‘ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠল ফুটে বনের ফুল।
সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।’
‘বৃষ্টি এল কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।’

এই দুই ছড়ায় ছন্দ ও ভাবের দারুণ কারিশমা প্রকাশ করেছেন কবি। তাতেই বুঝি ফররুখের দৃষ্টিভঙ্গি কতো উন্নত! ছিল সুগভীর মনও! এই মন শিশুতোষ লেখার জন্য। ছিলেন দারুণ সচেতন! তিনি মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বেশি পছন্দ করতেন। স্বরবৃত্তও লিখেছেন। শিশুদের বেলায় স্বরবৃত্ত বেশি মানায়। আসলে তিনি সব বৃত্তেরই দারুণ কারুকার্যের কারিগর ছিলেন!
শিশুরা আনন্দে যেমন দোলনায় দোলখায়! তাঁর লেখা পড়েও সেই রকম আনন্দের জগতে উড়াল দেয় শিশুরা। তাঁর শিশু-কিশোর কবিতা সংখ্যা মোট ২১টি। প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থ ৭টি। কবির বেঁচে থাকাকালীন প্রকাশ ৪টি। অন্যগুলো অপ্রকাশিত। তাই তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের ছড়াই কিছু উল্লেখ করছি। আশা করি এগুলো শিশুমনে আনন্দের খোরাক দেবে-
‘আয়রে ঘোড়া পরেনদা
পাখনা মেলে উড়ে যা,
কিসসা শুনি রোজ আমি
করি যে তোর খোঁজ আমি,
জোসনা যখন ফুটফুটে
মনে মনে যাই ছুটে,
সাঁঝের পরী রয় পিছে;
মাটির ধরা রয় নিচে।’

শিশুদের চির চঞ্চল মন! কবি এই মনের তবলা বাজিয়েছেন দারুণ ছন্দে। বিষয়ভাবনাও দারুণ! মনকে বানিয়েছেন ঘোড়া! দৌড়াচ্ছেন ফুটফুটে জোছনামাখা রাতে। আহা, এমন জোছনায় কতো কিস্সা শুনেছি! দাদী-নানীর গল্পেও যেন পরীরা নেমে যেত! আসলে এসব ভাবনায় কবি তার দারুণ নিপুণ হাত বুলিয়েছেন।
শুধু কি চাঁদের আলো! কোনো কোনো সময় চাঁদ তারাও থাকতো না। তখন! তখনও কবি বাস্তব বাতি বা চেরাগের সাথে শিশু মনের চেরাগ জ্বালিয়েছেন। যেমন-
চেরাগটাতে জ্বালো,
আঘন মাসের আলো;
নীহার- ভেজা মাঠে নামে
রাতের ছায়া কালো,
মাগো তোমার কিসসা কথা
লাগবে এখন ভালো।’

শিশুরা যেন স্বাধীন সাহসী মনে বড় হয় সে খেয়ালও রেখেছেন কবি। প্রায় সময় শিশুরা কিছু দেখলে ভয় পায়। সেগুলোও এনেছেন সচেতন নিপুণতায়। অভয় দিয়েছেন শিশুদের। যেমন-
‘ভয়ে পালায় বোকা,
ভয় পায় না খোকা!
খোকন সোনার সাহস ছিল,
বুদ্ধি ছিল চোখা;
ভয় না পেয়ে ভেঙে দিল
হুতোম পেঁচার ধোঁকা।’

শিশুদের অভয় দেয়ার সাথে সিংহের ন্যায় গুণ অর্জনের কথাও বলেছেন ছড়ার কারিশমায়। বলেছেন সিংহের মতো নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে। তাঁর ভাষায়-
‘বনের রাজা সিংহ ভাই,
ভয় ভাবনা কিছুই নাই,
চওড়া যে তার বুকের ছাতি
ডরায় না সে দেখলে হাতি।’

দারুণ না! তার অপ্রকাশিত গ্রন্থের ছড়া যদি এমন হয়, তাহলে, প্রকাশিত ছড়া কেমন! সেগুলোও টানে। আরো বেশি আকর্ষণ! তাই তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থও উল্লেখ না করে পারছি না। গ্রন্থগুলো হলো- পাখির বাসা, হরফের ছড়া, চাঁদের আসর, ছড়ার আসর, ফুলের জলসা।
ছোটদেরকে কবি বেশি ভালোবাসতেন। তাই শিশুদেরকে এ পৃথিবীর ‘নতুন মানুষ’ রূপে আখ্যায়িত করে উৎসর্গ করেন ‘পাখির বাসা।’ উৎসর্গিত সে পঙক্তি হলো-
নতুন মানুষ এল যারা
খোদার দুনিয়াতে,
ছোট্ট আমার ‘পাখির বাসা’
দিলাম তাদের হাতে।

পাখি যেমন দারুণ নিপুণ শিল্পী হয়ে সুন্দর শ্রেষ্ঠ বাসা বানায়! কবিও পাখির বাসার ছড়া কবিতায় তেমনই শ্রেষ্ঠ কারিগরের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া
দিনটাতে,
পাখির বাসা খুঁজতে যাব
এক সাথে।
কোন্ বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন্ বাসাটায়
কোন্ বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝ রাতে।

কবির দ্বিতীয় বই ‘নতুন লেখা’র মধ্যেও শ্রেষ্ঠ ছড়া কারিগরের পরিচয় দিয়েছেন। খেয়াল রেখেছেন- শিশুরা যেন অলস না হয়ে শ্রেষ্ঠ জাতির মানুষ হয়। যেমন-
কাজের মানুষ নয়রে যারা
কথার বোঝায় মরে তারা,
ছেঁড়া কাঁথায় তাদের স্বপ্ন
লুটায় ধূলি পারা।
নাইরে কাজে শঙ্কা যাদের
নাইরে ভয়ের মানা,
তাদের কাজেই সবুজ নিশান
মেলে সবুজ ডানা।

ভাষা সৈনিক কবি মাতৃভাষাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। সেই সুস্পষ্ট নিদর্শনস্বরূপ লেখেন ‘হরফের ছড়া’ বইটি। সেখানেও আলাদা বৈচিত্র্যে কাজ করেছেন ছড়ার ওপর। যেমন-
‘ক-য়ের কাছে কলমিলতা
কলমিলতা কয় না কথা,
কোকিল ফিঙে দূর থেকে
কলমি ফুলের রঙ দেখে।’
‘ব-য়ের কাছে বন-বিড়াল
আনলো ডেকে সাত-শিয়াল,
বোল-বোল-বোল আমের বোল
বাদুড় এসে বাজায় ঢোল।

শিশুরা মেলা খুব পছন্দ করে। মেলাতে ঘুরে ঘুরে আনন্দ পায়। শিশুরা মেলার জন্য পাগল হয় না- এ কথা ভুল। তারা চির চঞ্চল। যাবেই! এ নিয়েও কবির দৃষ্টি সজাগ ছিল! যেমন-
‘বাপ্রে সে কী ধুম ধাড়াক্কা
দিচ্ছে ধাক্কা, খাচ্ছে ধাক্কা,
গুঁতোর চোটে হয় প্রাণান্ত
হাঁপিয়ে ওঠে ক্যাবলা কান্ত!
লাগলো যখন বিষম তেষ্টা
ক্যাবলা করে ডাবের চেষ্টা।
তাকিয়ে দেখে পকেট সাফ,
ভিড়ের ভিতর দেয় সে লাফ।’

এখানেও নিপুণতার হাত বুলিয়েছেন কবি। শেষের দ্বিত্ব বর্ণের শব্দই বলে তাঁর ছড়ার হাত কেমন ছিল! ছিল মজার ছড়ার কারিগর!
তিনি শুধু দারুণ মজার ছড়ার কারিগরই ছিলেন না! ছিলেন মনেরও সৌন্দর্যের কারিগর! সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে সেই সময়ের অন্তরের চোখ। মুগ্ধ হয়েই লালন করতেন সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি! এই কারণেই তিনি উত্তম পুরস্কার পান। ১৯৬৬ সালে ‘পাখির বাসা’ লিখে ইউনেস্কো পুরস্কার এবং একই বছর ‘হাতিম তায়ী’ বইয়ের জন্য পান আদমজী পুরস্কার। তার আগে ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ পুরস্কার পান। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। তাঁর ছড়ার আকর্ষণ ও মুগ্ধতায় পুরস্কারগুলো আজো মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আছে। যেন সময়কে জানান দেয় যাঁরা উন্নত চিন্তায় লেখে তারা কখনও ব্যর্থ হয় না।
পৃথিবীতে কেউ থাকেন না! ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় এই মহান কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই প্রিয় কবি সশরীরে না থাকলেও তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে আজও কথা বলেন।

Share.

মন্তব্য করুন