বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মর্যাদা সমঅধিকার ও বিশ্বশান্তিকে ভিত্তি করেই জাতিসংঘের মানবাধিকার আইন প্রণীত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী রাজনৈতিক মতামত, জাতীয়তা, সামাজিক পরিচয়, শ্রেণি, জন্মসূত্র, কিংবা অন্য কোনো মর্যাদা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য হচ্ছে বিশেষ যত্ন ও সহায়তা। এরই সূত্র ধরে ২০০৫ সালে ১৯২টি দেশের সমর্থনে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করে। এই অধিকার সনদে চারটি মূল অধিকারের কথা বলা হয়েছে-
ক. বেঁচে থাকার অধিকার
খ. বিকাশের অধিকার
গ. সুরক্ষার অধিকার
ঘ. অংশগ্রহণের অধিকার।
এর মধ্যে বিকাশের অধিকারের আওতায় শিশুর শিক্ষার অধিকার অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের সকল শিশুর লিঙ্গ, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্ম, ভাষা, জাতীয়তা, গোত্র, বর্ণ, শারীরিক সামর্থ্য অথবা কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই সনদে বর্ণিত অধিকারসমূহ ভোগের দাবি রয়েছে।
শিশুরা কোমল এবং বিকাশমান বলে তাদের অধিকার অত্যন্ত সুস্পষ্ট রয়েছে এই সনদে।
এই সনদ অনুযায়ী-
অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ সমান সুযোগের ভিত্তিতে শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকারকে স্বীকার করবে। এবং এই অধিকারকে বাস্তবায়নের জন্য যে নির্দেশনা আছে তা হলো-
ক. সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সহজলভ্য করতে হবে।
খ. প্রত্যেক শিশুর শিক্ষাকে বিনা খরচে বা প্রয়োজনে আর্থিক অনুদানে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
গ. যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হবে।
ঘ. শিক্ষাবিষয়ক তথ্য এবং নির্দেশনা সবার জন্য সহজে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
ঙ. বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি উৎসাহিত করতে হবে এবং স্কুল ত্যাগের হার কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. স্কুলের নিয়ম কানুন শিশুর মানবিক মর্যাদা যেন সনদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. বিশ্বব্যাপী সহযোগিতাকে জোরদার ও উৎসাহিত করতে হবে। শিশুর শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো লক্ষ রাখতে হবে তা হচ্ছে-
ক. শিশুর ব্যক্তিত্ব, মেধা এবং মানসিক ও শারীরিক দক্ষতার পূর্ণ বিকাশ।
খ. মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।
গ. শিশুর পিতা-মাতার নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং যে দেশে বাস করে সে দেশের মূল্যবোধ, শিশুর নিজস্ব মাতৃভূমিসহ অপরাপর সভ্যতার প্রতি সম্মানবোধকে জাগিয়ে তোলা।
ঘ. মৈত্রীয় চেতনায় একটি মুক্ত সমাজগঠনের উদ্দেশ্যে নারী-পুরুষের সমান অধিকারসহ সকল জনগণ অর্থাৎ সকল ধর্ম, গোষ্ঠী, আদিবাসীসহ সকল লোকের প্রতি সম্মান দেখানো।
ঙ. প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা।
চ. শিক্ষার মান রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত মানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া।
শিশুদের বিকাশ এমন সব বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত যেগুলো শিশুদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে অর্জনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। যেমন শিক্ষা, খেলাধুলা, অবকাশ, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ধর্মপালন, তথ্য সংগ্রহ এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করা। এই বিকাশ ও সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করার সর্বপ্রথম দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এছাড়াও সুশীলসমাজ, বিভিন্ন শিশুসংগঠন, যুবসমাজ, সমাজনেতা, এনজিওসমূহ, নারীসংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম এদের সকলের। বাংলাদেশের এই অধিকাংশ অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দেশে পরিবার ও আত্মীয় পরিজনকে শিশুর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, তাদের বিকাশের চাহিদা সৃষ্টি করা ও শিক্ষার জন্য ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করার দায়িত্বও তাদেরই। কেবল মাত্র সনদ, আইন বা নীতিমালা প্রণয়নেই শিশুর অধিকার অর্জিত হতে পারে না; যদি না তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক ও অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ নেওয়া না যায়।
বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেছেন, “প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। নীতিগত প্রভাব ও শিশুদের জন্য বরাদ্দ তদারকির জন্য জাতীয় ও বিচারিক সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।”
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্রের অন্যতম অর্জন।
কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক কারণে আমাদের অনেক শিশুই প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারে না। ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে ভর্তির হার প্রায় ৯৮ শতাংশ, কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির পরের পরিসংখ্যান বলে যে এই পর্যায়ে স্কুলে শিক্ষার্থী থাকে ৬৭ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় পৌঁছায় মাত্র ২২ শতাংশ।
এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় য়ে, পরিবারের অসচেতনতা, শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, কন্যাশিশুদের প্রতি পরিবারের অবহেলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন- নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়) এই রূপ নানাবিধ প্রতিকূলতা।
তার পরেও এ প্রশ্ন থেকেই যায় যে, যে সকল শিশুর কাছে শিক্ষা পৌঁছায় তা কতটা মানসম্মত শিক্ষা? আর্থসামাজিক কারণ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আরো কয়েকটি কারণ আছে যা হলো- পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা দান আনন্দময় না হওয়া, শিক্ষা উপকরণের অভাব, অপর্যাপ্ত গ্রন্থাগার, মানসম্মত শ্রেণিকক্ষের অভাব, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া, শিক্ষা জ্ঞানমুখী না হয়ে সনদমুখী হয়ে পড়া।
শিশুর জন্য শিক্ষাবান্ধব পরিবেশই পারে শিশুর মানসিক বিকাশকে নিশ্চিত করতে। বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য পড়া বিষয়টি কাজ না হয়ে যখন খেলা হয়ে উঠবে তখনই শিশু আনন্দের সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক একটি ধাপ অবলীলায় অতিক্রম করতে পারবে।
সারা বিশ্ব যখন ২০২০ সালের মার্চ থেকে কোভিড-১৯ বা করোনা মহামারীর করাল গ্রাসে আতঙ্কিত, বিপর্যস্ত; লকডাউন, কোয়ারেনটিন যখন মানুষকে গৃহবন্দি এবং একই সাথে কর্মহীন করে তুলছে তখন সতেরো কোটি মানুষের এই বাংলাদেশ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সময়কে অতিক্রম করতে গিয়ে, শিক্ষা কিংবা জীবিকার চেয়ে জীবন রক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেবে এটাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় প্রায় বিশ একুশ মাস যাবৎ বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি ঘোষণায় বন্ধ রয়েছে। অনলাইন ক্লাসের সুফল শহরের শিশুরা যদিবা কিছুটা পায়, গ্রামে এর সুফল একেবারেই নেই বললেই চলে।
ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে “করোনার কারণে ৪ কোটি শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।”
ফলে রোজগারে নেমেছে শিশুরা, বাল্যবিয়ে বেড়েছে, কিশোর অপরাধ বেড়েছে। যে শিশুরা স্কুলে রয়ে গেছে তারা শিখনের ঘাটতি নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে উঠছে, ফলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে।
তবুও মানুষ মাত্রই আশাবাদী। এই মহামারীর থাবা থেকে বিশ্ব তথা বাংলাদেশ নিশ্চয়ই খুব দ্রুত মুক্ত হবে বলে আশা করতে বাধা কোথায়? আবারও আমাদের শিশুরা সুস্থ দেহে সুস্থ মন নিয়ে বিদ্যালয়কে মুখরিত করবে, সগৌরবে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ হবে এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিক্ষার মিলন’ গ্রন্থে বলেছিলেন- “বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গেই বর্তমান যুগের শিক্ষার সঙ্গতি হওয়া দরকার।”
বাস্তবিকই শিশুর অধিকার অক্ষুণœ রাখতে হলে এই সঙ্গতিটির বড়ই প্রয়োজন।

Share.

মন্তব্য করুন