কান্নার যেমন সৌন্দর্য আছে তেমনি আকাশও কান্না ঝরায় তার বিশালতার বলয়ে। সুখ যেখানে রয় দুঃখ তার সাথী হয়ে পাশেই থাকে আনন্দ নিয়ে। তেমনি আমাদের ঋতুর বদল। বর্ষার অশ্রু মুছে দিতে প্রকৃতিকে সাজাতে রকমারি রসদ নিয়ে হাজির হয় শরৎকাল। শরৎ আসে আকাশ ও জমিনকে নতুন রঙ দিতে, অবয়ব দিতে। ভাদ্র আশি^ন মিলেই শরতের আয়োজন। মানুষের মনে ভালোবাসা জাগাতে নানান সুঘ্রাণ ও আকৃতি ধারণ করে এ কাল। তাইতো চুপিসারে মন গলিয়ে চোখ ভরিয়ে শরৎ আসে প্রশান্তিময় শব্দহীন এক গভীরতা নিয়ে।

শরতের আকাশ মনকে জাগ্রত করে। মনের স্বরূপ তুলে ধরে। শিমুল তুলার মতো মেঘগুলো ঘুরে বেড়ায় এক হতে অন্যত্রে। মনের আঁকা ছবি ভাসে আকাশের কোল ঘেঁষে। যেনো পৃথিবীর নতুন নকশা তৈরির কাজ করে শরতের আকাশ বাতাস গাছপালা। চোখের সামনে নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটে। নতুন স্বপ্নরা পেখম তোলে আবেশে। রঙবেরঙের প্রজাপতিরা পাখা মেলে উড়ে উড়ে রঙের ঢেউ তুলে দেয় মনে। পুলকিত মনকে গভীরতায় কাছে টানে। শরতের ঢেউ খেলানো কাশবনের রূপ এসে ধরা দেয় মনের চোখে। মন চায় বলতে কিছু, কান চায় শুনতে, ঠোঁট চায় প্রকাশ করতে। এমনই আবহ তৈরি হয় শরতের সকাল সন্ধ্যার সময়গুলোয়।

বর্ষার কালো মেঘের সাথে সখ্যতা হয় শুভ্রতার, মেঘমালার। আকাশে মেঘেরা শুভ্রতার পোশাকে খেলায় মেতে ওঠে। বিচ্ছিন্নতায় মেঘেদের দেখা মেলে টুকরো টুকরো নানা অবয়বে। বাতাস এসে সঙ্গ দেয় ভালোবাসায়। শরতের দক্ষিণা দিগন্ত ছেড়ে নীরব পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় সাদা বক। প্রতিটি কোণা, প্রতিটি দিক প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দের্যের সাক্ষী হয়ে ওঠে। অপেক্ষারা নতুন অবয়বে চেনে তার প্রকৃতিকে। ভালোবাসার বুলি আঁকে প্রকৃতি। শরৎ হয়ে ওঠে উচ্ছলতার ক্লান্তিহীন পথচলার এক সরব সময়।

ফুল মনকে প্রফুল্লতা এনে দেয়। জীবনকে পূর্ণতায় সাহায্য করে। সেই ফুলের রূপে অলংকৃত হয় রাজপথসহ ঘরের আঙিনা। সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য মেখে সকালকে স্নিগ্ধতায় ভরাতে হাজির হয় শিউলি ফুল। রূপ ও গন্ধে মাতোয়ারা হয় প্রকৃতি। একইসাথে নদীর কোলঘেঁষে বাতাসে হেলতে দেখা মেলে কাশফুলের। কাশফুলের শুভ্রতায় ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ সর্বস্তরের মানুষের মনে এক আলাদা অনুভূতি সঞ্চার করে। শরৎ যেন শুভ্রতার এক প্রতীক। এ সময়ে শহর ও গ্রাম থেকে দলবেঁধে নদীর তীরে ভিড় জমাতে দেখা যায় সব বয়সের মানুষকে। সময়ের সাথে পরিবর্তনের ধারায় সবাই সেলফি তুলতে ব্যস্তসময় কাটায়। কাশফুলের ছোঁয়ায় যেন সকলেই জীবনের সাধ নিতে চায়। প্রকৃতিকে ধারণ করে চোখ যেন কাজল কালো হয়ে ওঠে। হৃদয়কে কাঁপিয়ে মায়াময়, স্বপ্নময় হয়ে ওঠে শরৎ।
শরতের সকাল আসে একরাশ মুগ্ধতায় ভর করে। শিশির ভেজা ঘাসের শরীর নিয়ে। সারা মাঠ ভরে থাকে বিন্দু বিন্দু শিশির ফোঁটায়। কি অপরূপ সেই প্রকৃতির রূপ! নরম আলোয় চারিদিক যখন আলোকিত সে সময় নতুন কুঁড়ির মতো কাশফুল জুড়ে দেখা মেলে মৌমাছিদের দৌড়ঝাঁপ। তাদের ভনভন শব্দ গানের মতো সুর তুলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের দল শিশিরের ছোঁয়ায় ভেজা ভেজা পায়ে মাঠজুড়ে খেলায় মেতে ওঠে। তারা হালকা বাতাস গায়ে মেখে আনন্দে শরতের সকালে ডুব দেয়। পাতায় পাতায়, ফুলে ফুলে শিশিরের ফোঁটা যেন মনপ্রাণ ভিজিয়ে স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে যায়। প্রকৃতির এ সৌন্দর্য মনকে ভাবিয়ে তোলে। জীবনের রহস্য এভাবেই তার রূপরেখায় অঙ্কিত হয়।

সকালের রেশ কাটিয়ে দুপুরের রোদ যখন মাথার ওপর, তখন আকাশ তার রূপ বদল করে নীল রঙে মেখে নেয় নিজেকে। আকাশের নীল রঙ শরতের বুকজুড়ে জেগে ওঠে। নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মতো উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। আকাশ জুড়ে নীল আর সাদা মেঘের খেলায় জমিনকেও নীলাভ করে তোলে সহজেই। প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে গোসল সেরে রোদ মাখাতে ভীষণ আরাম বোধ হয় এ সময়। কেউ বই পড়ে আবার কারো বা অন্যকাজ, কিন্তু রোদের উষ্ণতা গায়ে মাখার আনন্দ নেন সকলেই। এ সময়ে সকলেই বেড়াতে ভালোবাসে। ঘরে ঘরে চলে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার আয়োজন। কেউ সমুদ্র দেখার ইচ্ছে পোষণ করে আবার কেউবা পাহাড়। শরতের এ সময়ে পাহাড় নতুন বৌয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রাখে নিজেকে। কুয়াশার চাদর যদিও পাহাড়কে আড়ালের চেষ্টায় থাকে তবুও পাহাড় তার সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয়। সমুদ্র সবসময়ই তার গভীরতায় অসীম। মানুষ তার বিশালতায় বরাবরই মুগ্ধ। গ্রীষ্মের তাপদাহ থেকে মুক্তি পেয়ে সমুদ্রের স্পর্শ নতুন করে জীবনকে সজীব করে তোলে। নীলাভ শুভ্রতার আকাশ জুড়ে দেখা মেলে সমুদ্রের বিশালতার। সমুদ্র আর নীল আকাশ এক হয়ে মিশে গিয়ে ঢেউয়ের প্রাণান্ত উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। সমুদ্রে বাসরত নাম না জানা প্রাণীরাও সৃষ্টির এ সৌন্দর্য গ্রহণ করে ভালোবাসায়। যে কোনো কালের চেয়ে শরৎ হয়ে ওঠে আনন্দের ।

এভাবেই সময় গড়িয়ে রোদ হেলে পড়ে আয়েশে। ছোট থেকে বড় সকলেই হিমেল বাতাসে ঘর ছেড়ে বের হয় আকাশের নিচে। ছোট বড় দলে বিভক্ত হয়ে খেলায় মেতে ওঠে তারা। বয়স্কদের হাঁটতে দেখা যায় দলবেঁধে। মহিলারাও উঠোনে বসে গল্পে মশগুল হয়ে আয়োজন করে নানারকমের পিঠাপুলির। প্রকৃতির গাছপালাও এ সময় বেশ সজীবতায় দেখা মেলে। পড়ন্ত বিকেলের রোদে ঝিরিঝিরি বাতাসে পাতাদের মাঝে কথোপকথনের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কারণ গাছপালাও তাদের ভাষায় মনের কথা বলে। মাঠভরা ধানের ক্ষেতের রূপ শরতের শেষ বিকেলের প্রাণ হয়ে ওঠে। এসময় শিল্পীরা তুলির আঁচড়ে তুলে আনে বাংলার রূপরেখা তাদের জন্য শরতের সারাবেলা ক্যানভাসের প্লট তৈরির কাজ করে।

শরতের রাতে আকাশ হয়ে ওঠে আলোকময়। জোছনার রূপ প্রকৃতিকে নতুন অবয়বে সাজিয়ে তোলে। মেঘমুক্ত আকাশে যেন জোছনার ফুল ঝরে। এ সময় বকুল ফুল তার গন্ধে মোহিত করে তোলে তার চারপাশ। কত শত গানের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে বকুল ফুল। বকুল ফুলের গন্ধ থেকে যায় শুকিয়ে যাওয়া ফুলেও। চারিপাশে মৌ মৌ গন্ধে মনে হয় যেন আকাশ থেকে কল্পকথার পরীরা ডানা মেলে নেমে আসে পৃথিবীতে। মোহনীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শরতের মেঘমুক্ত আকাশের রূপে মাতোয়ারা হয় ধরণী।

পরিবর্তিত ঋতুতে ফুল ও ফল সৃষ্টিকর্তার এক অমূল্য দান। ফুল যেমন সৌন্দর্যকে ধারণ করে তেমনি ফলের সমাহার ও মানবমনে এক সুখানুভব তৃপ্তিবোধ তৈরি করে সহজেই। তেমনি একটি ফল হচ্ছে তাল, যা কচি থাকা অবস্থায় আঁশারি বা তালশাঁস নামে পরিচিত এবং পরবর্তিতে- শরতেই এটি আঁটি মজবুত করে রস দেয়। ফলে তালের রসের সুঘ্রাণ ভাসে খেজুরের রসের মতোই। অনেকেরই অপেক্ষাকে মিষ্টতা দিতে শরৎ আসে নানাপদের ফলের রসের সংবাদ নিয়ে। চারিদিক তখন পানিতে থই থই অবস্থা। এছাড়াও এ সময়ে আমলকী, জলপাই, অরবরই, করমচা, চালতা, ডেউয়া ফল দেখতে পাওয়া যায়। এ সময়ে ঘরে ঘরে মহিলাদের আচার বানানোর প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় মহা আয়োজনে। প্রতিটি ঘর থেকে নানা সুগন্ধ এসে মনকে ভরিয়ে তোলে। জিভে আসে জল। ঘর যারই হোক না কেন মন ছুটে যায় গন্ধের কাছে। নানরকম আচার ও তালের পিঠার আয়োজনে শরৎ হয়ে ওঠে পূর্ণতার আনন্দের ভালোবাসার। অনেকেরই লেখায় প্রাণ পায় বাংলার অপার সৌন্দর্যের রূপ। শরতের সকাল দুপুর বিকেল ও সন্ধ্যার বিষয় ও বৈশিষ্ট্য অনন্যতায় প্রকাশ পায়। শিশিরের সৌন্দর্য থেকে ফুল, ফল পাখিদের বর্ণনায় শরৎ ঋতু এক আলাদা হয়ে নিজেকে প্রকাশ করে।

Share.

মন্তব্য করুন