বাগদাদে সেলজুক সুলতানদের শাসনামলে (১০৩৭-১৩০০ খ্রি.) মহামতি সুলতান নিজামুল মুলক (১০১৭-১০৯২ খ্রি.) নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার হিসেবে এবং যশ-খ্যাতি ও সমৃদ্ধির দিক থেকে এই গ্রন্থাগারের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। সুলতান নিজামুল মূলক ছিলেন বিদ্যোৎসাহী একজন ধর্মপ্রাণ শাসক। জ্ঞান-গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম। তৎকালীন দুনিয়ার সেরা বিদ্যাপীঠ ‘নিজামিয়ার’ প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘দরসে নিজামী’-এর প্রবক্তা সুলতান নিজামুল মূলক রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এর মধ্যে বেশকিছু গ্রন্থাগারও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি নিজেই এগুলো তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে ৩০ বছরের অধিককাল দেশ ও জ্ঞানের সেবা করেন। ধর্মীয় ব্যাপারে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করতেন বলে তিনি একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বাগদাদের ‘দারুল খোলাফা’-কে (রাজদরবার) ধর্মীয় বিশ্বাসবিষয়ক মতবিনিময় কেন্দ্রে পরিণত করবেন। সেটি বাস্তবায়িত না হলেও পরবর্তীতে তিনি বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে মুসলিম বিশ্বের বড়ো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেন। এর পাশাপাশি খোরাসান, দিল্লি, ইরান এবং ইরাকের বিভিন্ন শহরেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কুরআন, হাদিস, ফিকহ্, দর্শন, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় সেখানকার পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে তার সাথে যুক্ত হয় উসুলুল ফিকহ্, তাফসির, ইলমে কালাম, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্যসহ আরো অনেক নতুন নতুন বিষয়। নিজামুল মূলকের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সমসাময়িক কালের অন্যতম সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারে পরিণত হয়। তিনি সরকারি অনুদান ছাড়াও নিজের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করতেন। প্রখ্যাত সংস্কারক ও দার্শনিক ইমাম আল গাযালী (১০৫৮-১১১১ খ্রি.) তার অনুরোধে নিজামিয়া মাদ্রাসায় চার বছরকাল শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। নিজামুল মুলক এ গ্রন্থাগারে প্রচুর বইপত্র দান করেছিলেন। বইপত্র ক্রয় এবং নানা উৎস থেকে জমা হওয়া গ্রন্থ সম্পদ এই লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করেছিল। অনেক সুধী ব্যক্তি এখানে গ্রন্থ দান করে যেতেন। ঐতিহাসিক ইবনুল আসিরের মতে, ঐতিহাসিক মুহিউদ্দীন ইবনু নজর আল বাগদাদি (মৃত্যু ১২৪৫ খ্রি.) নিজামিয়া গ্রন্থাগারে প্রচুর বইপত্র দান করেছিলেন। গ্রন্থাগারটির ভাগ্যে বিভিন্ন সময় দুর্যোগ নেমে আসে। ১১১৬ খ্রিস্টাব্দে এক মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের কবল থেকে বইগুলো ভাগ্যক্রমে রক্ষা পায়। গ্রন্থাগারটি অন্যত্র স্থানান্তর করার ফলে ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়। খলিফা আল নাসির এ গ্রন্থাগারের জন্য একটি নতুন ভবন নির্মাণ করে দেন। এর ফলে নিজামিয়া গ্রন্থাগার মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও মূল্যবান গ্রন্থাগারে পরিণত হয়। জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরাই এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হতেন। ১০৯৬ সালে ইমাম গাযালী যখন এ প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন তখনও এখানে তিন হাজারেরও অধিক ছাত্র ছিল। পারস্যের বিখ্যাত কবি শেখ মুসলেহ উদ্দীন, যিনি শেখ সাদী নামে বিশেষ পরিচিত, তিনি ১১৯৫ থেকে ১২২৬ সাল পর্যন্ত এখানে শিক্ষা লাভ করেন। এখানে ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে যুক্তি-তর্কের আসর অনুষ্ঠিত হতো। এই প্রতিষ্ঠানটিকে মধ্যযুগের সবচেয়ে বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গ্রন্থাগারটির প্রশাসনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ইতিহাসের অংশবিশেষ এখনো সংরক্ষিত আছে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যোৎসাহী সুলতান নিজামুল মূলক সাম্রাজ্যের আরো বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠঅন ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিশাপুর শহরের ওপর তার বিশেষ দৃষ্টি থাকার কারণে এই শহরটিও জ্ঞান ও বিজ্ঞানে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম, ইমাম মোয়াফফাক নিশাপুরী, ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনি, আত্তার নিশাপুরী প্রমুখের মতো জগদ্বিখ্যাত মনীষীগণ এই নিশাপুরেই গড়ে ওঠেন। অসংখ্য মনীষী থাকার কারণে এই নিশাপুরেও একটি নিজামিয়া মাদ্রাসা ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই নিজামিয়াতেও অসংখ্য স্বনামধন্য মনীষী শিক্ষকতার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। মানের দিক থেকে নিশাপুরের নিজামিয়াটিকে বাগদাদের পরই স্থান দেয়া হয়। ইস্ফাহানেও তার নির্দেশে নিজামিয়া বিদ্যাঙ্গন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক নামকরা জ্ঞানী-গুণী মনীষী শিক্ষকতা করেছেন। যাদের মধ্যে আবু বকর মুহাম্মদ বিন সাবেত খোজান্দী এবং ফকরুদ্দীন আবুল মা’আলী আল-হাসান ইবন মুহাম্মদ আল-বিরকানির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই মহান প্রতিষ্ঠানটির কারণে ইস্ফাহান অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল।
মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা বাগদাদের একটি ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতানসির (১২২৬-৪২ খ্রি.) এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। এ গ্রন্থাগারে প্রাথমিককালেই প্রায় ৮০,০০০ গ্রন্থ ছিল। খলিফা নিজেই এগুলো দান করেন। বলা হয় যে, সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় ৪,০০,০০০ এ উপনীত হয়েছিল।

নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে মুসতানসিরিয়া গ্রন্থাগারের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। খলিফা আল-মুস্তানসিরের উত্তরাধিকারীরা নতুন নতুন গ্রন্থ সংগ্রহে আত্মনিয়োগ করেন। ফলে এক শতাব্দীকাল পরে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী যখন বিজয়-গৌরবে ফাতিমিয়া প্রাসাদে প্রবেশ করেন, তখনও তাতে লক্ষাধিক গ্রন্থের সংগ্রহ তিনি দেখতে পান। মোঙ্গল নেতা হালাকু খাঁর বাগদাদ আক্রমণের সময় এটি রক্ষা পেলেও তিনি মুসতানসিরিয়ার অধিকাংশ গ্রন্থ নিজ রাজধানী মারাগায় নিয়ে যান। তার অনুরাগভাজন বিজ্ঞানী নাসির উদ্দীন আল তুসীর গ্রন্থাগারে এ মূল্যবান সংগ্রহের অনেকটা স্থান পায়। ১৩৯৩ সালে এটি নিজামিয়া মাদ্রাসার সাথে একীভূত হয়। ১৫৩৪ সালে উসমানীয়রা বাগদাদ দখল করলে প্রাসাদ ও গ্রন্থাগারের বইগুলো যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়। এগুলো ইস্তানবুলের রাজকীয় গ্রন্থাগারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে এবং মুসতানসিরিয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে নতুন ভবনে মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসার কার্যক্রম আবার চালু হয়। ১৯২৭ সালে আধুনিকীকরণের অংশ হিসেবে মূল মাদ্রাসা পুনঃনির্মাণের সময় এটি মুসতানসিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশে পরিণত হয়। সমসাময়িককালে বাগদাদে আরো ছত্রিশটি গ্রন্থাগারের কথা জানা যায়। সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিল দুটি প্রতিষ্ঠান; একটি নিজামিয়া গ্রন্থাগার এবং অপরটি হচ্ছে মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা গ্রন্থাগার।

Share.

মন্তব্য করুন