যে কাটিয়েছেন। গেছেন গ্র্যাভিটি লাইন অতিক্রম করে, যেখানে ঠিক পৃথিবীর মতো আবহাওয়া নয়। গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ রেখা যার নাম কারম্যান লাইন পার হয়ে মহাকাশে গেলে তার ধরন যেমন আলাদা, আবহাওয়া আলাদা। সেই সাথে রোমাঞ্চও আলাদা। পৃথিবীটা যে গোল সেটা ৫০ থেকে ৭০ মাইল উপরে গেলেই দেখা যায়। তার বৃত্তাকার রেখা তখন স্পষ্ট দেখা যায়। এছাড়াও পৃথিবী থেকে আমরা আকাশের রঙ দেখি নীল। কিন্তু আকাশ নীল নয়।

পৃথিবীতে যে আলো এসে পড়ে তার সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের মিশ্রণে সেই নীল রঙ তৈরি হয়। যেই মুহূর্তে কেউ বায়ুমণ্ডলের উপরে চলে যাবেন ঠিক তখনই দেখতে পাবেন যে আকাশ হচ্ছে কালো। মহাশূন্যে ভ্রমণকারী প্রথম পর্যটক হলেন ডেনিস টিটো। তিনি তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন : ‘ও ধিং বঁঢ়যড়ৎরপ’। ব্যবসায়ী টিটো এজন্য ব্যয় করেন দুই কোটি ডলার। বাংলাদেশী টাকায় কত হবে? হিসাবটা না হয় বের করে নাও তোমরাই। তিনি এই অর্থ ব্যয় করে ২০০১ সালে রুশ নভোচারীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশনে যান। তিনি সেখানে ৮ দিন কাটান। এখনো এই ঘটনার ২০ বছর পরও তিনি বলেন, সেটা ছিল তার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা অর্জন। ২০ বছর পর আবারো স্পেস ট্র্যাভেলের খাতায় নাম লেখালেন দু’জন। তবে অ্যামাজনের প্রধান জেফ বেজোসের সফরই নাম করেছে বেশি। ব্রিটেনের স্যার রিচার্ড ব্রানসন মহাকাশে যান গত ১১ জুলাই আর বেজোস তার ভাইসহ মোট ৪ জন যান ২০ জুলাই। তারা দু’জনেই গেছেন নিজ নিজ অ্যারোস্পেস কোম্পানির রকেটে চড়ে। সেই কাহিনীই বলবো।

জুলাই মাসটা মনে হয় মহাশূন্য অভিযানের একটি উৎকৃষ্ট সময়। মনে আছে কি অ্যাপোলো ১১-এর চাঁদে প্রথম অভিযানের কথা? তোমাদের মনে থাকার কথা নয়। সেটা ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে। বইতে নিশ্চয়ই পড়ে থাকবে সে কাহিনী। এ নিয়ে সারা বিশ্বে টান টান উত্তেজনা ছিল, এবার বেজোসের সফর নিয়ে যেমনটা হয়েছে। অ্যাপোলো ১১ প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশ অভিযান, যা চাঁদে অবতরণ করে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই তারিখে এই অভিযানের সূচনা হয়। এই অভিযানে অংশ নেন দলপতি নীল আর্মস্ট্রং, কমান্ড মডিউল চালক মাইকেল কলিন্স এবং চান্দ্র অবতরণযানের চালক বাজ অলড্রিন। ২০ জুলাই তারিখে আর্মস্ট্রং ও অলল্ড্রিন প্রথম মানুষ হিসাবে চাঁদে পা রাখেন। আবার সেই ২০ জুলাই। ভাবতে অবাক লাগে তাই না। হ্যাঁ, অ্যাপোলো ১১ এর প্রতি সম্মান জানাতেই জেফ বেজোস বেছে নেন এই দিনটি।
স্বপ্ন দেখতে ও তা পূরণে অর্থ ঢালতে কার্পণ্য করেন না ধনীরা। বেজোসও ব্যতিক্রম নন। স্বপ্ন ছিল মহাকাশে যাবেন। সেই স্বপ্ন পূরণে নিজের কোম্পানি গড়েছেন। সেই কোম্পানি বানিয়েছে রকেট। নিজের কোম্পানির বানানো রকেটে চড়ে ২০ জুলাই ঘুরে এলেন মহাকাশে। ফিরে এসে বেজোস বললেন, এটা খুবই আনন্দদায়ক একটি অভিজ্ঞতা। এটা জীবনের সেরা দিন। একই কথা বলেছিলেন ২০ বছর আগে মহাকাশে যাওয়া প্রথম পর্যটক টিটো।

ব্লু অরিজিনের যাত্রা শুরু

মহাকাশ নিয়ে বেজোস স্বপ্ন দেখেছিলেন বেশ আগেই। বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যৎ বিশ্বে মহাকাশ ব্যবসাটা বেশ জমে উঠবে। সময়টা ২০০০ সাল। স্বপ্ন পূরণে ব্যবসায়ী বেজোস গড়ে তুললেন মহাকাশ সংক্রান্ত কোম্পানি ব্লু অরিজিন। শুরু থেকেই মহাকাশ যাত্রাকে তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল করতে উদ্যোগী হয় কোম্পানিটি। মহাকাশ পর্যটনকে জনপ্রিয় করতে ব্লু অরিজিনের মাধ্যমে কাজ শুরু করেন বেজোস। ২০১৯ সালে বেজোস জানান, ২০২৪ সালের মধ্যে চাঁদে নতুন করে মানুষ পাঠাবে ব্লু অরিজিন। একই সঙ্গে তিনি নিজেও মহাকাশে ভ্রমণ করবেন বলে জানান। সেই থেকে চলছিল প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে ব্লু অরিজিন মহাকাশে মানুষ নিতে বানিয়ে ফেলেছে বিশেষ রকেট নিউ শেপার্ড। এই রকেটে চড়েই মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ করেছেন বেজোস। এর দ্বারা এবারই প্রথম কোনো ক্রু ফ্লাইট পরিচালনা করা হলো।
মহাকাশ পর্যটনের জন্য ক্রমবর্ধমান বাজারের চাহিদা পূরণের জন্যই নিউ শেপার্ড এর নকশা করা হয়েছে। মি. বেজোস এবং তার ‘বিলিয়নিয়ার স্পেস রেস’-এর অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা অবশ্য এর জন্য কিছুটা সমালোচনার মুখেও পড়েছেন। অনেকে এটাকে কিছু অতি-ধনীদের আনন্দ ভ্রমণ হিসেবে দেখছেন। সমালোচকরা বলছেন, এই অর্থ কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যয় করা যেত। তবে মি. বেজোস জোর দিয়ে বলেছেন যে তার একটি পরিবেশগত পরিকল্পনাও রয়েছে। আমেরিকার প্রথম নভোচারী অ্যালান শেপার্ডের নামে নিউ শেপার্ড নামকরণ করা হয়। এর আগে ১৫ বার পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করেছে নিউ শেপার্ড। একটিতেও অবশ্য যাত্রী ছিল না।

কোথায় গেছেন তারা?

বেজোসের স্বপ্ন পূরণের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল ২০ জুলাই ২০২১, আগেই বলেছি। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম টেক্সাসের ভ্যান হর্নের নিজস্ব উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে সকাল ৯টা ১২ মিনিটে বেজোস ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে নিউ শেপার্ড রকেট মহাকাশের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করে। মহাকাশ যাত্রায় বেজোসের সঙ্গী হয়েছেন আরও তিনজন। উৎক্ষেপণের পর প্রায় ৭৬ কিলোমিটার গিয়ে তাঁদের বহনকারী ক্যাপসুলটি রকেট থেকে আলাদা হয়। পরে উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ২ মাইল দূরে রকেটটি নিরাপদে নেমে আসে। আর ক্যাপসুলটি বেজোস ও তার সঙ্গীদের নিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশের সীমানা টানা কারমান লাইন অতিক্রম করে। ১০৭ কিলোমিটার বা ৩ লাখ ৫০ হাজার ফুট ওপরে উড়ে যায় সেটি।
তারা এমন একটি ক্যাপসুলে করে এই ভ্রমণ করেছেন যার জানালাগুলো বড় থাকায় পৃথিবীর চমকপ্রদ দৃশ্য উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন। পরিভ্রমণ শেষে মাত্র ১০ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের মাথায় ক্যাপসুলটি নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসে। ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে জেফ বেজোস আনন্দে চিৎকার করে বলেন: ‘সেরা দিন! আমার জীবনের সেরা দিন।’ তাঁরা সেখান থেকে পৃথিবীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করেছেন। তিনি আগেই বলেছিলেন ‘আমি সারা জীবন মহাকাশে এভাবে উড়তে চেয়েছি। এটি একটি দুঃসাহসিক কাজ এবং আমার জন্য অনেক বড় কিছু।’ বাস্তবেও তাই হয়েছে।

উড্ডয়নের দুই মিনিট পরে ক্যাপসুলটি তার রকেট থেকে আলাদা হয় কারম্যান লাইনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে- এটি মহাকাশের সীমানা হিসেবে স্বীকৃত এবং এটি পৃথিবী থেকে ১০০ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত। এ সময় মহাকাশে যাওয়া নভোচারীরা আনন্দে চিৎকার করে উঠেন ‘ওয়াও!’ ফ্লাইটের পরে ব্রিফিংয়ে চার মিনিটের ওজনহীনতার সময় ক্যাপসুলে থাকা আরোহীরা ডিগবাজি খাচ্ছেন, উল্টে পড়ে যাচ্ছেন- এমন একটি ভিডিও দেখানো হয়। সেখান থেকে পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য দৃশ্যগুলোও দেখা যাচ্ছিল। জেফ বেজোস বলেন, মাইক্রোগ্র্যাভিটির সংবেদন দেখে আমি অবাক হয়েছি। তবে খুবই স্বাভাবিক অনুভব করছিলাম। মিস ফাঙ্ক বলেন: ‘এটি দুর্দান্ত ছিল, খুব ভালো লেগেছে, আবার যাওয়ার জন্য তর সইছে না আমার।’
উড্ডয়নের পর প্রায় ৪৭ মাইল ওপরে গিয়ে বুস্টার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রকেটের যাত্রীবাহী অংশটি। এরপর নভোচারীরা আসন থেকে নিজেদের মুক্ত করেন। সে সময় মিনিট তিনেকের জন্য ভরশূন্যতার অভিজ্ঞতা নেন তাঁরা। এরপর পৃথিবীর পানে ফিরতি পথে যাত্রা শুরু।

Share.

মন্তব্য করুন