আমাদের নতুন বন্ধু

আমাদের ইশকুলটা উঁচু পাহাড়ের একেবারে চূড়ায়। দূরে শিংঅলা ষাড়ের মতো যে মেঘের চূড়া দেখা যায়, তা আসলে মেঘ নয়, আমাদের ইশকুলের টিলা। ওরই পাদদেশে একটা নদী আছে। নদীর অবশ্য ভালোমন্দ কোনো নাম নেই। আমরা বলি ছড়া। আগে একটু বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি এই নদীতে ঢল নামতো। এখন আর তেমন নেই। মরা মরা দশা। বর্ষা মৌসুমে তবু পাহাড়ের ঢাল ভাঙে। ওই অল্প ক’দিন। তারপরই আবার যেইসেই। নদীতে পানি থাকে না। ফলে বাঁধ দিয়ে, দমকল লাগিয়ে ক্ষেতের জন্য পানি তুলতে হয়। নদীটা কখনও পাহাড়ের পায়ে পায়ে আবার কখনও বিস্তৃত বিলের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর। লোকে বলে এটি নাকি তিস্তা হয়ে ঢুকে গেছে ভারতের ভেতরে। আমরা ছোটো মানুষ সত্যাসত্য খতিয়ে দেখিনি কখনো।

একদিন অবশ্য আমরা ক’য়েকজন বন্ধু মিলে ভারতের বর্ডার দেখার জন্যই কেবল ইশকুল পালিয়েছিলাম! তারপর তো সকাল থেকে ধরে একদম বিকেল পর্যন্ত একটানা হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি বর্ডারের প্রায় কাছাকাছি। ঠিক তখনই বিপত্তি বাঁধালো রাশেদ। তার এক কথা, সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে হবে। আরে, একদিনই তো। একদিন একটু দেরিতে বাসায় ফিরলে কী হয়? কত করে বুঝালাম ওকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। ওর এক কথা, বাসায়ই ফিরতে হবে। ক্লাসের ফার্স্টবয় ও। ভালো ছেলে। ভালো ছেলেদের সঙ্গে নিলে আর কোনো আনন্দ থাকে? এদিক থেকে অয়নের কোনো তুলনা নেই। যে কোনো ট্যুরের ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া ও। ও বললো, ‘দ্যাখ রাশেদ, আমরা তো চলেই আসলাম কাছাকাছি। এই তো আরেকটু। জাস্ট বর্ডারটা দেখেই আমরা চলে আসবো। আজ নাহয় একটু দেরিতেই বাসায় ফিরলি।’ না, তা হবে না। ওই যে খুটা সে গেড়েছে, ওখান থেকে কেউ আর ওকে নড়াতে পারবে না। এরকম সময় পাশের গোলঘর থেকে আসলেন একজন দাড়িওয়ালা বিডিআর সদস্য। ডিউটিরত আছেন তিনি। আমাদের দেখে বললেন, ‘এই বাবারা, কোত্থেকে আসছো তোমরা?’
আমাদের মধ্যে সবচে বেশি সাহস রাকিবের। সে বললো, ‘খেদাছড়া থেকে আসছি আঙ্কেল।’ ওর বলার ঢঙ দেখে মনে হচ্ছে, একজন বিডিআর সদস্যের সঙ্গে কথা বলতে পারাটা একটা বীরত্বের বিষয়।
‘তা, কোথায় যাচ্ছো তোমরা?’
‘একটু বর্ডার দেখতে যাচ্ছি আঙ্কেল।’
‘কোথায়?’ কিছুটা অবাক হয়ে রাগত স্বরে বললেন তিনি।
এবার কিছুটা আমতা আমতা করে হাত কচলাতে কচলাতে রাকিব তার জবাবের পুনরাবৃত্তি করলো।
‘তোমরা জানো, ওখানে যে গোলাগুলি হয়? বাংলাদেশের মানুষজনকে গুলি করে দেয় বিএসএফ, জানো তোমরা?’
এ ব্যাপারটা আমি একটু একটু জানতাম। তবু কেউ কিছু বলার আগে আমিই বলে ফেললাম, ‘স্যার, এ ব্যাপারটা আমাদের জানা ছিলো না।’ একটু অসত্য হয়ে গেলো! মনে মনে জিব কাটি আমি।
‘আচ্ছা, তোমরা আসো সবাই, আমার সাথে আসো।’
আমরা সবাই তার পিছুপিছু গোলঘরে ঢুকলাম। তিনি তার ওয়াকিটকিতে কী যেন বললেন কোথায়। বেশিক্ষণ বসে থাকতে হলো না। একটু পরই একটা জিপ আসলো। আমাদের সবাইকে সেই জিপে উঠতে হলো। এর আগে সবারই নাম এন্ট্রি করে নিলেন ওই বিডিআর আঙ্কেল।

বিডিআরের গাড়ি পাহাড়ি পথ ধরে চলছে খেদাছড়ার দিকে। আমার খারাপ লাগছিলো খুব। একটুর জন্যই তো বর্ডার দেখা হলো না। মন খারাপ সবারই। কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। তবে রাশেদের চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। সন্ধ্যার আগে সে বাড়ি ফিরতে পারবে, এজন্যই বোধহয়।
এ মুহূর্তে আমি শাকিলের অভাব বোধ করছি খুব। ওর বাবা বিডিআরের লোক। আজ ও আমাদের সাথে থাকলে ভারত দেখা কেউ ঠেকাতে পারতো না। অবশ্য সে আমাদের সাথে আসতোই না। ওরও ওই এক সমস্যা- ভালো ছাত্র।
আমরা গাড়ি থেকে নামলাম বিডিআর জোনের চেকপোস্টের সামনে। গোলঘরে বসিয়ে রাখা হলো আমাদের। একটা খাতা এনে আমাদের সবার নাম ঠিকানা সব এন্ট্রি করা হলো আবারও। এন্ট্রির কাজ শেষ, তবুও আমরা বসে আছি। রাশেদের চেহারা আগের মতো হাস্যোজ্জ্বল নেই আর। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কী যেন বললো ও। আমি কিছুই বুঝি নাই। তারপর পাশের জনকে বললো ও। আস্তে আস্তে সবারই চেহারা বিবর্ণ হতে থাকলো। এখানে কানাকানি করাটা দেখতে অসুন্দর। এজন্য আমি আর কিছু বললাম না। চুপচাপ বসে আছি। রাশেদ আবারও আমার কানের কাছে মুখ আনলো। বললো, ‘আমরা অ্যারেস্ট, বুঝলি! এখন কী হবে? আমাদের বাড়িতে কী খবর গেছে, কী জানি!’
‘যাহ, বিডিআরের কাজ কি অ্যারেস্ট করা নাকি?’
‘সব যদি পুলিশেরই কাজ, তাহলে এরা কি সীমান্তে বসে বসে আঙুল চোষে?’
এবার ভয়ের একটা শীতল স্রােত আমাকেও প্রায় অবশ করে দিলো। আমি রাশেদকেও আর কিছু বললাম না। চুপচাপ বসে আছি। আবারও গোলঘরে আসলো সেই বিডিআর সদস্য, যিনি একটু আগে এসে আমাদের নাম এন্ট্র্রি করে নিয়ে গেলেন। এসেই বললেন, ‘এই, তোমরা সবাই ওঠো। আমার সঙ্গে এসো।’
রাকিব বললো, ‘আমাদের কোথায় নেবেন স্যার?’
উনি কোনো জবাব দিলেন না। তবে একটু হাসলেন শুধু। এরকম হাসির অর্থ বের করা কঠিন।
আমরা উনার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গিয়ে একটা লম্বা টিনশেড ঘরের বারান্দায় উঠলাম। তারপর সবাই জুতা খুলে খুলে উনার পেছন পেছন ঢুকে পড়লাম একজন অফিসারের কক্ষে। ঢুকেই দেখি অফিসারের সামনের চেয়ারে আমার, রাশেদের, রাকিবের আর অয়নের বাবা বসে আছেন। তাদের চেহারার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার মতো না। যদিও অফিসার সাহেব তাদের সাথে অনেকটা খোশগল্পে মেতে আছেন। আমরা ঢোকার পর তিনি আমাদের দিকে মনোযোগ দিলেন। একে এক প্রত্যেকের নাম জিজ্ঞেস করলেন। এবং নানান প্রশ্ন করলেন। আমরা সবাই মোটামুটি বলে যাচ্ছি। হুট করেই একটা জিনিশ আমার মাথায় কাজ করলো, আর তা হলো- আমাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তার কারণ আমাদের বাবাদের উপস্থিতি। গ্রেফতার করা হলে বাবাদের এভাবে ডাকা হতো না। তাছাড়া আমরা অমন কী অপরাধই বা করেছি, যে কারণে গ্রেফতার করতে হবে! ভেতরে সাহস ফিরে এলেও বাবার দিকে একদমই তাকাচ্ছি না। লজ্জায়, অনুতাপে। এখান থেকে অল্পে ছাড়া পেলেও বাসায় গেলে নিশ্চয় বানানি খেতে হবে। তা হোক, তবু তো ছাড়া পাচ্ছি। একে একে আমি সবার দিকেই একবার চেয়ে নিলাম। সবাই চিন্তিত। চেহারা বিমর্ষ সবার। রাকিব দেয়ালের পাশ থেকে সরে আমার পাশে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। হাতের আঙুলে চাপ পড়তেই আমি ওর দিকে তাকালাম। পুরো ঘরে একবার চোখ ঘুরিয়ে এনে ও আমার চোখে তাকালো। ঠোঁট বাঁকা করে চোখের ইশারায় যা বললো তার অর্থ দাঁড়ায়- খালাশ! মানে আজকের মতো ছাড়া পাচ্ছি।

একপর্যায়ে আমরা যখন ঠিকঠিক ছাড়া পেলাম তখন সন্ধ্যা। আব্বু বাজারে যাবেন। আমাকে বললেন, ‘যা, সোজা বাড়ি যা। তোর মা চিন্তা করতেছে। বাড়ি গিয়া পড়তে বস।’ আমি হ্যাঁ-বোধকভাবে ঘাড় কাত করে বাড়ির দিকে ফিরলাম। আব্বু হাঁটা দিলেন বাজারের দিকে। যেতে যেতে আমি রাকিবের দিকে একবার তাকালাম। সে তার আব্বুর পেছন পেছন হাঁটছে। আমি ইচ্ছে করে বড় করে একবার কাশি দিতেই রাকিব ফিরলো আমার দিকে। একটু হেসেই ইশারায় বুঝিয়ে দিলো- বাড়িতে গেলে আজ ভালোরকম বানানি খেতে হবে। আমি ভরসা দেবার মতো করে হাত নেড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পথঘাট আলো থাকতেই বাড়িতে পৌঁছতে হবে। সন্ধ্যাটা একদমই ভয়ের। আকমত পাড়ার চালতা গাছটাতে ভূত থাকে। বেতঝাড়, খালপাড়, বটগাছ, পুরানবাড়ি- এসব জায়গাগুলোতে ভূত থাকে। আমাদের পাড়ার অনেকেই দেখেছে। মোফাজ্জল আঙ্কেলের মতো দাড়ি পাকা মুরব্বি মানুষও নাকি একরাতে বাজার থেকে ফেরার পথে খালপাড়ে ভয় পেয়েছিলেন। তিনি আনমনে টর্চ মেরে মেরে আসছিলেন। হঠাৎ দেখেন অনতিদূরে পথের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ধবধবে শাদা দাঁত বের করে কেউ হাসছে। সেই হাসিতে শাদা দাঁত থেকে আলো বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার সারা শরীরে। শরীরের অবয়ব দেখে মুহূর্তেই বোঝা যায়- এ এক নারী। তার মাথার চুল পা পর্যন্ত নেমে মাটিতে হিঁচড়ে যাচ্ছে। মুরব্বির তো ভয়ে কুঁকড়ে যাবার দশা। তিনি তার ছয় ব্যাটারির টর্চের আলো মেয়েলোকটির গায়ের উপর স্থির করে ভয়ে কাঁপছেন। মেয়েলোকটি সমানে হাসছে। কলজে কাঁপানো হাসি। সেই সঙ্গে তার ভয়ঙ্কর অবয়ব। মুরব্বির কোনোদিকে পা দেবার সুযোগ নেই। না সামনে-পেছনে, না ডানে-বাঁয়ে। রাত গভীর। মানুষজন নিশ্চয়ই সবাই ঘুমোচ্ছেন। তবু গায়ের সমস্ত জোর গলায় এনে মোফাজ্জল আঙ্কেল ডাকলেন- ‘আকমত ভাই, ও আকমত ভাই…।’ ওদিকে মেয়ে লোকটি সমানে হেসে যাচ্ছে। কখনও পেছন ফিরছে। পেছন ফিরলে তার সমস্ত চুল- মাথা থেকে মাটি অবধি কুচকুচে কালো দেখা যাচ্ছে। আবার যখন সামনে ফিরে হাসে তখনও তার মাথার চুল বুক-পিঠ বেয়ে পা অবধি। মোফাজ্জল আঙ্কেল সমানে ডেকে যাচ্ছেন- ‘আকমত ভাই, ও আকমত ভাই…।’ একসময় দা-লাঠিসোটা আর টর্চ নিয়ে আকমত মেম্বারের বাড়ি থেকে লোকজন বেরুলে মেয়েলোকটিকে আর পথে দেখা যায় না। তার বদলে একটা কুকুরের মতো প্রাণীকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
এছাড়া আরো কতো কতো ভয়ের ঘটনা আছে। যে কারণে পারতপক্ষে কেউই রাতে বাজার থেকে একা একা বাড়ি ফেরে না। পাড়ার লোকজন মিলে দলবেঁধে আসেন। কারো হাতে ভালো টর্চ থাকলে তো হলোই। না থাকলেও অন্য ব্যবস্থা থাকতো- আগুনের মশাল। মশাল শুধু আলোই দেয় তা না, বরং এ জিনিশ সঙ্গে থাকলে ভূত তো ভূত, ভূতপ্রেতের বাপও কাছে ঘেঁষতে পারে না।
বাড়িতে গিয়ে উঠান থেকেই শুনি আমার ভাইবোনরা সবাই পড়ছে। ছোটভাইটা চেঁচিয়ে পড়ছে-
‘আমপাতা জোড়া জোড়া
মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া
ওরে বুবু সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া।’…
ছোট আপা তিনবছর ধরে একই ক্লাসে। সেও ওইরকম আওয়াজে পড়ছে-
‘নারকোলের ওই লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা গোলগাল
সিটকিনিটা আস্তে খুলে…।’
সিটকিনি খোলাই ছিলো। আমি দরজা ঠেলে আস্তে ঘরে ঢুকলাম। আমি ঢুকতেই ওদের সবার যেন সুইচ অফ হয়ে গেলো একসাথে। একযোগে সবাই চুপ! আমার দিকে চারজোড়া চোখ একসাথে চেয়ে আছে। মেজো আপু প্রথমে মুখ খুললো- ‘কি খবর, কই গেছিলা? বিডিআররা পাইলো কই? ভারত যাইতে লইছিলা? বা-বা-বা…। আব্বু কিছু কয় নাই? আম্মু…!’
ওদিকের রুম থেকে তসবিহ ঘোরাতে ঘোরাতে আম্মুও এসে হাজির। আমি তো পুরোদস্তুর আসামি। মেজো আপুর দিকে চেয়ে তার কথার জবাবে বললাম, ‘না।’
মেজো আপু আম্মুর দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ‘এই যে তোমার বীর বাহাদুর ছেলে!’
‘বিডিআররা কিছু কইছে?’ মা জিজ্ঞেস করলেন আমাকে।
‘না।’
‘মানে গায়ে হাতটাত দিছে তোগো কারো?’
‘না।’
আম্মু কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তারপর বললেন, ‘পোলাপানের সাহস কত! বাড়িতে না জানায়া আবার কোনোদিন কোথাও যাইস তখন বুঝবি।’
পড়াশোনা শেষ করে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে সেদিনের মতো ঘুমাতে গেলাম। বাতি নেভানোর সময় টের পেলাম আব্বু বাজার থেকে ফিরেছেন। আমি কান পেতে আছি, কী বলেনটলেন তা শোনার জন্য। বিশেষ করে আমাকে নিয়ে কিছু বলেন কিনা। আব্বু ফ্রেশ হয়ে ভাত খেতে বসলেন। এক পর্যায়ে আম্মুই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হইছে বিডিআর ক্যাম্পে?’
এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। আমি কান পেতে মশারির নিচে বসে আছি। একটু পরে আব্বু বললেন, ‘পায়ে শিকল লাগাইয়া ঘরে বাইন্ধা রাখবা। পড়ালেখা লাগবে না।’
এই কথা শুনে আমার ভয় পাবার কথা। কিন্তু আমি হেসে ফেললাম। কারণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আব্বু এরকম রাগের কথা বলেন। তবে এটুকু বোঝা হয়ে গেলো যে, আমাদের মতো ছেলে মানুষদের ওরকম দূরে কোথাও যাওয়া ঠিক নয়। বিপদ-আপদের হাত-পা নেই তো! তাছাড়া সীমান্তে নাকি গোলাগুলি হয় এবং বাংলাদেশীদের ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। খুবই ভয়ের কথা। নিজেদের হঠকারিতার কথা ভেবে লজ্জা হচ্ছে খুব। কাল ইশকুলে গেলে রাশেদ-শাকিলদের অনেক ঠাট্টা-টিটকারি হজম করতে হবে। অবশ্য ওসব উড়িয়ে দেবার জন্য রাকিব একাই যথেষ্ট।
আযম স্যার একদিন বলেছিলেন, মানুষ নাকি নেতৃত্বগুণ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। এই গুণসম্পন্ন লোক যেখানে থাকবে সেখানেই নেতৃত্ব দেবে। রিকশা চালালে চালকদের নেতৃত্ব দেবে, বখাটে হলে বখাটেদের নেতৃত্ব দেবে; মোটকথা সে নেতৃত্বই দেবে।

আমাদের ছোট মাথায় এইসব জিনিশ ভালোমতো ঢোকার কথা নয়। কিন্তু আযম স্যারই একদিন রাকিবকে উদ্দেশ্য করে এসব কথা বলেছিলেন। এও বলেছিলেন, এই ছেলে বড় হলে নেতা হবে। অবশ্য সে এখনও তো নেতাই। তখন থেকে ক্লাসের অনেকইে ওকে নেতা বলে সম্বোধন করে, বিশেষ করে মেয়েদের বড় একটা অংশ।
রাকিব আমাদের ভালো বন্ধু, কিন্তু আমরা কখনোই ওকে নেতা বলি না। বলি না অবশ্য আমাদের ঈর্ষা থেকেই। কাল যখন রাশেদ-শাকিলরা আমাদের বর্ডার দেখতে যাওয়া নিয়ে টিটকারি করবে, তখন রাকিবই ওদের জব্দ করতে পারবে। কিন্তু ঝামেলা আরও একটা আছে। আর তা হলো- ইশকুল পালানোটা। স্যাররা কিছু না বললেই হয়। রাশেদটাকে সাথে না আনলেই বাঁচা যেত। ও ক্লাসের ভালো ছাত্র। এরকম ছাত্ররা ক্লাসে না থাকলে স্যাররা খোঁজ নেন। কী জানি আজকে খোঁজ নিয়েছিলো কিনা। সেটা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। নানান দুশ্চিন্তার মাঝেই কখন যেন ঘুম চলে আসলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম- আযম স্যার আমাদের সবাইকে নিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে গান প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। আমাদের ইশকুল পালানোর কথাও তুললেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, আমাদেরকে মারধোর করলেন না, বকলেন না! বললেন, ‘এসব করে কেন তোমরা নিজেদের ক্ষতি করছো। এখন বুঝবে না, বড়ো হলে আফসোস করবে এই দিনগুলোর জন্য।’
হিশাব করলে রাতের স্বপ্নটা খুব খারাপ দেখিনি। স্বপ্নের ভেতর বিপদের ঘনঘটা নেই।

ক্লাসের প্রথম ঘণ্টা শেষ হয়ে গেছে। গতকালকের, মানে ইশকুল পালানোর প্রসঙ্গই ওঠেনি। তারপর দ্বিতীয় ঘণ্টা, তৃতীয় ঘণ্টা, লেইজার…। নাহ, বাঁচা গেলো মনে হয়। গতকালকের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা নিজেদের মধ্যে টুকটাক হয়েছে। হাসি-ঠাট্টাও। কিন্তু রাশেদ-শাকিলের ব্যাপারে যেরকম ভেবেছিলাম তা করেনি ওরা। ফলে রাকিবেরও কোনো শব্দ খরচ করতে হয়নি। অবশ্য রাকিবকে আজ বাগেই পাওয়া যাচ্ছে না। সে তার এক কাজিনকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। কাজিনটা এসেছে চট্টগ্রাম শহর থেকে। তিন-চারমাস পর তার বাবা-মাও নাকি আসবে। আমাদের ইশকুলে, এমনকি আমাদের ক্লাসেই নাকি ভর্তি হবে ছেলেটা। ছেলেটা বলছি, কারণ ওর নাম এখনও আমার মুখস্থ হয়নি। বাংলা স্যার ওকে যখন দাঁড় করিয়ে পরিচয় জিজ্ঞেস করেছেন, তখন ও নামধাম সবই বলেছিলো। কিন্তু এখন আমার মনে নেই।
রাকিবদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। বিকেলে আমরা যেখানে ডাংগুলি খেলি সেই জায়গাটা নদীর পাড়ে। নদীটাকে আমরা বলি ছড়া। এই জায়গাটা রাকিবদের বাড়ি থেকে যতদূর আমাদের বাড়ি থেকেও প্রায় ততদূর। সবচেয়ে কাছে জসিমদের বাড়ি। ছড়ার প্রায় কাছেই। বর্ষার ভরা মৌসুমে নদীর পানিতে আশেপাশের ধানক্ষেত পুরোপুরি ডুবে যায়। জসিমদের বাড়িটাকে তখন বিরাট একটা ফেরির মতো লাগে। বাঁশের, নারিকেল গাছের কিংবা কলাগাছের ভেলা বানায় ওরা। সেগুলোতে বাড়ির মুরব্বিরা একান্ত দরকারেই কেবল পারাপার হয়। কিন্তু ভেলায় চড়ে জসিমরা সারাদিনই ধানক্ষেতের ভেতর মাছ ধরে বেড়ায়। আমরাও মাঝেমাঝে জসিমদের ভেলায় চড়ি। ভীষণ আনন্দ হয় তখন। সবচে’ বেশি মজা নেয় রাকিব। সে ওপাড় থেকে, মানে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে দু’হাতের তালু মুখের কাছে চোঙ্গার মতো করে ধরে চেঁচায়, ‘জসিম, মানিক…!’
ভেলা থেকে আমরাও চেঁচাই, ‘রাকিব…! তুই ওইখানে দাঁড়া…। আসতেছি…!’
‘প্লিজ…!’ ভেলা কাছাকাছি গেলেই রাকিব মজা করে জসিমের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে-
‘ফেরি মি অ্যাক্রোস দ্য ওয়াটার,
ডু বোটম্যান, ডু!’
ওর বলার ঢঙ অসাধারণ! আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে ফেলি ওর ডায়ালগ শুনে। এই ইংরেজি কবিতাটা আমরা ক্লাস ফাইভে পড়ে এসেছি। রাকিবের মুখস্থ আছে দেখে হিংসা হলো কিছুটা। জসিম বলে, ‘তুই নাটকের দলে ঢুকে যা রে রাকিব। ভালো করবি।’ কিন্তু রাকিব খুব সিরিয়াস মুডে থাকে। এসব কথা সে গায় মাখে না। লগিতে ভর দিয়ে ভেলায় চড়ে বসে।

এসবই বর্ষা মৌসুমের কথা। এখন বর্ষা নয়। ছড়ার পাশের ধানক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে আছে। এরইমধ্যে খুব সামান্য পরিমাণে সবুজ ঘাসও আছে। ঘাস বেশি আছে ছড়ার পানির পাশে। কিন্তু সমস্যা হলো- গরুকে ওসব পানির ঘাস ছোঁয়ানোই যায় না। ফলে ঝুড়িভর্তি করে শুকনো জায়গার ঘাস কেটেও বাড়িতে নিতে হয়। ওই ঘাস রাতের বেলা গরুর সামনে দিলে যার যা প্রয়োজন, পেটে যেটুকু ক্ষুধা আছে- সেই মতো খেয়ে নেয়। ইশকুল থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে তারপর আমরা খাঁচা নিয়ে বের হই। আমরা মানে- জসিম, রাকিব আর আমি। ততক্ষণ সবার সবগুলো গরুই খুটোয় বাঁধা থাকে। ঘাস কাটা শেষ হলে আমরা গরু ছেড়ে দিই এবং চোখে চোখে রাখি। আর এই সময়টাতেই আমরা ছড়াপাড়ের জাম গাছের ছায়ায় ডাংগুলি খেলি।

হিশেব করলে জসিমের বাড়ি আমাদের দু’জনের বাড়ির মাঝামাঝি জায়গায়। একারণেই প্রায় দিন ও আমাদের দু’জনকে ডেকে নেয়। ইশকুলে যাওয়ার সময় অবশ্য রাকিবকে ডাকে না। আমাদের বাড়ির পাহাড়ের নিচে এসে শুধু আমাকে ডাকে। কখনও আমিই আগে ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। তারপর দু’জনই চলে যাই রাকিবদের বাড়িতে। সেখান থেকে তিনজন ইশকুলের দিকে রওয়ানা হলে পথে পথে আরো অনেক বন্ধু জুটে যায়। দল বড় হতে থাকে। গল্প করতে করতে আমরা পৌঁছে যাই ইশকুলে।
আজ আমাদের ডাংগুলি খেলা বেশিক্ষণ হয়নি। অন্য একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। রাকিব তার কাজিনটাকে নিয়ে মাঠে এসেছে। ওর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হলো। নাম শওকত। কালই আমাদের ইশকুলে ভর্তি হতে যাবে। আমাদের ডাংগুলি খেলাটা ওর মনে ধরেছে। এই খেলা সে শহরে কোনোদিন খেলেনি। এমনকি এর নামও নাকি শোনেনি। শহরে সে ক্রিকেট-ফুটবল এইসব খেলে। রাকিব বলেছে ব্যাটিংয়ে নাকি ও ওস্তাদ।

বিকেলের মধ্যেই শওকত আমাদের ভালো বন্ধু হয়ে গেলো। চমৎকার গল্পবাজ ছেলে। পুরো আড্ডা জমিয়ে ফেলতে পারে। ওর কিছু কিছু গল্প অবশ্য বিশ^াস হয় না আমার। যেমন, সে বললো- একবার নাকি ওকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। ওইটুকু ছেলে, তাকে পুলিশে ধরবে কেন? কারণটা আরও অবিশ^াস্য। সে নাকি শহরের উঁচু একটা দালানের দেয়াল বেয়ে বেয়ে আটতলা পর্যন্ত উঠে গেছিলো! এরকম কথা কেউ শুনেছে কখনও? জসিম ওকে থামিয়ে দিলো- ‘আরে থাম থাম, আমাদের বোকা পেয়ে চাপা মারছিস- না!’ জসিমের চেহারায় বিরক্তির ছাপ। কিন্তু রাকিবের কৌতূহল চরমে। সে বললো, ‘কই, একথা শুনিনি তো কখনও!’
‘হা হা হা…।’ শওকত লম্বা করে হাসলো। তারপর আবার বলতে থাকলো, ‘শুনবি কী করে। সেই ঘটনার পর থেকে তো আব্বু-আম্মুই আমাকে নজরবন্দি করে রাখছে। এই ঘটনা তারা কাউকেই বলেন না। এমনকি আমার বন্ধুদেরও বলে দিয়েছে- আমি যদি আবার কখনও কোনো বিল্ডিংয়ে উঠতে যাই তাহলে যেন তারা আব্বু-আম্মুকে জানায়। বিরাট ঝামেলা না! কই বাহবা দেবে কেউ এসে, তা না। আরে আমাকে গ্রামেও তো পাঠাচ্ছে শুধু এই কারণে। গ্রামে তো উঁচু উঁচু বিল্ডিং নাই, সেজন্য। তোরা জানিস, এরকম কেউ বিদেশে করতে পারলে, মানে বিল্ডিং বেয়ে উঠে দেখাতে পারলে তার কত নাম হতো!’
‘তার আছে, মাথায় তার? নাকি সব ক’টা ছিঁড়া গেছেগা? পাগলামি করে নাম করার শখ কত, বাহ!’ জসিম বললো। রাকিব আর আমি হেসে উঠলাম। শওকত হাসলো না একদম। সে সিরিয়াস মুডে আছে। তবে আর কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। শওকতের কথা শুদ্ধ এবং প্রায় প্রমিত। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার টানটোন নেই। ও আসলে আমাদের গ্রামেরই ছেলে। খুব ছোটকালে বাবা-মা’র সঙ্গে শহরে পাড়ি দিলেও আঞ্চলিক এবং শুদ্ধ দু’টোতেই সে অভ্যস্ত। আমরা যেমন গ্রাম্য ভাষায় কথাবার্তা বলি, শওকত সেরকম নয়। তার ভেতর একটা বাবু বাবু ভাব। শহুরে পোশাকআশাক। তাছাড়া আমাদের মতো রোদেপোড়া চেহারাও ওর নয়। ফর্সা, গোলগাল, দুরন্ত- তবে সামান্য চিকনা কিসিমের। ওর সঙ্গে মিশতে আমাদের কেমন একটু শরম শরম লাগলেও অল্প দিনেই ও আমাদের খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলো। এরইমধ্যে সে আমাদের সঙ্গে পাহাড়ে পাহড়ে ঘুরে বেড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে আমরা অবাক হয়ে একটা জিনিশ আবিষ্কার করলাম। আর তা হলো- ওর গাছ বাওয়া। আমাদের চেয়ে ভালো গাছ বাইতে পারে ও। বরং ওর তুলনায় আমরা কিছুই না। আরও কিছুদিনের মধ্যে মনে হলো- গাছ বাওয়ায় শওকতের যোগ্যতা বানরের কাছাকাছিই! বানর যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে ওঠে, তেমনই অনেকটা। আমার কেমন যেন ওর বিল্ডিংয়ের দেয়াল বেয়ে ওঠার গল্পটা বিশ্বাস হতে লাগলো। সে কথা জসিমকেও বললাম একদিন। জসিমও বললো, ‘হ্যাঁ, হতে পারে। কিন্তু তোর কি মনে হয় না গাছ বাওয়ার চেয়ে বিল্ডিং বাওয়া কঠিন এবং অসম্ভব?’
‘আরে, ওরকম গাছ বাওয়াও কি মানুষের পক্ষে সহজ, না সম্ভব?’
এবার যেন জসিমও কিছুটা বিশ^াস করলো। বললো, ‘ও পড়ালেখায় কেমন রে? এরকম করলে পড়েটরে কখন? নাকি আমাদের মতো ভোঁ-ভোঁ?’ বলেই একা একা হাসলো জসিম। আমার কিন্তু একদমই হাসি পেলো না। বললাম, ‘রাকিব বলেছে পড়াশোনায় নাকি ভালোই।’
‘প্রথম সাময়িকেই বোঝা যাবে সেটা।’
‘আরে ভাই, তোর-আমার চেয়ে ভালো ও, দেখিস। গত রবিবারের অঙ্ক ক্লাসের কথা মনে আছে তোর? স্রােতের অনুকুল-প্রতিকুলের একটা অঙ্ক পুরো ক্লাসে মাত্র দুইজন ছেলে করতে পারছে। তার একজন রাশেদ, আর অন্যজন এই শওকত। খোঁজ-খবর রাখিস কিছু?’
‘তা ঠিক বলেছিস। তবে প্রথম সাময়িক পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই পুরো ব্যাপারটা বোঝা যাবে।’
‘তবে যা-ই বুঝিস, এই ছেলে কিন্তু আলাদা। অঙ্ক স্যার, বাংলা ম্যাডাম এমনকি হেডস্যারও ওকে দেখতে পারে খুব।’
‘এসবই ভালো। কিন্তু এই গাছটাছ বেয়ে কোন বিপদ বাঁধায় কে জানে! ব্যাপারটা রাকিবকে বলে রাখিস।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস। প্রথম দিন, মানে ছড়ার পাড়ে যেদিন আমরা ওর সঙ্গে পরিচিত হলাম সেদিনই কিন্তু ও বলেছিলো- ওর আব্বু-আম্মু নাকি ওকে চোখে চোখে রাখে।’
‘ওরকম করলে তো সত্যি বিপদ! আরে ভাই, তুই বিল্ডিং বা’স ক্যান? এটা কোনো প্রতিভা হলো নাকি? না এটা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ?’
জসিমের কথা শুনে না হেসে পারা যায় না। বললাম, ‘শওকত বলছিলো না বিদেশে হলে নাকি ওকে ব্যাপক কদর করা হতো! মনে আছে তোর?’
‘কদর না ছাই- পশ্চাৎদেশে ডাণ্ডা মারা হতো, যেমন চিটাং (আমরা চিটাগংকে ‘চিটাং’ বলি) শহরের পুলিশ ওকে মেরেছে।’
‘এই, মেরেছে কে বললো?’
‘তা পুলিশে ধরে নিয়ে কদর করেছে খুব, না? হা হা হা…।’
‘হা হা হা…।’
আবার হাসলাম আমরা।

দেখতে দেখতে আমাদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। ইশকুলের পরীক্ষাগুলোতে একটা কমন দৃশ্য হচ্ছে- ক্লাসের পড়াশোনায় যারা অতি দুর্বল তারা পরীক্ষার হলে ভালোদের- মানে মেধাবীদের আশেপাশে বসে। এজন্য অবশ্য আগে থেকেই ওরা ভালো ছাত্রদের সঙ্গে খাতির জমায়। তাদেরকে আইসক্রিম, কেক, বিস্কুট, টিফিন-নাস্তা- এসব খাওয়ায়। গলায় হাত দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে। প্রতিদিন ইশকুলে আগেভাগে গিয়ে ভালো সিট ধরে রাখে। মেধাবীদের অবশ্য কোনো টেনশন থাকে না সিট ধরার। তারা জানে তাদের জন্য একাধিক জন ভালো সিট, মানে সামনের সিট ধরে রেখেছে। স্বাভাবিক কারণেই ইশকুলে মেধাবীদের সাঙ্গপাঙ্গেরও অভাব পড়ে না। তবে একটু মাত্র জ¦ালা আছে, তা পরীক্ষার হলে। ওরা এসে উঁকিঝুকি মেরে খাতা থেকে একটু আধটু টুকে নেবে। তাতে নিষেধ করা যাবে না। চক্ষুলজ্জার ব্যাপার। মেধাবীরা বিরক্ত হলেও নিষেধ করে না। কারণ তারা জানে, এরা তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। ওরা পুরো তিনঘণ্টা ধরেও যদি দেখে দেখে লিখতে থাকে, তবু ওর ধারেকাছেও আসতে পারবে না। ফলে ওরা উঁকিঝুকি মেরে লিখতে থাকে আর শিক্ষকদের চোখে পড়ে শাস্তি পেতে থাকে। এবং কখনও কখনও বহিষ্কারও হয় ওরা। আমাদের ক্লাসের ভালো শিক্ষার্থী শাকিল, রাশেদ আর শিমু। গত পাঁচবছর ধরেই শিমুর রোল এক। শাকিল দুই, রাশেদ তিন। তারপর আরেকটু নিচের দিকে আমরা। আমরা মানে, আমি আর রাকিব। জসিমের রোল আরও নিচের দিকে। ও আমাদের বন্ধু হলেও ক্লাসে গিয়ে পেছনের বেঞ্চিতে বসে। কিন্তু শওকতের ঘটনা আলাদা। তার ভর্তি রোল আটানব্বই। কিন্তু সে ফার্স্ট বেঞ্চেই বসে প্রতিদিন। কারো কোনো দেনদরবারে কাজ হয়নি। এমনকি সে এই ব্যবস্থা করেছে যে, ক্লাস-ক্যাপ্টেন আর সে- এই দু’জনই প্রতিদিন ফার্স্ট বেঞ্চে বসবে। তবে পড়াশোনার ব্যাপারে সে একদিনও এমন কিছু করেনি যে কারণে তাকে খুব মেধাবী ভাবা যায়। তবে পরীক্ষার হলে সে খবরও চাউর হয়ে গেলো। আমরা অবশ্য এর আগে ওর ব্যাপারে কোনোকিছু টেরই পাইনি। কারণ ওর সিট পড়েছিলো অন্য হলে। অংক পরীক্ষার দিন হেডম্যাডাম এসে শিমুর খাতা দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাদের দিকে ফিরে বলতে লাগলেন, ‘তোমাদের ক্লাস এইটের ওই নতুন ছেলেটার নাম কী যেন? ক’দিন আগে ভর্তি হলো যে…!’
রাশেদ বললো, ‘ম্যাডাম, শওকতের কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ শওকত! চমৎকার ছেলে ও। পরীক্ষার হলে একদমই কোনো দিকে তাকায় না। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো- প্রায় এক ঘণ্টা হাতে থাকতেই ওর পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। আজ তো নিজেই দেখলাম। এর আগে আযম স্যার, রহিম স্যার তারাও একই কথা বলেছেন। কী অংক পরীক্ষা আর কী ইংরেজি- প্রায় কাছাকাছি সময়ে তার হান্ড্রেড অ্যানসার হয়ে যায়। এই পুরো সময়ে সে কারো দিকে তাকায়ই না। হাতের লেখা একটু মশকরা। নইলে খুব ভালো একটা ছেলে ও। তোমাদের হলে আসলে দেখি- সবাই শুধু এদিক ওদিক তাকাও। প্রয়োজনে ফেল করো, তবু অন্যের খাতা থেকে টুকলিফাই করার কোনোও অর্থ নেই, বুঝলে? এটা আত্ম-মর্যাদারও ব্যাপার।’
‘পরীক্ষার রেজাল্ট দিলে বুঝবোনে।’ চাপা আওয়াজে বললো রাশেদ। কিন্তু আমার ভেতর ব্যাপারটা অন্যভাবে কাজ করছে। আমার মনে হলো, সত্যিই হয়তো সে খুব ভালো করছে। রাশেদ-শাকিল-শিমুরা অবশ্য শওকতকে পাত্তা দিতে চাইছে না, কারণ ওরা ক্লাসের- এমনকি পুরো ইশকুলেরই নামকরা স্টুডেন্ট। আর কোথাকার কোন শওকত, তাকে পাত্তাই বা দেবে কেন ওরা?
[চলবে]

Share.

মন্তব্য করুন