Morning shows the day সকালের সূর্য কহে- আজকের দিনটি কেমন হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক ভাষায় এমন একটি প্রবাদ চালু আছে। সকালের সূর্যের প্রখরতা কিংবা নিষ্প্রভতা দেখেই অনেকটা অনুমান করা যায় সেদিনটা কেমন হবে? সারাদিনের তাপদাহ বেশি হবে নাকি কম হবে? তবে কখনও এর ব্যতিক্রম হতেও পারে।
প্রকৃতি থেকে আসি এবার জীবনে। একটি ছোট শিশু, বালক বা কিশোরকে দেখেই প্রায়ই অনুমান করা যায় ছেলেটি বড় হয়ে কেমন হবে? অনেক বাচ্চার বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে বা কাজ দেখে পরিবারের লোকজন ইতিবাচক মন্তব্য করে। সবে পাঠশালায় যেতে শুরু করেছে এমন ছেলের কর্মকাণ্ডে শিক্ষক কখনও হতবাক হয়। তার প্রশংসায় গদগদ হয়ে প্রশংসাসূচক উক্তি করেন। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা কথা বলেন। তার এসব ভবিষ্যদ্বাণী অধিকাংশ সময়েই সত্যি হয়। এর ব্যতিক্রম বা ব্যত্যয় নেই তা কিন্তু নয়।

শিশু মনস্তত্ত্ব বিষয়ে অভিজ্ঞজনরা এ বিষয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তবে মোটা দাগে এর নজির আমাদের কাছে একেবারেই কম নয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের পরিবারের লোকজন ও তার গ্রাম্য পাঠশালার শিক্ষকরা তার আচরণ আঁচ করতে পেরেই নানা মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে তার জীবনে এসব ভবিষ্যদ্বাণীর হুবহু আত্মপ্রকাশ ঘটে। দূরদর্শী শিক্ষকদের দৃষ্টিবীক্ষা ছিলো- এই ছেলে দেশের মান রাখবে। সত্যিই শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বড় হয়ে দেশের মান রেখেছিলেন। নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন এবং তার বাল্যবেলার দস্যিপনাকে দেশসেবায় কাজে লাগিয়ে দেশের সর্বাধিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেন।
আবার ঈশ^রচন্দ্রের জীবনেও ছিল এমন ঘটনা। তার ছোটবেলার টোলঘরের পণ্ডিত তাকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন- এই ছেলে অনেক বড় হবে। অনেক বিদ্যার মালিক হবে। সত্যিই ঈশ^রচন্দ্র অনেক বড় হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর খ্যাতি পেয়েছিলেন।

এমনি আরো অনেক ঘটনার কথা জানা যায় ইতিহাসের বই থেকে। একটি দু’টি নয় অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ করা যাবে। চুরুলিয়া গ্রামের দুখু মিয়ার ঘটনা তো সবার জানা। দুখু মিয়া যখন আসানসোলের রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ করত তখন রুটির দোকানদার তার কথাবার্তা, আচার আচরণে প্রায়ই বলত- এই ছেলের জন্য এই কাজ নয়। এই ছেলে অনেক বড় হবে। এই দুখু পরবর্তীতে আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদা পেয়েছিলেন।
গুণীজন ও মনীষীজনদের বাল্যকালেই বুঝা যায় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সুনির্মল, সোনালি ভবিষ্যৎ। সত্যিই প্রবাদটি সমাজপটে খুবই বাস্তব- Morning shows the day.
আর আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে এই প্রবাদের বাস্তবতা সব থেকে বেশি। তার জন্মকালীন পরিবেশ, প্রতিবেশ, ঘটনার পরম্পরা সবাইকে অভিভূত করে। পরিবারের সবাই বিশেষ করে তার দাদা আব্দুল মোত্তালিব তো শিশুপুত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তার নাম রাখেন মুহাম্মদ বা প্রশংসিত। সেদিন সবাই নিশ্চিত হয়ে বলে- এ কোনো সাধারণ সন্তান নয়। তার সকল লক্ষণই মহান থেকে মহানতর। পরবর্তীতে তিনি সমগ্র বিশে^র জন্য রহমত ও কল্যাণের বার্তাবাহী হয়েছিলেন। মানবতার কল্যাণে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

আমাদেরও শিশুকালে এমন অনেক ঘটনার সূত্র থাকে। আমরা সেসব ভুলে যাই। শিশুকালের অনেক ঘটনাই আমাদের বিস্মৃতিতে চলে যায়। সেটিই সহজাত। দোষের নয়। তবে কৈশোর আমাদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কৈশোরের উল্লেখযোগ্য সকল ঘটনাই আমাদের স্মরণে থাকে। এ সময় আমাদের মধ্যে বুদ্ধি, বিবেচনা এবং কিছুটা দায়িত্বশীলতাও কাজ করে। জীবনের ও জীবনগঠনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় এটিই। এ সময়ের উপলব্ধি, সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা জীবনকে ইতিবাচক পরিগঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি ও সতর্ক হওয়ার সর্বশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
কৈশোরের দায়িত্বশীলতা জীবনে বড় হওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। কৈশোরের স্পৃহা এবং প্রত্যয় জীবনলক্ষ্যে পরিণত হয়। কৈশোরের দায়িত্বশীল আচরণ বলে দেয় তার জীবনপরিক্রমা কোন দিকে ধাবিত হবে।

ঈশ^রচন্দ্র লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় যাবেন। তার বাড়ি থেকে কলকাতা ৬০ মাইলের হাঁটাপথ। প্রথমবার সে অন্যের পিঠে করে গেলেও দ্বিতীয়বার সে নিজেই হেঁটে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। করেনও তাই। কলকাতা পৌঁছে তিনি কাহিল হয়ে যান। কিন্তু তার এই কর্মসহিষ্ণুতা সেদিন বলেছিল- এই ছেলে যত কষ্টই হোক জীবনে অনেক বড় হবে। পরবর্তী জীবনে আমরা তার সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, পরোপকার, কষ্টের সাথে সন্তুষ্টির দিনাতিপাত, দেশের শিক্ষা উন্নয়নে তার পেরেশানি দেখেছি। তার কৈশোরের সহিষ্ণুতাই তার জীবনকে মহীয়ান করে তুলেছিল।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার দু’বেলা অন্নের ব্যবস্থা নেই। জীবিকার তাগিদে রুটির দোকানে চাকরি। বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণের সুযোগ ছিল না। এতদসত্ত্বেও দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীতে যোগদান তার নির্ভেজাল দেশপ্রেমের ইঙ্গিতবাহী। দেশের প্রয়োজনে জীবনবাজি রাখেন কৈশোরকালে। সেজন্যই তিনি পরবর্তীতে উপনিবেশবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক উচ্চারণে অত্যাচারীর রক্তচক্ষুর সমুচিত জবাব দিতে অগ্রণী হোন। তার কবিতার বড় অংশজুড়ে রয়েছে ওপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ। এ সবই ছিল তার কৈশোর দায়িত্বশীলতার পরিণত রূপ। যার শেষ ফলশ্রুতি বিদ্রোহী কবির খেতাব প্রাপ্তি। বলতে গেলে কৈশোরই প্রভাবিত করে মানুষের গোটা জীবনকে।

পৃথিবীর অন্যতম মহামানব ঈসা আ.। তার তো শৈশব-কৈশোরের কোনো পার্থক্য ছিল না। দোলনা থেকেই তিনি কথা বলেন ¯্রষ্টার বিশেষ ইচ্ছায়। তার প্রত্যেকটা বাক্যই ছিল দায়িত্বশীল উচ্চারণ। ছোট ঈসা আ.-এর কথায় সবাই বুঝে যায় নিকট ভবিষ্যতে এই ছেলে মহামানবে পরিণত হবে। পরিণতিতে তাই হয়েছিল।
আর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ সা.-এর কৈশোর দায়িত্ব আরো অনবদ্য, সুষমামণ্ডিত। মুহাম্মদ সা. সবে কৈশোরে পা রেখেছেন। সে সময়ে কাবাগৃহের সংস্কার প্রয়োজন দেখা দেয়। সংস্কার সম্পন্ন হয়। এবার কালো পাথর প্রতিস্থাপনের পালা। কালো পাথর সে সময়েও সম্মানের বস্তু ছিল। কলহপ্রিয় আরব জাতি এ নিয়ে চরম বিতর্কে মেতে ওঠে। কেউ এ মহাসম্মানের অংশীদার থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। সকলের মাঝে অশুভ প্রতিযোগিতা সক্রিয় হয়। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। নিশ্চিত যুদ্ধের শঙ্কায় উৎকণ্ঠিত সবাই। সকল গোত্রের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়- কাল প্রাতে সর্বাগ্রে যে কাবা পানে আসবে সেই করবে এ দ্বন্দ্বের মীমাংসা। কী হয়েছিল সেদিন? এসো শুনি কবির কণ্ঠে-
কাল সকালে আসবে যেজন
সেই দেবে ফয়সালা
স্থির হলো এই কথা আর
থামলো ক্রোধের পালা।
পাক পাথরে রাখবে কে সে হাত
উত্তেজনায় চায়না যেতে রাত
দেখলো ভোরে আসছে আল আমিন
সবাই হলো শান্ত শঙ্কাহীন
সবাই তারে বললো খুলে
মিটলো ক্ষোভের জ¦ালা।
একটি চাদর বিছিয়ে নিজের হাতে
কালো পাথর তুলে দিলেন তাতে
চাদর ধরে গোত্রপতিগণ নিলে
তিনিই করলেন স্থাপন
সবাই হলো মুগ্ধ পেয়ে
সুন্দর ফয়সালা॥
দ্র. গোলাম মোহাম্মদ গীতিসমগ্র, ৬৮;
কিশোর মুহাম্মদের বয়স তখনও পনেরো পেরোয়নি। সমাজের অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, অসহিষ্ণুতা, উন্মাদনা তার হৃদয় মনকে বারবার আহত করে। অহেতুক হানাহানি, অকারণ রক্তপাত, কথায় কথায় মারামারি, বহিরাগতদের ওপর আক্রমণ, লুণ্ঠন তাকে ব্যাকুল করে। তিনি ছোট হওয়ার কারণেই এর প্রতিরোধ ছিল তার অসাধ্য। কিন্তু তার হৃদয়ের কান্না বারবার ডুকরে ওঠে। কী করে এ দুরবস্থার বিহিত করা যায় সে চিন্তায় তার ঘুম আসে না। এক পর্যায়ে সমাজের কয়েকজন ভালো মানুষের সহযোগিতায় অসহায়, নিপীড়িত, মাজলুম, নিঃস্বদের সহায়তার জন্য একটি শান্তি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। আরবের অশান্তি নির্মূলে এটি শতভাগ সফল হতে পারেনি। তবে নির্মল মানসিকতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহ, ন্যায়ের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন যে তাদের ছিল সে বিষয়টি সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। সব থেকে বড় কথা হলো প্রতিকূল পরিবেশে একজন কিশোরের এমন সাহসী উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ। সমাজের প্রতি কিশোর মুহাম্মদের দায়বদ্ধতার এটি জীবন্ত উদাহরণ। মুহাম্মদ সা.-এর জীবনে সফলতার ভিত্তি এ হিলফুল ফুজুল সংগঠনের নাম মানবতার ইতিহাসের স্বর্ণালি স্মারক।

আমরা মনে করি মানবজীবনের কিশোরকাল একটি পরিণত জীবনের ক্ষুদ্র অংশ। তবে মানবজীবনে কিশোরকালের প্রভাব সব থেকে বেশি। জীবনের ইচ্ছা, অভীপ্সা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ গন্তব্য নির্ধারণের যথার্থ সময় এটিই। এ সময়েই আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমার আগামীর জীবনপরিক্রমা কী হবে? মানবসেবায় আমার টার্গেট কী? কী বিপুল দানে ধন্য করতে চাই আমি পৃথিবীকে? যতটুকু পেলাম এ পৃথিবীকে তার চেয়ে কতটুকু ভালো রেখে যেতে চাই? এ প্রশ্নগুলোর ইতিবাচক উত্তর নির্বাচন, তার বাস্তবায়নে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সেজন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করলেই জীবন সার্থকতার স্বাদ পাবে। নতুবা জীবন হবে অনর্থের নামান্তর। তাই-
আজকের শিশু-কিশোর যারা / সফল হবে তারা
জীবন সাজাতে পাগল পারা / পরের উপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া॥
আমাদের আজকের কিশোররাই আগামীদিনের দেশনির্মাতা হয়ে এগিয়ে আসুক, দেশ-জাতিকে যাবতীয় বিচ্যুতির হাত হতে রক্ষা করুক। সকল শিশু-কিশোরের জন্য শরতের শুভ্র ভালোবাসা।

Share.

মন্তব্য করুন