মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. শিশুদের ভীষণ ভালোবাসতেন। আদর করতেন শিশুদের। দয়া করতেন আন্তরিক ভাবে। শিশুদের সাথে কোমল আচরণ করতেন এবং কোমল আচরণ করার আদেশ দিতেন। তাঁর বাণী- সে ব্যক্তি আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে ছোটদের দয়া স্নেহ করে না। এ বাণীটি কতইনা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু শিশুদের দয়া স্নেহ না করলেই সে নবীর উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না। ভাবা যায়! কথাটি ভাবতে হবে নিশ্চয়। শুধু ভাবনা নয়, কাজেও পরিণত করা চাই।
রাসূল সা. শিশুদের প্রতি যত্ন নিতেও আদেশ করেছেন। নবজাতকের প্রতি রাসূলের অন্যরকম দৃষ্টি ছিলো। রাসূলের সঙ্গীদের মধ্যে যার শিশুসন্তান জন্ম নিতো। রাসূলের কাছে নিয়ে আসতেন শিশুটিকে। রাসূল সা. খেজুর চিবিয়ে শিশুর মুখে দিতেন। তাদের জন্য দোয়া করতেন। জীবনের জন্য বরকত কামনা করতেন।

একটি ঘটনা বলা যায়। ঘটনাটি বলেছেন আসমা রা.। তারই ঘটনা এটি। তিনি বলেছেন- একদিন আমি মক্কা থেকে বের হলাম মদীনার উদ্দেশে। তখন আমার গর্বে ছিলো আবদুল্লাহ বিন জুবাইর। চলতে চলতে এলাম মদীনায়। মদীনার কুবা নামক জায়গায় পৌঁছলাম। ঠিক এখানেই পৃথিবীতে এলো আবদুল্লাহ বিন জুবাইর। ও জন্ম নিলো এই কুবায়। এরপর তাকে নিয়ে আমি রাসূল সা.-এর কাছে এলাম। আবদুল্লাহকে রাসূল সা. এর কোলে তুলে দিলাম। রাসূল সা. বললেন- একটি খেজুর নিয়ে আসো। খেজুর আনা হলো। খেজুরটি মুখে দিয়ে চিবিয়ে নিলেন তিনি। অতঃপর তিনি শিশু আবদুল্লাহর মুখে তার লালা লাগিয়ে দিলেন। সেই লালা খেয়ে নিলো আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহর পেটে প্রথম যে বস্তুটি প্রবেশ করে তা ছিলো রাসূল সা.-এর মুখের লালা। তারপর চিবানো খেজুরের সামান্য অংশ মুখে দিলেন শিশুটির। তারপর আবদুল্লাহর জন্য দোয়া করলেন। বরকত প্রার্থনা করলেন। মক্কা থেকে হিজরতের পর এই আবদুল্লাহ বিন জুবাইর ছিলো মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া প্রথম শিশু।

রাসূল সা. শিশুদের সুন্দর নাম রাখার বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। একটি সুন্দর নাম পাওয়া শিশুর অধিকার। রাসূল সা. নিজেও অনেক শিশুর নাম রেখেছেন। এখানেও একটি ঘটনা উল্লেখ করা আনন্দের হবে। মহানবীর একজন সাহাবীর নাম আবু মুসা রা.। তিনি বললেন- আমার একটি পুত্রসন্তান জন্ম নিলো। আনন্দিত আমি। ভীষণ আনন্দিত। আনন্দের সাথে আমি পুত্রকে নিয়ে এলাম রাসূল সা.-এর কাছে। রাসূল সা. তার নাম রাখলেন ইবরাহিম। তারপর একটি খেজুর চিবিয়ে শিশুটির মুখে দিলেন। তার জন্য বরকতের দোয়া করলেন। এরপর তাকে ফিরিয়ে দিলেন আমার কোলে।

রাসূল সা. শিশুদের কোলে নিতেন। ঊরুর ওপর বসাতেন। আদর করতেন। এমন অবস্থায় শিশুদের কারণে কষ্ট পেলেও শান্ত থাকতেন। ধৈর্য ধরতেন। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না।
রাসূল সা.-এর প্রিয় স্ত্রী হযরত আয়শা রা. একটি ঘটনা বলেছেন। বলেছেন- একদিন একটি শিশুকে রাসূল সা.-এর কাছে আনা হলো। রাসূল সা. শিশুটিকে কোলে বসালেন। সহসা শিশুটি রাসূল সা.-এর কোলে প্রস্রাব করে দিলো। রাসূল সা. তখন একটু পানি আনতে বললেন। কিন্তু কাপড়টি ধুলেন না তিনি। প্রস্রাবের জায়গাগুলোতে শুধু পানি ছিটিয়ে দিলেন।
এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে রাসূল সা.-এর সাথে। সব ঘটনাই তিনি শান্ত চিত্তে ধৈর্য ধরেছেন। শিশুদের প্রতি তাঁর মমতা এমনই ছিলো। এসব ঘটনা থেকে শিশুদের প্রতি কোমল আচরণ করার শিক্ষা পাই আমরা। একই সাথে কোমল আচরণ পাওয়া শিশুদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।
রাসূল সা. শিশুদের সাথে মজা করতেন। সে মজার বিষয়গুলো এতই আনন্দের ও বরকতের ছিলো যা পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটি উপমাও নেই।

এখানেও একটি ঘটনা বললে দারুণ হবে বিষয়টি।
ঘটনাটি বলেছেন মহানবীর একজন প্রিয় সাহাবী হযরত আনাস রা.। তিনি বললেন- উম্মে সালামা রা.-এর একটি কন্যাসন্তান ছিলো। নাম- জাইনাব। কিন্তু রাসূল সা. আদর করে ডাকতেন- জুয়াইনাব। একদিন ছোট্ট জাইনাব রাসূল সা.-এর ঘরে এলেন। রাসূল সা. তখন গোসল করছিলেন। জাইনাবকে দেখে তিনি তার মুখ থেকে পানির ছিটা মারলেন। এতে জাইনাব বেশ মজা পেলো। রাসূল সা. এর মুখের সে পানির ছিটার বরকতে জাইনাব বৃদ্ধা হয়ে গেলেও তার চেহারা যুবতীদের মতো সুন্দর ছিলো।
আরেকটি ঘটনা বলেছেন আনাস বিন মালিক রা.। তিনিও রাসূল সা.-এর প্রিয় সাহাবীদের একজন ছিলেন। তিনি বলেছেন- আমার একটি ছোট ভাই ছিলো। তার নাম- আবু উমাইর। সে ছিলো সদ্য দুধ ছড়ানো শিশু। মাঝে মাঝে সে রাসূল সা.-এর কাছে আসতো। যখন আসতো রাসূল সা. স্নেহভরা কণ্ঠে তাকে বলতেন- হে আবু উমাইর, কোথায় তোমার নুগাইর? নুগাইর ছিলো আবু উমাইরের একটি পাখি। এ পাখি নিয়ে খেলতো সে।
রাসূল সা. শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতেন। খেলার অংশ হিসেবে তিনি শিশুদের মাঝে প্রতিযোগিতা করতেন। আব্বাস রা.-এর পরিবারে ছিলো আবদুল্লাহ, ওবায়দুল্লাহসহ বেশ কয়জন শিশু। রাসূল সা. এদেরকে এক সারিতে দাঁড় করাতেন। এরপর বলতেন- যে আমার কাছে সবার আগে দৌড়ে আসবে তার জন্য আছে এ এ পুরস্কার। রাসূল সা.-এর কথায় তারা প্রাণপণ দৌড় দিতো। এসে কেউ তাঁর পিঠে চড়ে যেতো। কেউ বুকে চড়ে উঠতো। রাসূল সা. তাদের কাউকে আদর করতেন। কাউকে চুমু খেতেন। কাউকে জড়িয়ে নিতেন। এভাবে শিশুরা রাসূল সা.কে ভালোবাসতো। তিনিও ভালোবাসতেন শিশুদের।

রাসূল সা. শিশুদের দেখলেই সালাম দিতেন। এটি ছিলো তাঁর অসাধারণ সুন্দর আচরণ। শিশুদের সালাম দিলে তাদের মন আনন্দে আপ্লুত হতো। খুশিতে ভরে উঠতো। পুলকিত হতো তারা। এখানে বেশ কটি দিক আছে শিক্ষার। প্রথমত- শিশুদের শিক্ষা দেয়া যে দেখা হলে সালাম দিতে হয়। দ্বিতীয়ত- বড়দের সাথে শিশুরা সহজে কথা বলতে পারে না। বড়দের সাথে কথা বলতে তারা ইতস্তত বোধ করে। সালামের মাধ্যমে শিশুদের স্বাভাবিক করে তোলার বিষয়টি কাজ করে। তৃতীয়ত- সালাম দিয়ে শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণ করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
রাসূল সা. সালাম দেয়ার মাধ্যমে শিশুদের একটি আত্মিক শক্তি দান করতেন।
শিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন রাসূল সা.। তাদের সাথে হাস্যরস করতেন। মজা করতেন। এর ফলও কী দারুণ ছিলো। রাসূল সা. শিশুদেরও প্রিয় ছিলেন ভীষণ।
হযরত আনাস রা. বলেছেন- রাসূল সা. আনসারদের দেখতে আসতেন। আনসারদের কারো ঘরে রাসূল সা. এলে সে ঘরের শিশুরা রাসূল সা.-এর চারপাশ মাতিয়ে রাখতো। তিনি শিশুদের সালাম দিতেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন।

শিশুদের আদর করার একটি গল্প বলা যায়। গল্পটি বলেছেন জাবির বিন সামুরা রা.। তিনি বললেন- রাসূল সা.-এর সাথে জোহরের নামাজ আদায় করলাম আমি। নামাজ শেষে বাড়ির উদ্দেশে বের হলেন তিনি। তাঁর পিছু পিছু চললাম আমি। এসময় কয়জন ছেলে আসলো তার সামনে। রাসূল সা. প্রত্যেকের গালে হাত বুলিয়ে আদর করলেন। আমার গালেও হাত বুলিয়ে দিলেন। তাঁর হাতটি কি যে আনন্দময় শীতল এবং সুগন্ধময় ছিলো, মনে হচ্ছিল এইমাত্র তিনি সুগন্ধি পাত্র থেকে বের করে এনেছেন তাঁর হাত।
তিনি শিশুদের শিক্ষা এবং সুন্দর প্রতিপালনের প্রতি গুরুত্ব দিতেন।

এখানেও একটি মজার কাহিনী সামনে আনা যায়। কাহিনীটি রাসূল সা.-এর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ বিন আব্বাসের সাথে। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন- একদিন আমি রাসূল সা.-এর পেছনে একটি বাহনের ওপর বসা ছিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন- হে বালক, আমি তোমাকে কয়টি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি- আল্লাহর বিধানসমূহের হেফাজত করো, তিনি তোমার হেফাজত করবেন। আল্লাহর বিধানসমূহের হেফাজত করো, তাঁকে তোমার পাশে পাবে। সচ্ছলতার সময় তুমি তাঁর সাথে পরিচিত হও, অসচ্ছলতার সময় তিনি তোমাকে চিনবেন। কিছু চাইতে হলে একমাত্র আল্লাহর কাছে চাও। এবং সাহায্য কামনা করতে হলে একমাত্র আল্লাহর কাছেই কামনা করো।
আর জেনে রাখো- সকল মানুষ যদি একত্র হয়ে তোমার উপকার করতে চায়, তবে আল্লাহ তায়ালা তোমার তকদিরে যা লিখে রেখেছেন, সেটা ছাড়া কোনো উপকার করতে পারবে না। আর যদি সকল মানুষ একত্রে তোমার ক্ষতি করতে চায়, তবে আল্লাহ তায়ালা তোমার তকদিরে যা লিখে রেখেছেন সেটা ছাড়া ক্ষতি করতে পারবে না।
রাসূল সা. শিশুদের খাওয়া দাওয়ার আদব শেখাতেন। তাদের ভুল হলে নরম ভাষায় শুধরে দিতেন। শিশুদের সাথে কোমল ও স্নেহের ভাষায় কথা বলতেন। দায়িত্ব গ্রহণের জন্য শিশুদের প্রস্তুত করতেন। শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠন করতেন। শিশুদের সাথে সবসময় সত্য বলার ওপর গুরুত্ব দিতেন।

Share.

মন্তব্য করুন