গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত
ছয়টি পাখি ছয়টি রূপে এসে বাংলাদেশে
ছয়টি সুরে করে ডাকাডাকি॥

কবির কল্পনাশ্রয়ে বাংলার বর্ষপ্রকৃতির প্রতীক হয়েছে পাখি। আবহাওয়া বদলের সাথে সাথে পাখির কুঞ্জনেও আসে পরিবর্তন। সুর পায় ছয় ধরনের মাত্রা। এ সুরের মাত্রাকেই কবি ঋতু বলতে চেয়েছেন। কী অনিন্দ্য কবির কল্পনা! কবির কল্পনা সুষমায়- পাখি হলো বাংলার বর্ষ। সুর তার ঋতু পরিক্রমা!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের আদর্শ ছোটগল্প হিসেবে আজও সমান জনপ্রিয়। হৈমন্তী যেন বাঙালির আবেগ, ভালোবাসার আঁতুড়ঘর। হৈমন্তী চরিত্রের সাথে হেমন্ত ঋতুর সম্পর্ক বিচার্য নয়। তবুও হৈমন্তী নামের মাঝেই যেন হেমন্ত ঋতুর সুবাস ছড়ানো।
বাংলার আকাশ, বাংলার প্রকৃতি আল্লাহর এক অনুপম দান। এই পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানে ষড়ঋতুর অনুপম আবহে মনকে উতলা করা যায় না। পৃথিবীতে এমনও অঞ্চল রয়েছে যেখানে সারা বছরই গরম অথবা সারা বছরই শীত। আরব দেশগুলোতে প্রায়শ দেখা মেলে চার ঋতুর। গরমই সেখানকার প্রধান ঋতু। আবার আমেরিকান ও ইউরোপীয় অঞ্চলে থাকে শীতের প্রভাব। আর বাংলার আকাশ বা প্রকৃতি যেন দ্বৈত প্রভাব আর মিশেল প্রকৃতির অনবদ্য লুকোচুরি। গ্রীষ্মকালে মনে হয় গরমের প্রভাবই এখানে প্রধান। আর শীতকালে মনে হয় শীতই বাংলার মুখ্য ঋতু। এ দ্বৈততার সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে হেমন্ত।

কিন্তু হেমন্তের এ ভূমিকা খুব কমই নজরে আসে। হেমন্তের এ ভূমিকা যেন অনুঘটিত বা অনুচ্চারিত থেকে যায়। ঐ গানের মতো যা সাধারণ্যে খুব হিট করে। সবাই গায়ককে নিয়ে মাতামাতি করে। মুখে মুখে সরব থাকে গানের কলি। কিন্তু কালজয়ী ঐ গানের গীতিকারের কথা আমরা বেমালুম ভুলে থাকি। বর-কনের বিয়ের পর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে সবাই। ভালো জুটি। মিলেছে ভালো। সোনায় সোহাগা। ইত্যাদি কত কথা। কিন্তু বর-কনের নির্মাতা বা তাদের বিয়ের উদ্যোক্তা বা প্রস্তাবক কে? তার কথা কেউ বলে না। অথচ সেই ছিল ঐ বিয়ের নেপথ্য কারিগর। এটিই জগতের নিয়ম।
প্রকৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঋতু হেমন্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিয়ে মাতামাতি একটু কমই। সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি কোনো অঙ্গনেই এ নিয়ে মাতামাতি বেশি নেই। যদিও প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সাজ, সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রাবল্য, রাজনীতির সরসতা ও শোরগোল এ সময়েই বেশি হয়ে থাকে। কারণ এ ঋতুতে আকাশে থাকে ভাসমান মেঘের অনবরত চলাফেরা। যখন তখন বৃষ্টি নামার ভীতি থাকে না। চলে গরমের অস্তায়মানতা। শীতের আগমনী বার্তা এ যেন সর্বকর্মের মোক্ষম ঋতু।
তাই হেমন্ত ঋতুর নাম-ডাক যেমনই হোক হৈমন্তী শুভেচ্ছার কমতি থাকে না। পত্রালাপ কিংবা ক্ষুদে-বার্তায়। ঋতুরাজ বসন্তের দাপট, বর্ষার সর্বব্যাপী আর্তনাদ, গ্রীষ্মের বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব কিংবা শীতের সর্বনাশী ছোবলের প্রতাপে হেমন্তের সৌন্দর্য প্রকাশ সাহিত্যে কিছুটা ম্লান। তাই বলে অনুপস্থিত নয়। হেমন্তের তাণ্ডবহীনতাই হয়তো এই ¤্রয়িমাণতার বড় কারণ। শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রকাশ সমাজে কমই হয়ে থাকে। হেমন্তের ক্ষেত্রেও তাই হয়ে থাকে।
অন্য কারণ- প্রকৃতিতে প্রযুক্তির খড়গ আক্রমণ। অর্থাৎ সাধারণ্যের শহরমুখিতার কারণে গ্রাম্য প্রকৃতির সৌন্দর্য-শোভা থেকে বঞ্চিত হওয়া। শহুরে যান্ত্রিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর কারণে নিসর্গ প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য তাদের দৃষ্টি কাড়ে না। এটিই বোধ হয় ঋতু হেমন্তের ললাট নিয়তি।

হেমন্তে বুদ্ধিজীবীদের টকশো সরব হোক বা না হোক। কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব জমে উঠুক বা না উঠুক। কবির কলমে হেমন্ত সৌন্দর্য সুর পাক বা না পাক। কার্তিকের আগমনে হেমন্তের জানান প্রাকৃতিক, চিরায়ত। এর কোনো ব্যতিক্রম ও ব্যত্যয় নেই। হেমন্তের আবহাওয়ায় গরম কমে আসে। রাতের শেষভাগে চাদর-কাঁথার কথা মনে হয়। এমন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া মননে আবেশ আনে নব আবহের। সত্যিই এ আবহ ও আবেশ স্বর্গীয়। এমন আবহই জানান দেয় ঋতুশাখে হেমন্ত কুহকের।
হেমন্ত ঋতু বাঙালি মনে প্রাণসঞ্চারী। হাসি-খুশি-আনন্দের সওগাতবাহী। চোখের পটে খেলা করুক আর না করুক কিশোর মনে দোলা দেয় হেমন্ত। হেমন্তের আগমনে হৃদ-কন্দর আলোড়িত হয়। হৃদ-অলিন্দে প্রস্ফুটিত হয় আনন্দ রেখা।
কার্তিক আর অগ্রহায়ণ হেমন্তের প্রতিনিধিত্বকারী দুই মাস। কার্তিক সুদর্শন পুরুষের প্রতীক। অবশ্য আবহমান বাংলার এই মাসে অন্ন-ঘাটতি থাকে। ধানের সঞ্চয় প্রায় শেষের পথে। কিন্তু অগ্রহায়ণে সে কমতি আর থাকে না। বাঙালির ঘর তখন নতুন ধানের ঘ্রাণে ভরে যায়। গৃহস্থের মাঝে চলে ধান-কাটার উৎসব। বিহান থেকে সাঁঝ পর্যন্ত চলে কাটাই-মাড়াই, যতœ-সেদ্ধ-শুকনো চাল বানানো ইত্যাদি আরো কত কী? কেবল কাজ আর কাজ। এ সময় ঘরে ঘরে এত ধান যে মাঠেও পড়ে থাকে ধানের অনেক শীষ। এই ধান ইঁদুরের সম্পদ। এ ধান সংগ্রহে ইঁদুরদের আনন্দের সীমা থাকে না। গ্রাম্য মুরুব্বিরা বলে অগ্রহায়ণে নাকি এক ইঁদুর সাতটা করে বিয়ে করে। অগ্রহায়ণ আসে বাঙালির ঘরে ঘরে স্বপ্নের বার্তা নিয়ে। নবান্ন উৎসবের ঢোল-শহরৎ পিটায়ে। পিঠা-পুলির শুভ মহরতের জানান দিয়ে। তাই বলি হেমন্ত কোমল, স্বপ্নিল ও ফলবতী এক মহান ঋতু।
এ ঋতুর নবান্ন উৎসব কৃষাণ-কৃষাণীর বার্ষিক স্বপ্ন। এ ঋতুতেই গ্রামে গ্রামে চলে বিয়ের আয়োজন। সব বাড়িতেই আমন্ত্রণ জানানো হয় মেয়ে-জামাইকে। জোরেশোরে বানানো হয় নতুন চালের পিঠা-পুলি, মুড়ি-মোয়া-খৈ-মুড়কির আয়োজন। মধুমাস জ্যৈষ্ঠের পরেই অগ্রহায়ণের পিঠা উৎসবের মাখামাখি, শ্বশুরবাড়ির আনন্দ ভাগাভাগির দৃশ্য চিরায়ত বাংলার অপরূপ সুখ কল্পনার অংশ। ঘরে ঘরে চলে এ আয়োজনের আগাম প্রস্তুতি। যান্ত্রিকতার জাঁতাকলে গ্রামীণ এ স্বর্গীয় আনন্দ কখনই ম্লান হবে না।

মাসটির নাম অগ্রহায়ণ। নামের মধ্যেই অগ্র, অগ্রিম, আগাম এমনতরো একটি বার্তা লক্ষ করা যায়। এ রকম কথাও শোনা যায়- স¤্রাট আকবর নাকি অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস গণ্য করতে চেয়েছিলেন। অগ্রহায়ণ নামের নেপথ্যে রহস্য কি সেটিই? যাহোক অগ্রহায়ণ বছরের অষ্টম মাস হওয়াতে লাভবান হয়েছে বাঙালি। বৈশাখে পেয়েছে নববর্ষ আর অগ্রহায়ণে পেয়েছে নব-অন্ন। শুভকামনা হেমন্তের তরে।
বাংলা সাহিত্যে সব ঋতুকে ঘিরেই রয়েছে কাব্য সাহিত্যপনা। হেমন্তের উপস্থিতি সেখানেও সরব। রবীন্দ্র-নজরুল থেকে শুরু করে সুফিয়া কামাল পর্যন্ত প্রায় সকল কবিই করেছেন হেমন্তের বন্দনা। তবে হেমন্তের কবি এই উপাধির লকেট ঝুলেছে কেবল জীবনানন্দের গলায়। ঋতুর নামে কবির উপাধি আর কারুর কপোল চুমেছে কী? সত্যিই হেমন্ত বড় ভাগ্যবতী।
শীতোষ্ণ ঋতু হেমন্ত। শরতের অনুজ আর শীতের অগ্রজ। এই তিনই একে অপরের সহোদর। শীতের অচেনা আমেজ এবং আবহে সামনে ধায় হেমন্ত। তাই আমরা বলি শীতোষ্ণ। হেমন্তের কার্তিক তো অভাবপীড়িত, মঙ্গাকবলিত। গ্রামে গ্রামে তখন অন্নাভাব। তবে ভুলে গেলে চলবে না এ যে নবান্নের আবির্ভাব বার্তা। “দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মোহিতে”। জীবনের কবি জীবনানন্দ জীবনের দুঃখ-ক্লেশ স্পর্শ করেছেন নিবিড়ভাবে। প্রতি কার্তিকেই ভারাক্রান্ত হয়েছেন বারবার। উচ্চকিত ও উচ্ছ্বসিত হয়েছেন প্রতি অগ্রহায়ণে নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায়।
প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল,
অঘ্রাণের নদীটির শ^াসে
হিম হয়ে আসে…।
কিংবা শুয়েছে ভোরের রোদ
ধানের উপরে মাথা পেতে অলস ধোঁয়ার মতো
এইখানে কার্তিকের দেশে হেমন্তের ধান উঠে ফলে
দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে।

জীবনানন্দ দাসই প্রথম হেমন্তকে ঋতুকন্যা উপাধি দেন। বসন্ত-শীত যদি ঋতুরাজ-ঋতুরাণী হয়। তবে তারা নিঃসন্তান হবে কেন? হেমন্ত বসন্তের কন্যা হলে তা মানানসই হয় বৈকি। হিম হিম কুয়াশা আর হিম শীতের বার্তাবাহী এই হেমন্ত। হেমন্ত মানেই অনটনের যবনিকা। স্বর্ণালি সমৃদ্ধির শুভ উদ্ভাস। হেমন্ত মানেই পরিতুষ্টির ব্যস্ততা। কৃষকের মুখে নির্মল হাসির ফোয়ারা।
শস্যের ঋতু হেমন্ত। দৃশ্যের ঋতু হেমন্ত। গন্ধের ঋতু হেমন্ত। শিশিরের ঋতু হেমন্ত। একইভাবে তৃপ্তি আর পরিতৃপ্তির ঋতুও হেমন্ত। কবির পরিতৃপ্তির শেষও যেন এই হেমন্তে-
চুষে লয় রৌদ্রের রস / হেমন্ত বৈকালে / উড়ো পাখপাখালির পালে /
উঠানে পেতে থাকে কান, / শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ / অঘ্রাণের মাঝ রাতে।
মধু সমীরণ ও শ্যাম বনানী যৌবন নৃত্যেও ঝংকৃত হয় এই হেমন্তেই। কাজেই রূপসী-ষোড়শী হেমন্তকে অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। হেমন্ত ছিল, হেমন্ত আছে, হেমন্ত থাকবে বাঙালির প্রাণে। বাংলার প্রকৃতিতে হেমন্ত বারবার ডাকবে। শহুরে যান্ত্রিকতা নয় কিশোর মানসকে পরিশুদ্ধ করতে পারে হেমন্ত, হেমন্তের প্রকৃতি, হেমন্তের প্রতি গভীর প্রেম-ভালোবাসা। কাব্যগাঁথা কিংবা সাহিত্যের পাতায় নয়। সুরেলা হেমন্তকে প্রাণময় করতে হেমন্ত প্রকৃতিতে অবগাহন করে বিশুদ্ধকে শুদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে কিশোরদেরকেই। হেমন্ত সুবাসে নির্মল করতে হবে সমাজের সকল দুর্গন্ধ। জীবনানন্দের ভাষায়-
আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি / বিকেলের এই রঙ রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোজ ঢালু মাঠ / বিবর্ণ বাদামি পাখি- হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে-ঘাসে কুড়–নির / মুখে তাই নাই কোনো কথা
কিংবা
আবার আসিব ফিরে- ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুক ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।

নবীন কবিরাও কিন্তু কম যান না। কবি গোলাম মোহাম্মদের পরিণত পঙক্তি হেমন্তকে নিয়েÑ
মখমল চোখ তার / মুখ তার শিউলির ফুল
হেমন্তের মাঠ যেন দেহ তার / বিহ্বল শ্রাবণের মেঘের মুকুল॥
আশি^নের আকাশের / নরম নীলের মমতায়
ধীরে চলা মেঘেদের আঁচলের মতো / আলুথালু ফিরে ফিরে চায়॥
শিশু, বালক, কিশোর, যুবক বৃদ্ধ যদি হয় জীবন পরিক্রমা। তবে কিশোরকাল জীবনের হেমন্ত। অর্থাৎ হেমন্ত আর কিশোরের পথচলা সমান্তরাল। জীবন মাঝে কিশোর আর ঋতু মাঝে হেমন্ত। হেমন্ত যেন ঋতুর কিশোর আর কিশোর যেন জীবনের হেমন্ত। জীবনের হেমন্ত সুশোভিত হোক স্বাপ্নিক শুদ্ধতায়। সত্যবাদিতায়। সুষমা পাক শিশির সিক্ত সতেজতা ও নির্মলতায়। হেমন্তে শাণিত হোক বাংলার কিশোর প্রাণ। হেমন্তের জন্য পূর্ণাঙ্গ ভালোবাসা।

Share.

মন্তব্য করুন