পিঁপড়ের একটা লম্বা সারি। অতিক্ষুদ্র এ প্রাণীটি দলবেঁধে একই লাইনে দ্রুত আসা যাওয়া করছে। গাঙপাড়ে ঘুড়ি উড়াতে এসে বালির মধ্যে পিঁপড়ের এমন সারি উপুড় হয়ে দেখছে রাসেল। এরই মধ্যে ছোট একটা পোকা ধরে পিঁপড়েরা দলবেঁধে টেনে এই একই লাইনে এগিয়ে যাচ্ছে। দারুণ মিল পিঁপড়েগুলোর মধ্যে।
রাসেল বিস্ময়ে দেখছে এসব। চমৎকারও লাগছে দেখতে। পাশেই পড়ে আছে ঘুড়ি লাটাই। কাফি এসে মাথায় টোকা দিয়ে বলে, কী রে, উপুড় হয়ে কী দেখছিস?
মাথা না তুলেই উচ্ছ্বাস নিয়ে রাসেল বলে, ‘দ্যাখ দ্যাখ, কী দারুণ! পিঁপড়েরা কী সুন্দর লাইন ধরে চলছে। একদল আবার একটা পোকা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের খাবার। মনে হয় ওদের চিকেন ফ্রাই!’
‘মাথা উঠা। পিঁপড়া দেখতে হবে না। এসব তো কতই দেখি।’
এবার দাঁড়ায় রাসেল। তারপর কাফির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মাথা উঠালাম। এবার কী হুকুম?’
‘শিবলু আসছে না যে?’
‘কী জানি? আসবে হয়ত।’
রাসেল কথাটা শেষ না করতে করতেই রাসেলই চিৎকার দিয়ে বলে, ‘ওই যে আসছে শিবলু।’
তিন বন্ধু পড়ন্ত বিকেলেই এসেছে গাঙপাড়ে ঘুড়ি ওড়াতে। শরতের এ সময়টা হালকা বাতাস আর মেঘ-রোদের খেলায় দারুণ একটা সময় যায়। এসময় ঘুড়ি উড়ানোটাও বেশ মজাদার।
লাটাই ঘুড়ি হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকায় রাসেল। ওমা! এ কি! ওখানেও দারুণ এক দৃশ্য! কড়া নীল আর পরিষ্কার আকাশে সাদা মেঘগুলো দৌড়ে পালাচ্ছে। কোথাও আবার টুকরো মেঘ থমকে আছে। প্রকৃতির অপরূপতায় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রাসেল। ওকে আলতো ধাক্কা দিয়ে কাফি বলে, ‘কী রে, উপরেও মাথা আটকে গেল তোর? ওখানে তো আর পিঁপড়া নেই। নামা মাথা।’
‘আমার মাথা নিয়ে আবার হুকুম, জাঁহাপনা!’
‘আরে ধ্যাৎ! মাথাকে এভাবে উপরের দিকে আটকে রাখতে বলিনি। সোজা হ। ঘুড়ি উড়াবি না?’
‘কিন্তু পিঁপড়ার মতোই মেঘগুলো দৌড়াচ্ছে যে!’
হাসতে হাসতেই কথাটা বলে রাসেল। শিবুল বলে, ‘এসব ঢং বাদ দে। আমি ঘুড়ি উড়ালাম, তোরা মেঘ পিঁপড়া ওসব দেখ।’
শিবলুর কথায় সায় না দিয়ে রাসেল বলে, ‘নিচে পিঁপড়েরা ওপরে মেঘ- সবাই কি একসাথে যুক্তি করে দৌড়ে পালাচ্ছে কোথাও?’
রাসেলের কৌতূহলী এ কথায় কাফি বলে, ‘শরতের প্রকৃতির স্বভাবই এমন। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে বেড়াবে। আর পিঁপড়া? ওগুলো শীতের জন্য খাবার জমাতে ব্যস্ত। দেখিসনি পোকা ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো? এসবই বাংলার শরতের খেলা।’
‘শী-ত…! এই শরতে শীত এলো কোত্থেকে?’
রাসেল চমকানো ভাব নিয়ে বলে। শিবলুও বলে, ‘তাই তো? শীতের খবর এখন কেন? এখন তো শরৎকাল। দেখিস না ওই যে গাঙপাড়ে কাশফুলে ভরে আছে। কী দারুণ সে কাশফুল! আরো দেখ গ্রামের ওই ছাতিম গাছটা। সবুজ মেশানো সাদা রঙে থোকায় থোকায় ছোটো ফুল ফুটে আছে ছাতিম গাছে। শরতের এ ফুলটাও দারুণ না!’
এবার বিজ্ঞের মতো কাফি বলে, ‘শোন্ শোন্। আমরা থ্রি-ফোরে থাকতে একটা ছড়া পড়েছিলাম-
“পিপীলিকা, পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।

শীতের সঞ্চয় চাই
খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
ছয় পায়ে পিলপিল চলি।”
এখন শরতের পরেই হেমন্ত। তারপর শীত। শীতে তো পিঁপড়ারা গর্তে কাটায়। তখনকার জন্যই এখন খাবার জমাচ্ছে। এর আগে গিয়েছে বর্ষাকাল। তখন পানিতে সব ডুবুডুবু। পিঁপড়াদের বাসা ছিল না। এখন প্রকৃতি শুকাতে শুরু করেছে। তাই এ শরৎকাল থেকেই পিঁপড়াদের প্রস্তুতি। বুঝলি, আমাদের মতো অলস না পিঁপড়ারা!’
‘তুই এতো জানলি কোত্থেকে?’
রাসেল-শিবলু একসাথে প্রশ্ন করে। সাথে সাথে কাফি বলে, ‘আমার বড়মামা থেকে। উনি এসব মজার মজার কথা শোনান আমাদের। শরতের ফল নিয়ে মজার একটা ধাঁধা দিয়েছে।’
‘ধাঁধা…! বল তো কী সেটা?’
কাফি বলে, ‘গ্রীষ্মকালে ফলটা ধরে আর পাকে এই শরৎকালে। এটা শরৎকালের ফল। কিন্তু এটা অন্যরকম একটা ফল।’
শিবলু ঘুড়ি উড়াতে উড়াতেই জানতে চায়, ‘কেমন?’
‘গ্রীষ্মকালে যখন ফলটা ধরে তখন আমরা ওটার বিচি খাই, ফলটা ফেলে দেই। আর এখন শরৎকালে আমরা পাকা ফলটা খাই, বিচিটা ফেলে দেই।’
‘কী…!’
দু’জনেই চমকে তাকিয়ে থাকে কাফির দিকে। দারুণ কৌতূহল তাদের মধ্যে। কী ফল- উল্টাউল্টি খাওয়া-দাওয়া? একবার বিচি খাই ফল ফেলে দেই। আবার ফল খাই বিচি ফেলে দেই। ভাবছে দুজনেই। ওদের ভাবনার মাঝেই শিবলু ঘুড়ি উড়াচ্ছে। শরতের মেঘের মতোই ওর সাদা ঘুড়িও আকাশে ছুটোছুটি করছে। রাসেলের ঘুড়ি লাটাই এখনও ওর হাতে। কাফি ঘুড়ি লাটাই আনেনি; ঘুড়ি কেনার টাকা ছিল না ওর কাছে। তাই আজ উড়াবে না।
গাঙের ওপাড়েও অনেকেই ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। কাফি দেখছে আর গুনগুন করে ছড়া কাটছে- “ওই তো ওখানে ঘুড়ি ধরে টানে, ঘোষদের ননী; আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!”
কাফির ছড়াটা শুনে শিবলু বলে, ‘পরের ঘুড়ি ধরে টানাটানি করবি ক্যান? আমারটা উড়া।’ এই বলে লাটাইটা এগিয়ে দেয়। রাসেল বলে, আমিও উড়াব ঘুড়ি, কিন্তু…!
‘কিন্তু কী…!’
শিবলু জিজ্ঞেস করে। রাসেল বলে, ‘কাফির মামার ধাঁধাটাই তো পারছি না। শরতের ধাঁধা।’
শিবলু থেকে লাটাই নিয়ে কাফি উড়াচ্ছে। শিবলু রাসেলেরটা নিয়ে উড়ানো শুরু করেছে। রাসেল আনমনে হাঁটছে আর ভাবছে, শরতের এ ধাঁধার জবাবটা কী হতে পারে?
আচমকাই রাসেল চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘পেয়েছি ধাঁধার জবাব। ভাদ্র মাসে- মানে শরৎকালে পাকে এই ফল। শরতের এই ফল হলো তাল!’

Share.

মন্তব্য করুন